অমাবশ্যার চাঁদ অথবা ডুমুরের ফুল! টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূলপর্বে বাংলাদেশের কাছে ‘জয়’ নামক শব্দের সমার্থক ওই উল্লেখিত বাগধারাগুলোই। ২০০৭ সালের উইন্ডিজ জয়টাই ছিল সবেধন নীলমনি হয়ে! তাই, ২০২২ আসরের প্রারম্ভে দল নিয়ে তেমন উচ্চাশা ছিল না ভক্তকূলে, এমনকি খোদ বিসিবিরও। পরের বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তো ঘোষনাও এসেছিল!
এশিয়া কাপ, ট্রাই নেশন সিরিজে দলের পারফরম্যান্স, প্লেয়ার বাছাই, এক্সপেরিমেন্টের নামে হাস্যকর ট্যাকটিক্স এবং সর্বোপরি মাঠ এবং মাঠের বাইরে একের পর এক বিতর্ককে সঙ্গী করেই এবারের বিশ্বকাপ আসরে বাংলাদেশ! গ্রুপের অপর তিন জায়ান্টকে টপকে সেমিফাইনালের স্বপ্ন হয়ত মনে মনে ছিল, প্রকাশে নয়।
কোয়ালিফাইং পর্ব থেকে উঠে আসা দুই দলের বিপক্ষে জয় পাওয়াই ছিল প্রাথমিক টার্গেট। সরাসরি মূল পর্বে অংশ নেয়া একটি দলের চাহিদায় এটুকু তো থাকাই উচিত। সমস্যা তৈরি করল জিম্বাবুয়ে! বেশ একটা আনবিটেন রান সঙ্গে করে বাংলাদেশের মুখোমুখি! সদ্য পাকিস্তানকে হারানো দলটির আত্মবিশ্বাস এবং রিসেন্ট ফর্ম বাংলাদেশের বিপক্ষে তাদেরকে ফেভারিট হিসেবেই দাঁড় করিয়ে দিল! সম্ভবত প্রায় এক যুগ পর, জিম্বাবুয়ে ছিল ফেভারিট!
আগের দিন দুই দলের সাম্প্রতিক ঠিকুজি ঘেঁটে জানালাম কেন জিম্বাবুয়ে আজকের ম্যাচ এগিয়ে থেকে শুরু করবে! তবে বিশ্লেষিত ক্রিকেট এবং লাইভ ক্রিকেট আলাদা! আলাদা বলেই এগিয়ে থাকা জিম্বাবুয়ে এক কদম পেছনে থেকেই ম্যাচ শেষ করল! মেলানো অংকের উত্তরে ভুল বুঝি এটাকেই বলে!
শান্তকে দিয়েই শুরু করি। স্লো স্টার্ট, শেষের দিকে এক্সিলারেশন। তবে, এর মাঝে শান্ত যেটা করেছে তা হল ক্রিজে নিজেকে জিইয়ে রাখা। লিটন বা সাকিবের আউটে পরোক্ষ ভুমিকা রাখা শান্তর এই জিইয়ে রাখাটা কাজেও দিয়েছে কিছুটা! সাকিব বা লিটনের আউটে মদদ থাকার অপরাধে নিজেকে অপরাধী ভেবে মারমার কাটকাট ক্রিকেট শুরু করলে ওই মূহুর্তে বিপদে পড়ত বাংলাদেশ। শান্তর ইনিংসের পজিটিভ শুধু এটুকুই। আর, আট ব্যাটসম্যান নিয়েও শেষ ৫ ওভারে পঞ্চাশ রান নেবার ক্ষমতা যে টিমের নেই, সেই টিম শান্তর ইনিংসে অখুশি কেন হবে!
পেসারদের ওভার ঝুলিতে রেখে দিয়ে জিম্বাবুয়ে ঠিক কি করতে চাইছিল সেটা অবশ্য আমার বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের রান ১৫০ ছুঁয়েছে ঠিক একারণেই। সিলি থিংকিং!
তাসকিন হ্যাড এ হিউজ ইম্প্যাক্ট ইন দিজ গেইম! কিন্তু বাংলাদেশ মূলত ম্যাচ জিতেছে মুস্তাফিজের ওই প্রথম ওভারে। রাজাসহ দুই উইকেট! ব্যাকবোন ব্রেকার! অবশ্য জিম্বাবুয়ের গেইমপ্ল্যান নিয়ে আমি এখনও অবাক হচ্ছি, রাজাসহ তাদের টপ অর্ডারদের তাড়াহুড়ো দেখে মনে হচ্ছিল তারা ১৮০ চেইজ করতে চাচ্ছে! অথচ, ইট ওয়াজ দেয়ার গেইম টু লুজ!
চারটা জেনুইন বোলার! ১৫০ রান ডিফেন্ড করার জন্য যথেষ্ট প্রমানীত হয়ে গেল! ক্রিকেট মাঝে মাঝে অপার্থিব ঘটনা দেখায়, জাস্ট ব্যাখ্যা নেই! একটা গোঁজামিল ব্যাখ্যা অনেকটা এমন হতে পারে যে, ট্রিকি স্কোর চেইজে টপ অর্ডার প্যানিক করেছে! অথচ এমন ভরাডুবির ভেতর দাঁড়িয়েও দিব্যি সাঁতার কেটে গিয়েছেন বার্ল, শনরা! টপ অর্ডার অমন গর্দভী আচরন না করলে কুলেও হয়ত পৌঁছে যেত জিম্বাবুয়ের ক্যানু! এট দ্য এন্ড, ঠু মাচ হেভি ফর দেম!
জয় যেহেতু এসেছে, তাকে সাদরে বরণ করাই শ্রেয়। তবে অমবশ্যার এই চাঁদ থেকে জোৎস্না না খুঁজে, চলুন একটু আঁধার হাতরে পথচলা শিখি। পরাজয় থেকে কথিত শিক্ষা তো অনেক নিলাম, এবার একটু জয় থেকেও শিক্ষা খুঁজি।
এমন একটা ডু অর ডাই ম্যাচে চার বোলার কেন? একটা বিশ ওভারের ম্যাচে ৮ জন ব্যাটসম্যান নিয়ে নেমে প্রতিপক্ষ বোলারদের ঠিক কি মেসেজ দেয়া হচ্ছে? আমরা ভলনারেবল, জাস্ট তুলে নাও! সাতে না হলে সত্তরেও হবে না ৯০% ক্ষেত্রে, এটুকু বোঝার সক্ষমতা টিম ম্যানেজমেন্টের নেই! টসে জিতে ব্যাটিং করার প্ল্যান বানানো একটি দল চার বোলার নিয়ে ডিফেন্ড করবে, এমন আদিভৌতিক চিন্তাভাবনা কিভাবে আসে? ডিফেন্ড করতে চাওয়া একটা দল কেন তাদের বোলিং স্যাক্রিফাইস করবে? পার্টটাইমার শেষ ওভারে ডিফেন্ড করছে, আমাদের ক্রিকেটের কততম ঘটনা এটা!
পার্টটাইমারের শেষ ওভারের আলাপে সাকিবের ক্যাপ্টেন্সি উঠে আসে! অনেকেই দেখলাম ক্যাপ্টেনকে কাঠগড়ায় তুলে দিচ্ছে! নো ম্যান, সাকিব ডিড এক্স্যাক্টলি হোয়াট ওয়াজ নিডেড টু বি ডান! এক্সিলেন্ট ক্যাপ্টেন্সি আই মাস্ট সে!
৫ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা জিম্বাবুয়ের সামনে পঞ্চম বোলারের কোটা পূরণ করার সুযোগ ছিল! কিন্তু, সেটা বরং আরও বেশি বুমেরাং হতে পারত! খেলা শেষ ওভারে যাবে এমন চিন্তাভাবনা ওই মূহুর্তে কেন করবে একজন অধিনায়ক? সাকিব জিম্বাবুয়ের শেষ প্রতিরোধে পুশ করেছে, এবং সেটাই সঠিক। লাগাতার স্ট্রাইক বোলার শাফল করে উইকেটের পেছনে ছুটেছে! অল ক্রেডিট গোজ টু বার্ল এন্ড উইলিয়ামস! তারা ওয়েট করেছে, শেষ একটা এক্সিলারেশনের আশায়! হয়ত ওই ম্যাজিক্যাল রান আউটটা না হলে জিম্বাবুয়েই জিতে যেত, কিন্তু তাতেও সাকিবের এটাকিং ক্যাপ্টেন্সির সমালোচনা করা যেত না। বরং বল এবং ব্যাট হাতে সাকিবের নির্জীব ভাবটা নিয়ে কথা বলা যায়!
ফর্ম এবং শক্তিমত্তার বিচারে একটা জয় আশা করেছিলাম। দুটো এসেছে, কোয়াইট হ্যাপি রাইট নাউ। তবে, এই জয়ের তরিকা সঠিক নয়। এই জয়কে কোনভাবেই পরবর্তী বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে ভাবা যায় না। ব্যাটিং অর্ডার, সিলেকশন, মূল প্রস্তুতির ব্যাপার তো এইগুলোই। এমনকি পজিটিভ কিছু সিদ্ধান্তে পরাজয় এলেও বরং স্যাটিসফাইং হত।
ভারতের আজকের পরাজয়ে গ্রুপ বেশ খুল্লামখুল্লা! সাউথ আফ্রিকা নেদারল্যান্ডসের সাথে জিতবে ধরে নিলে তারা সেমিতে অলরেডি চলে গিয়েছে! ভারত যদি জিম্বাবুয়ে বা বাংলাদেশের সাথে পা ফসকায় তাহলে বিদায়টা তাদেরও হতে পারে। বাংলাদেশের পরবর্তী দুই প্রতিপক্ষ পাকিস্তান এবং ভারত! মজার ব্যাপার হল, এই দুটো দলই প্রচণ্ড চাপ নিয়ে তাদের পরবর্তী ম্যাচগুলোতে মাঠে নামবে! আই অ্যম নট হোপিং দ্যাট ফার, কিন্তু চাপে ভাঙতে দেখেছি অনেক হেভিওয়েটকেও। চাপটাকে পুজি করে বাংলাদেশ একটা হার্ড টাইম যদি তাদের উপহার দিতে পারে, তাহলে সেটাই হবে এই দলটার সফল বিশ্বকাপ মিশন!
জয়, পরাজয় মুখ্য নয়, অতদূর ভাবারও দরকার নেই। জাস্ট একটা টি-টোয়েন্টি দল হিসেবে নিজেদের সামর্থ্যকে আর এক ধাপ সামনে নেয়ার এই সুযোগটা কাজে লাগাক! হাজারো সমালোচনার তীর, অসংখ্য বিতর্ক ছাপিয়ে পুরুষ ক্রিকেট দল সত্যিকারের পৌরষিক বেশে ঘরে ফিরুক!