স্টেডিয়াম স্তব্ধ। রোম অলিম্পিকের বিস্তীর্ণ ট্র্যাকের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছেলেটা। দুচোখে হতাশা। বিজয়ীর মুকুট নিয়ে উল্লাসে মেতেছে মার্কিন অধিবাসীরা। বিশ্বরেকর্ড করে সোনা জিতছেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী – মাত্র ০.১ সেকেন্ডের ফারাকে শেষ হয়ে গেল চল্লিশ কোটি ভারতবাসীর অলিম্পিক পদকের স্বপ্ন – একা দাঁড়িয়ে রইলেন ট্র্যাজিক হিরো ‘দ্য ফ্লাইং শিখ’- মিলখা সিং।
১৯৫৮ সালে ন্যাশনাল গেমস, এশিয়ান গেমস এবং কমনওয়েলথ গেমসে ২০০ এবং ৪০০ মিটার দৌড়ে সোনা জিতে দেশকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করলেন দীর্ঘদেহী পাঞ্জাবী মিলখা। দেশভাগের সময়ে উদবাস্তু হয়ে পড়া, অনাথ মিলখার দৌড়ের ময়দানে উত্থানের কাহিনী উজ্জীবিত করছিল দেশের তরুণ যুব সমাজকে।
১৯৫৮ সালে দুরন্ত পারফর্ম্যান্সের জন্য ভারত সরকার মিলখা সিংকে দিল ক্রীড়াজগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘পদ্মশ্রী’। এই পরিস্থিতিতে ১৯৬০ সালে রোমে বসল অলিম্পিকের আসর। ১৯৫৬ মেলবোর্ন অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করলেও পদক অধরা ছিল মিলখা’র। তাই রোম অলিম্পিক হয়ে উঠল মিলখার পাখির চোখ। ২০০ এবং ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে অন্যতম ফেভারিট হিসেবে অংশগ্রহন করলেন তিনি- আপামর ভারতবাসী যেন অপেক্ষায় ছিল মিলখার জয়ধ্বনির জন্য।
রেস শুরু হবার প্রথম ল্যাপেই যেন নিজের ডানা মেলতে শুরু করলেন ফ্লাইং শিখ। বিশ্বের বিখ্যাত স্প্রিন্টার ওটিস ডেভিস, কার্ল কফম্যানদের পাশে যেন ট্র্যাকের ওপর নিজের গতির ঝলক ছড়িয়ে দিতে থাকলেন মিলখা। প্রথম ২৪-২৫ সেকেন্ডের মাথায় যখন পদক প্রায় নিশ্চিত তখনই পথভ্রষ্ট হলেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আথলেট।
দৌড়ের ২৫০ মিটারের মাথায় হঠাৎ যেন তাঁর বিদ্যুৎ গতিকে শ্লথ করে দিলেন; কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে যেন ভ্রান্ত চিন্তা ঘিরে ধরল তাঁকে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা মিলখা কয়েক মুহুর্তে পিছিয়ে গেলেন চতুর্থ স্থানে। সম্বিত ফিরতেই ফের মরণপণ দৌড় শুরু করলেন মিলখা কিন্তু শেষরক্ষা হল না।
মাত্র ০.১ সেকেন্ডের ব্যবধানে তিনি শেষ করলেন চতুর্থ স্থানে। মিলখা দৌড় শেষ করলেন ৪৫.৭৩ সেকেন্ডে- ভারতীয় ক্রীড়ায় লেখা হল নতুন ইতিহাস। প্রথমবার কোনো ভারতীয় অলিম্পিকের মঞ্চে ন্যুনতম সময়ে শেষ করলেন দৌড়। কিন্তু স্বপ্ন ছোঁয়া হল না মিলখার। তিন কিংবদন্তী রানার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওটিস ডেভিস, জার্মানির কার্ল ক্যাপমান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যালকম স্পেন্স জিতলেন পদক।
রোমের মাটিতে এই বিখ্যাত রেসটিকে অলিম্পকের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাইট হিসেবে গণ্য করা হয়। এক সাথে অসংখ্য রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল ১৯৬০-এর এই দৌড়। ওটিস ডেভিসের বিশ্বরেকর্ড, মিলখার ভারতীয়দের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দৌড়ের রেকর্ড এবং সর্বনিম্ন ব্যবধানে পদক নির্ধারন যেন ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দিল রোম অলিম্পিককে।
অলিম্পিকের পরে এক সাক্ষাৎকারে মিলখা স্বীকার করেছিলেন ২৫০ মিটারের মাথায় হঠাৎই তাঁর যেন মনে হয়েছিল তাঁর দৌড় ত্রুটিপূর্ণ এবং তা বাতিল হয়ে যেতে পারে, তাই তিনি গতি কমিয়ে বাকি প্রতিযোগিদের দেখে নিতে চেয়েছিলেন – হয়ত এটাই ছিল ভারতীয় ক্রীড়া ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভ্রম। এক বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম মিলখার এই ক্ষণিকের ভ্রান্তিকে ‘দ্য বিগেস্ট ব্লান্ডার ইন ইন্ডিয়ান স্পোর্টস হিস্ট্রি’ বলে ও ব্যাখ্যা করেছে।
সেদিন হয়ত পদক জেতেনি মিলখা কিন্তু মিলখার দৌড় সেদিন যেন শুধু পদকের জন্য ছিল না। মিলখার দৌড় ছিল এক অনাথ- উদবাস্তু, ভাগ্যের কাছে হেরে যাওয়া মানুষের জীবনযুদধের মরণপণ লড়াই। বুকে বারুদ নিয়ে নিজের সর্বস্ব একটু একটু করে ছাই হয়ে যেতে দেখার নিয়তির নাম ‘মিলখা সিং’।
নিজের ছাই থেকে ভারতের পরবর্তী প্রজন্মের ক্রীড়াবিদদের বুকে দধিচীর হাড় হয়ে বেঁচে থাকার আদর্শের নাম মিলখা সিং, তাই তো আজও অলিম্পিক রেকর্ডবুকে অসংখ্য বিশ্ব রেকর্ডের পাশে জ্বলজ্বল করে ‘মিলখা সিং’ এর নাম, ভারতের উত্তর থেকে দক্ষিণের আকাশে নিঃসঙ্গ উড়ে চলা এক ‘আগুনপাখি’!