৩ জুন, ২০০২। মুনসু কাপ স্টেডিয়াম, উলসান। ব্রাজিলের প্রথম ম্যাচ। প্রতিপক্ষে কাগজে কলমের শক্তিমত্তায় তাদের চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে থাকা তুরস্কের বিপক্ষে। ফুটবল বোদ্ধা কিংবা সমর্থক, সবাই ভাবছিল – শুরুটা হেসেখেলেই কাটিয়ে দিতে পারবে ব্রাজিল।
ব্রাজিলের ভয়ের কোনো কারণও ছিল না। ‘থ্রি আর’-খ্যাত রোনালদো, রিভালদো ও রোনালদিনহোরা আছেন। রবার্তো কার্লোস, কাফুরা তখন ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটাচ্ছেন। কিন্তু, তারপরও প্রথমার্ধ শেষে ব্রাজিলের কোচ লুই ফিলিপ স্কলারির কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। যাচ্ছেতাই একটা বাছাইপর্ব কাটানোর পর ব্রাজিলের বিশ্বকাপের শুরুটাও যে হলো যাচ্ছেতাই। দল যে পিছিয়ে আছে ১-০ ব্যবধানে!
ব্রাজিল সেই ম্যাচে জিতেছিল ২-১ ব্যবধানে। মোটেও সহজ কোনো ম্যাচ ছিল না। ৫০ মিনিটে ‘দ্য ফেনোমেনন’ খ্যাত রোনালদো গোল করে সমতা ফেরান। এরপর ম্যাচের একদম অন্তিম মুহূর্তে (৮৭ মিনিট) পেনাল্টি থেকে ব্রাজিলের জয় নিশ্চিত করেন রিভালদো।
৮৭ মিনিটে ফেহমি রেড কার্ড দেখার পর ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ের ৯৪ মিনিটের মাথায় রেড কার্ড দেখেন হাকান উনসাল। সেটি আদায় করতে অভিনয়ের আশ্রয় নিয়েছিলেন রিভালদো। ব্রাজিল কর্নার পেয়েছিল, রিভালদো কর্নার নেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। বিপক্ষ দলের হাকান উনসাল খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলটা পা দিয়ে ঠেলে দিয়েছিলেন রিভালদোর কাছে।বলটা লেগেছিল রিভালদোর পায়ে। রিভালদো দেখলেন, এটাই তাঁর সুযোগ।
মুখে দুই হাত চেপে ধরে মাটিতে পরে গেলেন। এমন ভাবে তিনি মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন যে মনে হচ্ছিল, তাঁর জীবনটাই হুমকির মুখে পড়েছে। যাই হোক, তাতে অবশ্য রেফারির মন গলে গিয়েছিল। উনসাল লাল কার্ড পান। পরে অবশ্য ফিফা ঘটনাটা বুঝতে পেরে রিভালদোকে জরিমানা করে।
যাই হোক, সেবার প্রথমবারের মতো এশিয়া মহাদেশে অনুষ্ঠিত সেই আসরে আক্ষরিক অর্থেই চমকে দিয়েছিল তুরস্ক। বিশ্বকাপে মাত্র দু’টো ম্যাচ হেরেছিল দলটি, দু’টোই ব্রাজিলের বিপক্ষে, প্রথমটা ওই গ্রুপপর্বের ম্যাচ, পরেরটা সোজা সেমিফাইনাল।
না, ভুল পড়েননি। সত্যিই সেবার জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের শেষ চারে চলে গিয়েছিল তুরস্ক। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে তাঁরা হারায় স্বাগতিক দক্ষিণ কোরিয়াকে। ওটাই দেশটির ফুটবলের ইতিহাসের সেরা সাফল্য। ওই বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ব্রাজিল দল, ব্রাজিলিয়ান অধিনায়কের হাতে পঞ্চমবারের মতো ওঠে বিশ্বকাপের শিরোপা।
সেই তুরস্ক দলটার অধিনায়ক ছিলেন হাকান সুকুর। হাকান সুকুর তুরস্কের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ফুটবলার। আর বিশ্বকাপের ওই সময়টা ক্যারিয়ারের চূড়ায় ছিলেন তিনি। ওই সময় তিনি সিরি-আ’র ক্লাব ইন্টার মিলানে খেলেন। ২৪ ম্যাচ খেলে ইতালিয়ান ক্লাবটির হয়ে পাঁচটি গোল করেন এই স্ট্রাইকার।
তুরস্কের ইতিহাসে তিনি অবিসংবাদিত সেরা স্ট্রাইকার। ১১২টি ম্যাচ খেলে করেছেন ৫২টি গোল। অন্য কোনো তুর্কি ফুটবলারই এর আগে বা পরে এত বেশি গোল করতে পারেনি। বিশ্বকাপের মঞ্চেও তার গোল আছে। সেটা ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে, বিশ্বকাপের তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে।
সুকুর নিজের ক্যারিয়ারের বড় একটা সময় কাটিয়েছেন তুরস্কের ফুটবল ক্লাব গ্যালাতাসারেইতে। বলা যায় এই ক্লাবের ঘরের ছেলে তিনি। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ – চার বছর ছিলেন। পরে আবার ফিরেছিলেন ২০০৩ সালে, ২০০৮ সালে এই ক্লাবটির হয়ে খেলেই ক্যারিয়ার শেষ করেন তিনি। এখানে ২৩৬টি ম্যাচে করেছেন ১০৯টি গোল।
ক্লাব সমর্থকদের প্রিয় মুখ ছিলেন সুকুর। তিনি ছিলেন ‘ক্রাল’, বাংলায় যার অর্থ রাজা। তিনি তুরস্কের পেশাদার ফুটবল আসর সুপার লিগে তিনবার সর্বোচ্চ গোলদাতার খেতাব ‘গোল ক্রালি’ (গোলের রাজা) পান।
যদিও সেই গোলের রাজা আজ পথের রাজা। তিনি এখন আমেরিকাতে উবার অ্যাপে গাড়ি চালান। শুধু তাই নয়, পেটের দায়ে কখনো বইও বিক্রি করেন। ইউরোপের মঞ্চে সেরা স্ট্রাইকারদের সাথে পাল্লা দেওয়ার পরও কেন তার এখন এই বেহাল দশা?
৪৮ বছর বয়সী সাবেক এই তারকা নিজেই খোলাসা করেন সেই রহস্য। জার্মান পত্রিকা ওয়েল্ট অ্যাম সোনট্যাগকে তিনি বলেন, ২০০৮ সালে পেশাদার ফুটবলকে বিদায় বলার পর তার জীবনে এমন সব ভূতুড়ে ঘটনা ঘটে যে, তিনি এই পথে আসতে বাধ্য হন।
এর জন্য সুকুর কাঠগড়ায় তোলেন তুরস্কের আলোচিত ও সমালোচিত রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ানকে। তার দাবি, এরদোয়ান তার বিরুদ্ধে শুধু মিথ্যা অভিযোগই তোলেননি, এমনকি মৃত্যুর হুমকিও দিয়েছেন।
আক্ষেপ করে সুকুর বলেন, ‘আমার কিছুই আর বাকি ছিল না। এরদোয়ান সবই কেড়ে নিয়েছিল। আমার বেঁচে থাকার শক্তি, আমার স্বাধীনতা, কথা বলার অধিকার, কাজ করার অধিকার – সব।’
তুরস্ক ফুটবল দলের সাথে সুকুরের সম্পর্ক ছিল ১৫ বছরের। সেই ১৯৯২ সালে তিনি তুরস্কের জার্সি পড়েন। শেষ করেন ২০০৮ সালে গিয়ে।
ক্লাব ফুটবলে ইন্টার মিলান বা গ্যালাতাসারেই ছাড়াও তোরিনো, পার্মা কিংবা ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের মতো ক্লাবে খেলেছেন তিনি। সব জায়গাতেই গোল করার দক্ষতার জন্য সুনাম কুড়িয়েছিলেন তিনি।
বুটজোড়া তুলে রাখার পর সুকুর নামেন রাজনীতির ময়দানে। সেটা ২০১১ সালের কথা। তুরস্কের সংসদের নির্বাচনে দাঁড়ান। এরদোয়ানের দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলেপমেন্ট পার্টির প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে জিতে গিয়ে তিনি সংসদ সদস্য হন। মাঠের নেতা থেকে, জনগনের নির্বাচিত প্রার্থী – রীতিমতো লোম খাড়া করে দেওয়া একটা অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প।
না, সুকুরের গল্পের ‘টুইস্ট’ শুরু ঠিক এর পর থেকেই।
সুকুর একটা ‘ভুল’ করে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন এরদোয়ানকে। সুকুরের ভাল বোঝাপড়া ছিল ফেতুল্লাহ গুলেনের সাথে। ইসলামিক এই পণ্ডিত এরদোয়ানের প্রতিদ্বন্দ্বী। শুধু তাই নয়, ২০১৬ সালে তুরস্কে যে রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা হয়, তার জন্য এরদোয়ান এই গুলেনকেই দায়ী করেন।
সংসদ সদস্য হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালনের পর দুর্নীতির দায় নিয়ে সুকুরের বিদায় হয়। তখনও অবশ্য নিজেকে ‘নিরাপরাধ’ বলেই দাবি করেছিলেন সুকুর। বলেছিলেন, ‘বন্ধুরা, আমাকে নিয়ে যা বলা হচ্ছে, তার কোনোটাই আমার প্রাপ্য না। মন্তব্যগুলোতে আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। আমি এখন পর্যন্ত খুবই স্বচ্ছ একজন মানুষ। জনগনের জন্য সবসময় কাজ করেছি। আমি সৎ থাকার মন্ত্র নিয়েই রাজনীতিতে এসেছিলাম। তবে, এখন বুঝতে পারছি যে, রাজনীতিটা আমার জন্য নয়। হয়তো আমি এটা করতেই পারি না, কিংবা হয়তো আমি কাউকে না বলতে পারিনি।’
এরপরই তার ফেতুল্লাহ’র সাথে যোগাযোগ বাড়ে। এরদোয়ানের সরকার ফেতুল্লাহ ও তার অনুসারীদের ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ বলে আসছে তখন থেকেই। ২০১৭ সালে তারা সুকুরসহ ফেতুল্লাহ’র বাকি অনুসারীদের রাষ্ট্রচ্যুত করে। ওই সময় থেকেই সুকুরের ঠিকানা যুক্তরাষ্ট্র।
তুরস্কের সরকারি প্রচারযন্ত্রের দাবি অবশ্য ছিল, সুকুর স্যান ফ্র্যান্সিসকোর অন্যতম বিলাসবহুল এলাকা পালো অ্যাল্টোতে থাকছেন। সেখানে তিন মিলিয়ন ডলারের বাড়িতে থাকেন, সাথে একটা ক্যাফেও চালান।
যদিও, সুকুরের দাবি একটু ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে এসে শুরুতে আমি ক্যালিফোর্নিয়ায় একটা ক্যাফে চালাতাম। কিন্তু, অদ্ভুত কিছু মানুষ আসা শুরু হল, সব বন্ধ হয়ে গেল। তাই এখন আমি উবারে গাড়ি চালাই, বই বিক্রি করি।’
তুরস্কে তার বাড়ি, ব্যবসা ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট – সবই বাজেয়াপ্ত করে রেখেছে এরদোয়ানের সরকার। কোনোরকম অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগও অস্বীকার করেন সুকুর। তিনি বলেন, ‘কেউ কখনোই এই ব্যাখ্যাটা দেয় না যে, ওই অভ্যুত্থানে আমার ভূমিকাটা ঠিক কী ছিল। আমি কখনোই বেআইনি কিছু করিনি। আমি বিশ্বাসঘাতক নই, আমি সন্ত্রাসী নই।’
দেশে ফিরতে ব্যাকুল সুকুর। তিনি যতবারই গণমাধ্যমের সামনে আসেন, ততবারই জানান, দেশ তুরস্কের প্রতি তার ভালবাসার কোনো শেষ নেই। নিউ ইয়র্ক টাইমসকে একবার বলেছিলেন, ‘এটা আমার দেশ। আমার দেশের মানুষকে আমি ভালবাসি। তবে, দেশের মানুষ আমার ব্যাপারে কী ভাবে, সেটাও সরকার তাদের নিজেদের প্রচারযন্ত্র দ্বারা নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রেখেছে।’
তবে, সহসাই দেশে ফেরা হচ্ছে না সুকুরের। বরং আমেরিকায় আর যাই হোক, খেয়ে-পড়ে বেঁচে আছেন তিনি। ক্যালিফোর্নিয়াতে ক্যাফেতে কাজ করেছেন কিছুদিন, এরপর এখন উবার চালান। টুকটাক বইটই বিক্রি করেন। গোলের রাজা থেকে এখন রীতিমত পথের রাজাই বনে গেছেন তিনি।
প্রথম প্রকাশ: রোর বাংলা