এক রূপের দুই বাজপাখি

ইউরোপের সমৃদ্ধ ফুটবল ইতিহাসের সাথে অন্য মহাদেশগুলো সেভাবে পেরে উঠছেনা। অতি সম্প্রতি শেষ হওয়া ইউরো আর কোপা আমেরিকা কাপের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। বাছাইপর্ব থেকে শুরু করে ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের আসরের প্রতিটা পরতে পরতে থাকে টান টান উত্তেজনা।

কোপা আমেরিকায় থাকেনা সেরকম কিছুই। তবে বাছাইপর্ব না থাকায় মূল পর্বে দারুণ সব ম্যাচ দেখার সুযোগ পেয়ে থাকেন দর্শকরা। সেরার হিসাব করলে অনেক তর্ক বিতর্ক হতে পারে, তবে একটি জায়গায় নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন জিয়ানলুইজি ডোন্নারুম্মা। প্রথম গোলরক্ষক হিসেবে উইরো ২০২০ এর সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বল জিতে নিয়েছেন।

১৯৯৬ সাল থেকে দিয়ে আসা সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারে প্রথমবার অংশ নিয়েই এবার নিজের নাম উঠিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। কোপা আর ইউরো মিলিয়ে নিশ্চিতভাবে তাই সেরার আসনেই থাকনে এই ইতালিয়ান। সেখানে পার্শ্বনায়ক হিসেবে থাকবেন আর্জেন্টিনার এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। দু’জনের কৃতিত্বে দুই মহাদেশে নিজ নিজ দেশকে শিরোপা এনে দিতে ভুমিকা রেখেছেন।

তবে ডোন্নারুম্মার অবস্থানটা এখানে সবার উপরেই থাকবে। লন্ডনের ওয়েম্বলির ফাইনালে যেভাবে স্বাগতিকদের কাদিঁয়ে ৫৩ বছর পর ইউরোর শিরোপা জিতেছেন তাতে তার নামটি এখন বেশি করেই উচ্চারিত হচ্ছে। বাদিকে ঝাপিয়ে পড়ে বুকায়ো সাকার শট ফিরিয়ে দিয়ে ইতালীকে উল্লাসে মাতার উপলক্ষ্য এনে দেন। উল্লাসে মাতার বিপরিতে যেন পরের শটটির জন্য নিজের প্রস্তুতি নেবার বিষয়টিই তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

উল্লাস তো নেইই, মুখে নেই হাসিঁটাও। হয়তো নিজের কাছে বিশ্বাসই হচ্ছিলনা এত বড় একটা অর্জন করে ফেলেছেন বলে। ৩-২ গোলের ঐতিহাসিক এক জয়ের পরও যখন সতীর্থরা তার পিঠে চেপে বসেছে তখনো যেন ভাবলেশহীন ডোন্নারুম্মা।

দীর্ঘকায় এই আজ্জুরি গোলরক্ষকের অবস্থাটা এরকম, টাইব্রেকার ঠেকানোর দায়িত্বটা আমার আর উল্লাস যদি করতেই হয় সেটি তোমরাই করো। ঠিক এ সময়ই ইংলিশ গোলরক্ষক জর্ডান পিকফোর্ড অসহায় চোঁখে দেখেছেন প্রতিপক্ষ গোলরক্ষকের অসামান্য কীর্তি। হয়তো মনে মনে আফসোসে পুড়ছেন এই বলে যে, আমি কেন ওই বলটা বাদিকে ড্রাইভ না দিয়ে ডানদিকে ড্রাইভ দিয়েছি।

ইতালি-ইংল্যান্ড ফাইনালে লড়াইয়ের আড়ালে দুই গোলরক্ষক দোন্নারুম্মা-পিকফোর্ডের মধ্যেও লড়াই হয়েছে। ফাইনালের আগে ইংল্যান্ড গোলরক্ষক মাত্র একটি গোল হজম করেছিলেন। এবারের ইউরোতে ক্রিশ্চিয়ানা রোনালদো, প্যাট্টিক শিকরা, রোমেলু লুকাকুদের ছাপিয়ে কয়েকজন গোলরক্ষক আলো ছড়িয়েছেন। এক ডোন্নারুম্মাই ফাইনালে দুটিসহ মোট তিনটি টাইব্রেকার ঠেকিয়েছেন।

অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডের ইয়ান সমার ও স্পেনের উনাই মেসনও স্নায়ুচাপ ধরে রাখার মিশনে বেশ সফলই বলা যায়। তবে কি শুধু টাইব্রেকারেই নয় পেলান্টি কিকের পাশাপাশি স্পটকিক ঠেকাতেও কম যাননি তারা। তবে ইউরোতে আরেকটি বিষয়ও কাজ করেছে। এই যেমন মাঠে খেলারত অবস্থায় ডেনমার্কের ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের হার্ট এটাকের পর সেই ম্যাচেই পেলান্টি পেয়েছিল ডেনমার্ক।

সেখান থেকে এমিল হাইবিয়া শট নিলে গোলরক্ষক লুকাস রাদেস্কি সেটি ঠেকিয়ে প্রথম জয় এনে দিয়েছিলেন। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের হতাশ করাদের মধ্যে ডেনমার্কেরই গোলরক্ষক কাসপার স্মাইকেলও রয়েছেন। পুরো টুর্নামেন্টে বলার মতো ১৮ টি সেভ করে সবাইকে পেছনে ফেলেছেন।

এদিকে আবার দলকে বিপদের হাত থেকে বাচাঁতে এগিয়ে থাকবেন সুইস গোলরক্ষক সমার। ৩০টি সম্বাব্য আক্রমনের মধ্যে ২১টিতেই দল বাচিঁয়েছেন। ইংলিশ পিকফোর্ড প্রথম পাঁচ ম্যাচে কোন গোল হজম না করে শেষ দুই ম্যাচে দুটি গোল খেয়েছেন। পরিসংখ্যান হিসাব করলে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বেশি ৮৮.২ শতাংশ শট ঠেকিয়ে আবার সবার উপরে রয়েছেন পিকফোর্ড।

সেরা হওয়া ডোন্নারুম্মার সাফল্যের হার আবার ৭৫ শতাংশ। দল সফল না হলেও বেলজিয়ামের থিবো কোর্তোয়া ও ফিনল্যান্ডের রাদেস্কি আবার ৮০ শতাংশ শট ফিরিয়েছেন। তবে ডোন্নারুম্মার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ও পুরো আসরে আসাধারণ সাফল্যের কারণে তাকে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচিত করতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি।

কেন তাকে সেরার মুকুট দেওয়া হয়েছে ব্যাখ্যাও দিয়ে ইউরোর টেকনিক্যাল কমিটি জানিয়েছে, তিন ম্যাচে ছিলেন ক্লিনশিট।  নয়টি দুর্দান্ত সেভ করার পাশাপাশি সেমিফাইনালেও ছিলেন পেনাল্টি শুট-আউটের হিরো। একইভাবে ফাইনালেও পেনাল্টি শুট-আউটের হিরো হয়েছেন। সুতরাং, সেরার পুরস্কারটা দিতে বেশি ভাবতে হয়নি’।

নেইমার-রামোসের পিএসজিতে গত মাসে নাম লেখানো ডোন্নারুম্মাা ইতালির জার্সিতে খেলেছেন ৩৩ ম্যাচ। এবারের ইউরোতে সব মিলিয়ে খেলেছেন ৭১৯ মিনিট খেলে ক্লিনশিট নিয়ে ফিরেছেন তিন ম্যাচে। চারটি গোল হজমের পাশাপাশি সেভ করেছেন নয়টি। পুরো টুর্নামেন্টের মধ্যে শুধুমাত্র গ্রুপ পর্বে ওয়েলসের বিপক্ষে ইতালির ১-০ গোলে জেতা ম্যাচেই পুরোপুরি খেলেননি ডোন্নারুম্মা।

ওই ম্যাচে ৭৯ মিনিটে তাকে তুলে নিয়ে সালভাতোরে সিরিগুকে বদলি হিসেবে নামিয়ে ইতালি কোচ রবার্তো ম্যানচিনি পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। তবে সব মিলিয়ে দোন্নারুমা এবারের আসরে অন্য যেকোনো পজিশনের খেলোয়াড়ের চেয়ে বেশি সময় খেলেছেন।

ইউরোর মতো কোপা আমেরিকাতে গোলরক্ষকদের দাপট ছিল। কলম্বিয়ান গোলরক্ষক ডেভিড ওসপিনা কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়েল বিপক্ষে টাইব্রেকারে দুটি গোল রক্ষা করে দলকে সেমিফাইনালে তুলেছিলেন। শেষ চারের লড়াইয়ে আবার অবাক হয়ে দেখেছেন আরেক গোলরক্ষককে নায়ক হওয়া।

আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক এমলিয়ানো মার্টিনেজ তাঁর দল কলম্বিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালে তিন তিনটি টাইব্রেকার শট ঠেকিয়ে দলকে ফাইনালে তুলেছিলেন। তাকে ছোট করার তাই কোন সুযোগই নেই। মেসিও স্বীকার করেছেন মার্টিনেজের বীরত্ব গাথার কথা। সেখানে বড় হরফেই লেখা থাকবে তাঁর নামটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link