এলিট আম্পায়ার এখন পুরনো জুতার দোকানদার

মাথায় হ্যাট, গায়ের পরনে পোষাকের দু’পাশে আইসিসি আর ফ্লাই এমিরেটসের লোগো- অভিজাত এ পোষাকে বাইশ গজের ক্রিকেটে দেখা মেলে আম্পায়ারদের। মাঠে খেলা ২২ ক্রিকেটারের পাশাপাশি অনফিল্ডে থাকা ২ জন আম্পায়ারও একটি ক্রিকেট ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।  

তর্জনী উঁচিয়ে ব্যাটারকে আউটের সংকেত দেওয়া, কিংবা দুই হাত উপরে উঠিয়ে ছক্কা নিশ্চিত করা- সব কিছুই আসে আম্পায়ারের দেওয়া সংকেত থেকে। ক্রিকেট মাঠ তাই শুধু ক্রিকেটারদের জন্যই আবেগের জায়গা না। আম্পায়ারদের স্মৃতিতেও আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে মাঠ। মাঠের কতশত গল্প, কত উচ্ছ্বাসের গল্প, বিষাদের গল্প- সবকিছুই নিরপেক্ষতার ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে দেখতে হয় আম্পায়ারদের।

একটু এদিক ওদিক হলেই সমর্থকদের গালি। এমন থ্যাংকলেস জব করে অবশ্য অনেকে বিখ্যাতও হয়েছেন। সাইমন টোফেল, স্টিভ বাকনর, ডেভিড শেফার্ড, আলিম দার, বিলি বাউডেনসহ আরো বহু আম্পায়ার ক্রিকেট সমর্থকদের মনে গেঁথে আছেন। 

এই তালিকায় আরেকজন আসতে পারেন। তিনি আসাদ রউফ। ক্যারিয়ারে ১৭০ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। কিন্তু সেই তিনি এখন ক্রিকেটের আশেপাশেও নেই। লাহোরের লাণ্ডা বাজারে পুরনো জুতা আর পোশাকের ব্যবসা করেন তিনি।  মূলত এক মডেলকে যৌন হেনস্থা এবং জুয়াড়িদের থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগেই ছন্দপতন হয় তাঁর জীবন। সম্প্রতি পাকিস্তানের এক সংবাদমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারের সময় তিনি ফিরে যান অতীতের গল্পে। 

ক্রিকেটের সঙ্গে তাঁর এখন কোনো সম্পর্কই নেই। খবরও রাখেন না। এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘জীবনে অনেক ম্যাচে আম্পায়ারিং করেছি। আর নতুন করে কিছু দেখার নেই। ২০১৩ সালের পর থেকে খেলার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই। পুরোপুরি ক্রিকেট থেকে দূরে রয়েছি।’

আসাদ রউফের জীবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা এসেছিল ২০১৬ সালে। সে বছর তাঁকে পাঁচ বছর নির্বাসিত করেছিল বিসিসিআই। ২০১৩ সালে আইপিএলে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সাথে নাম জড়িয়ে গিয়েছিল রউফের। অভিযোগ ছিল, জুয়াড়িদের থেকে দামি দামি উপহার এবং টাকা নিয়ে একটি নির্দিষ্ট দলের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।

এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘জীবনের সেরা সময় আইপিএলে কাটিয়েছি। ওই অভিযোগ নিয়ে এখন আর কিছু বলার নেই। বিসিসিআই নিজেরা অভিযোগ করেছিল, নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।’

এর আগে ২০১২ সালে রউফের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনেছিলেন এক মডেল। দাবি করেছিলেন, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিনের পর দিন তাঁর সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলেন রউফ। কিন্তু রউফ সেই প্রতিশ্রুতি থেকে দূরে সরে আসেন।

এ অভিযোগ অবশ্য সেই সময় রউফ অস্বীকার করেছিলেন। এবারও তিনি ওই ঘটনা স্বীকার করেননি। বলেছেন, ‘মেয়েটি অভিযোগ করার পরের মৌসুমেই আইপিএলে আমি আম্পায়ারিং করেছিলাম।’ তবে এ দুটি ঘটনায় আসাদ রউফের সুনাম যে ক্ষুণ্ণ  হয়েছিল সেটি মেনে নেন তিনি। 

সাক্ষাৎকারে উঠে আসে আসাদ রউফের আম্পায়ার হওয়ার গল্পও। তখন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সিইও ছিলেন মজিদ খান। পাকিস্তান থেকে উন্নতমানের আম্পায়ার তুলে আনার দায়িত্ব পড়ে তাঁর কাঁধে। মজিদের অনুরোধেই প্রাক্তন ক্রিকেটার হিসেবে আম্পায়ারিং শেখা শুরু করেন রউফ এবং পরবর্তীতে পুরোদস্তুর আম্পায়ার হয়ে যান তিনি।

প্রায় এক দশক ক্রিকেট ছেড়ে হঠাৎ পুরনো জামা কাপড়, জুতা বিক্রির পেশায় কেন এলেন? এই প্রশ্নে আসাদ রউফ বলেন, ‘এই পেশা আসলে আমার জন্য না। আমি এটা আমার কর্মচারী আর পরিবারের জন্য করি। জীবনে অনেক টাকা দেখেছি। এ বিশ্ব দেখেছি। বিশেষ কোনো লোভ নেই। আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, আমার স্ত্রীও পড়ে। আমার এক ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী। আরেক ছেলে আমেরিকা থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে। এদের নিয়েই আমার কেটে যায়। আমি আম্পায়ার হিসেবে উচ্চতার শীর্ষে যেতে চেয়েছিলাম। সেটা পেরেছি। এখন আমি সেরা ব্যবসায়ী হতে চাই৷’

জৌলুশ ক্যারিয়ার, এরপর ছন্দপতন। অত:পর আবারো সাদামাটা জীবনে ফিরে যাওয়া। মানুষ  দিনশেষে নীড়েই ফিরতে চায়। আসাদ রউফও ফিরে গিয়েছেন। একদম সাদামাটা জীবন বেঁছে নিয়েছেন ৬৬ বছর বয়সী এই বুড়ো।

তবে, ক্রিকেট মাঠের এক সময়কার সরব এ আম্পায়ার ক্রিকেটের ধাঁরে কাছেও এখন ঘেঁষেন না কেন? মাঠের সাথে কিসের এতো অভিমান? নাকি বহুকালের অভ্যস্ততাতে বিরক্তি এসে গিয়েছে? গ্যালারি জুড়ে দর্শকদের উন্মত্ততা ছেড়ে হয়তো নিস্তব্ধতায় একটু শ্বাস নিতে চেয়েছেন, গণ মানুষের মাঝে অতি সাধারণ হিসেবে মিশে যেতে চেয়েছেন।  

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link