তোমাকে সমর্পণ করে গেলাম আমরা, ম্যাড ম্যাক্স!

নাকি গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে তাঁরা বলবেন - ‘ব্ খুদা সপূর্দমৎ?’ ক্রিকেটের এই বিরাট মহাকাব্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল পর্বের কাছে তোমাকে সমর্পণ করে গেলাম আমরা, ম্যাড ম্যাক্স!

বিদায় নেওয়ার সময়ে, যে চলে যাচ্ছে সে বলে, ‘ব্ আমানে খুদা’, যার বাংলা অর্থ, ‘তোমাকে খোদার আমানতে রাখলাম’; আর যে যাচ্ছে না সে বলে, ‘ব্ খুদা সপূর্দমৎ’- অর্থাৎ ‘তোমাকে খোদার হাতে সমর্পণ করলাম। আজ্ঞে, এটাই আফগানিস্তানের বিদায় রীতি। ‘গুড বাই’-এর আফগানি ভার্সান।

অনেকদিন আগে, প্রথম যখন আফগানিস্তানকে ভালবাসার শুরু, তখনও ক্রিকেটে আফগানিস্তান এমন ধূমকেতু হয়ে উঠে আসেনি। এসেছে বাংলাভাষায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে-বিদেশে পড়ে এই দুটো লাইন জেনেছিলাম।

মনে থেকে গেছে, কারণ শেষ পর্বে, আবদুর রহমানের সঙ্গে বিদায়দৃশ্যে লেখক ফ্লাইটে ওঠার পর চেয়ে দেখছিলেন আবদুরের দিকে ৷ জানলার কাচ দিয়ে। মুজতবা আলি বলেছিলেন, বহুদিন ধরে সাবান ছিল না বলে, তাঁর পাগড়িটা ময়লা হয়েছিল, কিন্তু চারদিকের বরফের চেয়েও সে যেন সাদা, আর তার চেয়েও সাদা ঐ আফগানের হৃদয় খানা।

একটা অদ্ভুত মায়া সেই থেকে। আফগানিস্তান ২০২৩ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপে যে ক্রিকেট খেলেছে, আজ, এদেশের সিংহভাগ মানুষই প্রাণপণে চাইছিলেন তাঁদের জয়। পড়শিরা, তাঁদের ব্যর্থতা, ক্রিকেটীয় দারিদ্র্য ঢাকতে যেভাবে ভারতের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ আনছেন, দীর্ঘদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে সর্বত্র বিরাট-রোহিতদের বিরুদ্ধে যে বিবমিষা – আফগানরা এই অন্ধকার থেকে বহু বহুদূরে।

আজ, তরুণ আফগান ব্যাটার সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে যখন অম্লানবদনে শচীনকে গুরুর সম্মান দিচ্ছেন তখনও আশা করে আছে গোটা দেশ, রূপকথার। কারণ, আফগানরা যোগ্য, তার চেয়েও বেশি আফগানরা ক্রিকেটীয় নৈতিকতা ও সূক্ষ্ম মনস্তত্বের উপমহাদেশীয় সমস্ত সূচকের পাশে মসৃণ টিক চিহ্ন রেখে গেছেন গোটা বিশ্বকাপে। মার্নস ল্যাবুশেন আর মার্কস স্টোয়িনিস আউট হলেন। উইন প্রেডিক্টর দেখাচ্ছে আফগানদের জয়ের সম্ভাবনা ৮৩ শতাংশ।

গ্লেন ম্যাক্সওয়েল! খেলা শেষের পর স্কোরবোর্ড বলছে ২০০ রানের মতো একটা পার্টনারশিপে প্যাট কামিন্সের কন্ট্রিবিউশন ১২ রান! আজ্ঞে, মোট রানের ৬ শতাংশ! ১৮০ রানের ওপর করেছেন ম্যাড ম্যাক্স। একা।

বিশ্বকাপ তো ছেড়ে দিন, একদিনের ক্রিকেটের ইতিহাসে, এমন ঘটনা বিরল। আর বিরল থেকে বিরলতম এই রূপকথা আরেকটা রূপকথাকে চাপা দিয়ে দিল। পিষে দিল। মিডিয়া নিউজপ্রিন্টে, ফ্রন্টলাইন থেকে ফুটনোট হয়ে যাবেন ইব্রাহিম জাদ্রান। খুব তেতো সত্যি এই!

গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের এই ইনিংস তিনি খেলতেই পারতেন অন্য কোনওদিন, তাঁর সে বিরল ক্ষমতার হদিশ সকলের জানা ৷ কিন্তু, খেললেন আজ ৷ ম্যাচ শেষের কয়েক ওভার আগে থেকে পায়ের ক্র‍্যাম্পে হাঁটু থেকে অংশটা বেন্ড করতে পারছিলেন না। জোরে হাঁটার মতো করে রান নিয়ে স্ট্রাইক রাখছিলেন।

যে অবস্থায় ম্যাক্সি এ ইনিংস খেললেন, অন্তত, বিশ ওভার আগেই তাঁর হাল ছেড়ে প্যাভিলিয়নে ফেরার কথা। ফেরেননি। কারণ, তিনি জানেন, ইতিহাসকে ফিকে করতে গেলে একটা আগামীর ইতিহাস লেখা জরুরি। সেটা লিখলেন। এবং, ভণিতাবাতিল স্টেটমেন্ট দিলে, ওয়ান ডে ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ইনিংসটি খেললেন বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ মঞ্চে!

ম্যাচ শেষে দেখলাম ক্লান্ত আফগান প্লেয়াররা পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন যন্ত্রণাক্লিষ্ট ম্যাক্সওয়েলের। তাঁদের এদেশ থেকে নিজের দেশে ফেরার বিমানের টিকিট কাটা হয়ে গেল আজ। রশিদ খান জানেন, তাঁর দেশে, বিমানের ডানা থেকে ঝুলন্ত মানুষ টুপটাপ খসে পড়ে মাটিতে।

স্বপ্নও। তবু, সে স্বপ্ন আসলে বীজ। মানুষের মতো। আরও অনেক স্বপ্নের জন্ম দেয়। অনেকটা আজমাতুল্লাহ-র হ্যাটট্রিক বলটার মতো। একটুর জন্য কত কিছু না হওয়া। আমি নিশ্চিত, এ স্বপ্নের সঙ্গে নিশ্চই একদিন মোলাকাত হবে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের।

আফগানিস্তান দেশে ফিরে যাবার সময় ম্যাক্সওয়েল কি বলবেন- ‘ব্ আমানে খুদা’? তোমাকে স্মৃতির আমানতে রাখলাম হে আফগান! তোমাদের ময়লা জার্সির ভেতরেও উজ্জ্বল তোমাদের সিংহহৃদয়, দ্যা লাওন হার্ট!

নাকি গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে তাঁরা বলবেন – ‘ব্ খুদা সপূর্দমৎ?’ ক্রিকেটের এই বিরাট মহাকাব্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল পর্বের কাছে তোমাকে সমর্পণ করে গেলাম আমরা, ম্যাড ম্যাক্স!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link