গলি থেকে রাজপথ

‘গলি থেকে রাজপথ’ – ভারতীয় ক্রিকেটে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ন্যায় এর চেয়ে বড় উদাহরণ দ্বিতীয়টি আর নেই। রাঁচির মতো এক ছোট্ট মফস্বল শহর যেখানে স্বপ্ন দেখারও একটা মফস্বলীয় বাধ্য বাধকতা থাকে সেখান থেকে রকেটের গতিতে তার উত্থান।

আজ ঝাড়খন্ড রাজধানী হওয়ার সুবাদে রাঁচি যতই ঝাঁ চকচকে হোক না কেন আজ থেকে তিরিশ বছর আগে অর্থাৎ যে সময়টা মহেন্দ্র সিং ধোনি বেড়ে উঠছেন সেই সময় রাঁচি ছিলো এক নেহাতই অকিঞ্চিৎকর মফস্বল শহর যে শহরের উঠতি তরুণদের স্বপ্ন লম্বা লম্বা কাঁধ ছাপানো চুল জোরে বাইক চালিয়ে সমবয়সী তরুণীদের আকৃষ্ট করার মধ্যেই সাধারণত সীমাবদ্ধ থাকতো।

সেইখান থেকে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে উত্থান মহেন্দ্র সিংহ ধোনির যে স্বপ্নের সার্থক রূপ দেওয়ার জন্য তিনি অনায়সে ছেড়ে দিতে পারেন ভারতীয় রেলের মতো সরকারি চাকরির নিশ্চিন্ত আশ্রয়, যে স্বপ্ন কে সার্থক করার জন্য চলন্ত ট্রেনে দৌড়ে উঠে পড়ে বাড়ী ফিরে বাবার কাছে এক বছরের জন্য সময় চেয়ে নিতে পারেন। সেই সময় অর্থ্যাৎ নব্বই দশকের শেষের দিকে ঝাড়খন্ড রঞ্জি ট্রফির এলিট গ্রুপেও খেলার সুযোগ পেতো না।

সেইখান থেকে মাথার উপর বিশ্বকাপ তুলে ধরার কাহিনী আক্ষরিক অর্থেই যেন ‘গলি থেকে রাজপথ’ এর রূপকথা। জীবনে কোনদিন স্কুল ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব না করা লোকটিই ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধিনায়ক এবং সাদা বলের ক্রিকেটে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ অধিনায়ক এবং তার নেতৃত্ব বা লিডারশিপ পৌঁছে গেছে মিথের পর্যায়ে।

একদিনের ক্রিকেটে পাঁচ বা ছ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে সাতাশি স্ট্রাইক রেট সহ পঞ্চাশের উপর গড়ে দশ হাজার রান করেছেন, টেস্টে করেছেন পাঁচ হাজার রান। খুঁত ধরা সমালোচকেরা প্রশ্ন তুলেছেন তার উইকেট কিপিং দক্ষতা নিয়ে অথচ দিনের শেষে উইকেটের পিছনেও তার শিকারের সংখ্যা বিশ্ব ক্রিকেটে চতুর্থ স্থানে।

তার স্টাম্পিং করার ক্ষমতা নিয়ে তৈরি হয় গল্প গাঁথা। না তাকিয়ে বাউন্ডারি লাইন থেকে উড়ে আসা বল তালুবন্দি না করে আলতো ছোঁয়ায় উইকেটে মেরে বারবার বিপক্ষের ব্যাটারদের রান আউট করা পৌঁছে যায় মিথের পর্যায়ে এবং উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে ডিআরএস নেওয়ার ক্ষেত্রে তার ভূমিকার জন্য লোকমুখে ডি আর এসের নাম হয়ে যায় ‘ধোনি রিভিউ সিস্টেম’।

নিশ্চিত ভাবেই তার বদলে অন্য কেউ থাকলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে থেকে অবসর গ্রহণের পর এই দুবছর ধরে বিভিন্ন স্টুডিওতে বসে কেন শেষ ওভার যোগিন্দর শর্মা কে দিয়েছিলেন, কেনই বা শ্রীশান্ত কে বড় ফাইন লেগে সরিয়ে আনেন কেনই বা যুবরাজের আগে তিনি ব্যাট করতে নেমেছিলেন কোন মন্ত্রেই বা একশো কুড়ি রানের পুঁজি নিয়ে ইশান্ত শর্মা মার খাওয়া সত্ত্বেও তাকে দিয়ে বল করিয়ে বাজিমাত করেছিলেন তার গল্প রসিয়ে রসিয়ে করে যেতেন যেমন তিরাশির সেই অমর যোদ্ধারা এখনো করে যান কিন্তু বিশ্বকাপ জয়ের এই এগারো বছর পরেও মহেন্দ্র সিংহ ধোনি সর্ব সাকুল্যে এই নিয়ে এগারোটা ইন্টারভিউ দিয়েছেন কিনা সন্দেহ।

বরং তিনি পছন্দ করেছেন সবার নজর এড়িয়ে সেনা ছাউনিতে সেনাবাহিনীর কাজ করতে। একের পর এক প্লেয়ার তুলে এনেছেন, তার অমূল্য পরামর্শ বদলে দিয়েছে বহু ক্রিকেটার কে। শেষ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সাথে দ্বৈরথের পর প্রথমবারের জন্য বিশ্বকাপের মঞ্চে ভারত কে হারানোর পর আনন্দোৎসবে গোটা দলের সাথে গা না ভাসিয়ে গুটি কয়েক পাকিস্তানী প্লেয়ার চলে আসেন তার কাছে।

উদ্দেশ্য মাহি ভাইয়ের অমূল্য পরামর্শ নেওয়া। তাই বিরাট কোহলি বলতে পারেন ‘আপ হামেশা মেরা কাপ্তান রোহগে মাহি ভাই’ রোহিত বলতে পারেন ‘মাহি ভাই কা বাত হি কুছ আলাগ হ্যায়’ জাদেজা তাকে মাঠের মধ্যেই প্রণাম করেন, অধিনায়ক হয়ে বুমরাহ প্রথমেই স্মরণ করেন তার মাহি ভাই কে, নতুন রূপে ফিরে আসা হার্দিক এর গলায় বারবার ঝরে পরে মাহি ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

অশ্বিন থেকে শামি, পান্ত থেকে কুলদীপ হালের ঋতুরাজ থেকে শার্দুল বারবার উল্লেখ করেন তাদের মাহি ভাইয়ের কথা কিন্তু তিনি এম এস ধোনি কখনো কোন কাছের সাংবাদিক কে ধরে এগুলো কখনো মিডিয়াতে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন নি, যেটা করেছেন তার পূর্বসুরী অনেক প্রাক্তন।

অচঞ্চল থেকে যে জিনিসটা তার হাতে আছে সেটা করার চেষ্টা করেছেন, যেটা তার হাতে নেই সেটা নিয়ে অহেতুক ভেবে মাথা খারাপ করেন নি। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির চেয়ে অনেক বড় ক্রিকেটার এদেশে জন্মেছেন, ভবিষ্যতেও জন্মাবেন কিন্তু তার মতো এরকম বিচক্ষণ নীরব হিমশীতল স্পর্ধা নিয়ে আর কোন ক্রিকেটার জন্মাবে কিনা সন্দেহ।

‘ছয়টা মেরে বলটা গ্যালারিতে ফেলে ম্যাচটা শেষ করাটা আমার কাজ ছিলো এবার গ্যালারিতে বলটা কে পেলো ওসব ভাবতে আমার বয়েই গেছে ।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link