ক্রিকেটের টিকেটে দারিদ্রতা জয়

জ্যামাইকার এই তরুণের সামনে সুযোগ ছিল ট্রাক অ্যান্ড ফিল্ডে উসাইন বোল্টের উত্তরসূরী হওয়ার। পড়াশোনাতেও মন্দ ছিলেন না, চাইলেই যোগ দেবার সুযোগ ছিল সেনাবাহিনীতেও। অবশ্য পরবর্তী জীবনে তিনি এখনো সৈনিকই হতে চান। কিন্তু ছোটবেলার স্কুলশিক্ষক তাঁর ছক্কা হাঁকানোর প্রকৃতিপ্রদত্ত দক্ষতা দেখে ক্রিকেটার হবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ভাগ্যিস রোভম্যান পাওয়েল তাঁর শিক্ষকের কথা শুনেছিলেন, নইলে ক্যারিবীয় ধূসর জার্সিতে তাঁর বিশাল সব ছক্কা আমরা মুগ্ধ নয়নে কি করে উপভোগ করতে পারতাম। 

ছোটবেলায় ক্রিকেটের প্রতি রোভম্যানের আলাদা এক আকর্ষণ কাজ করতো। কত রাতের পর রাত তিনি পার করেছেন দাদার সাথে স্বর্ণালি যুগের ক্যারিবীয় গ্রেটদের গল্প শুনে। ব্রায়ান লারার শৈল্পিক ব্যাটিং দেখেই ব্যাটসম্যান হবার বাসনা জাগে। স্বপ্ন দেখেন লারার মতোই ব্যাট হাতে বিশ্ব শাসন করার। দারিদ্র্যের মাঝেই বসবাস রোভম্যানের পরিবারের। ছোটবেলাতেই তাই দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাত খুব কাছে থেকেই দেখেছেন। জ্যমাইকার কিংস্টনে সাগরপাড়ে তাঁদের দুই রুমের ছোট্ট বাড়ি।

বাড়ি না বলে কুটির বলাই ভালো, বৃষ্টির দিনগুলোতে যে পানি আটকাতে পারতো না সেই ছাদ। রোভম্যানের মা উদয়ান্ত পরিশ্রম করতেন দুবেলার খাবার জোগাতে। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময়েই বুঝতে পারেন এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে তাঁর হাতে দুটো পথ খোলা আছে – হয় পড়ালেখায় মনপ্রাণ দিতে হবে, নইতো খেলাধুলায় প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভাটা কাজে লাগাতে হবে।

পাওয়েল তাঁর মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন পরিবারের এই দুর্দশা তিনি দূর করবেন। রোভম্যান সেই প্রতিজ্ঞা রেখেছেন, পেশাদার ক্রিকেটের প্রথম উপার্জন দিয়েই মাকে বাড়ি কিনে দিয়েছেন। গাড়ি কিনে দিয়েছেন নামিদামি ব্র্যান্ডের। মা যখন গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরেন, অজানা প্রশান্তিতে ভালো লাগা কাজ করে রোভম্যানের। দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেতে ইচ্ছে করে ছোটবেলার দুর্বিসহ সেসব স্মৃতি। 

ক্রিকেটে আসার সিদ্ধান্তটা সহজ ছিল না রোভম্যানের জন্য। ক্রিকেট ব্যাট কিংবা প্যাড কিনবার সামর্থ্য সেসময় ছিল না তাঁর পরিবারের। রোভম্যান অবশ্য ভেবে রেখেছিলেন ক্রিকেটে সফল হতে না পারলে ফিরে যাবেন লেখাপড়াতেই। সে সময়টাতে তিনি স্পোর্টস স্কলারশিপ নিয়ে পড়ালেখা করছিলেন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্ট ইন্ডিজে। 

 রোভম্যানের বেড়ে উঠার সময়টাতে জ্যামাইকার পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। প্রায়ই হতো বন্দুকযুদ্ধ, মাদক চোরাচালানের যুক্ত ছিল বেশিরভাগ কিশোর। তারই আরেক সতীর্থ ওশানে থমাসের ভাইই যেমন মারা গিয়েছিলেন বন্দুকযুদ্ধে। পাওয়েলকে সেই পরিস্থিতির মাঝে দিয়ে যেতে হয়নি, জ্যামাইকার যে অংশে তিনি থাকতেন সেই অংশটা নিরাপদই ছিল।

‘আমার পরিবার, শিক্ষক, বন্ধু এবং তাঁদের পরিবার সবাই সাহায্য করেছেন সঠিক পথে চলতে। নিজের স্বপ্ন পূরণের দৌড়ে তাঁরা সবাই একটু একটু করে এগিয়ে দিয়েছেন আমাকে।’, নিজের সম্প্রদায়ের প্রতি এভাবেই কৃতজ্ঞতা জানান রোভম্যান। 

বিশ্বসেরা সব ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের অ্যাথলেটরা উঠে এসেছেন জ্যামাইকা থেকে। উসাইন বোল্ট, এলেইন থম্পসন, শেলী অ্যান ফ্রেজার, আসাফা পাওয়েল, ইয়োহান ব্লেকরা নিজেদের দক্ষতা দিয়ে মুগ্ধ করেছেন বিশ্ববাসীকে। হাই স্কুলে থাকাকালীন রোভম্যান ভালোভাবেই টিকে ছিলেন জ্যামাইকা থেকে উঠে আসা পরবর্তী ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড স্পেশালিস্ট হিসেবে। কিন্তু তাঁর দৌড়ের কোচ কার্লটন সোলানের এক পরামর্শে বদলে যায় তাঁর জীবন।

স্মৃতিচারণা করে পাওয়েল বলেন, ‘তিনি আমাকে বেশ কয়েকদিন ক্রিকেট খেলতে দেখেছিলেন। একদিন ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের ট্রেনিং শেষ  হবার পর তিনি আমাকে ডাকেন আর পরদিন থেকে ট্রেনিং এ আসতে নিষেধ করেন। তাঁর কথা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলেন ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড তোমার জায়গা নয়, তুমি ক্রিকেটে মনোযোগী হও।’

স্মৃতিচারণ করেন পাওয়েল। পাওয়েলকে ক্রিকেটে উৎসাহিত করতে ভূমিকা রেখেছিলেন আরেকজন ব্যক্তি। মহেন্দ্র সিং ধোনির যেমন ছিলেন ছোটু ভাইয়া, তেমনি রোভম্যানের জীবনে ছিলেন ভিনসেন্ট রাসেল। প্রথম ব্যাট কিনে দেয়া থেকে শুরু করে ক্লাব ক্রিকেটে সুযোগ করে দেয়া – ক্রিকেট ক্যারিয়ারে রোভম্যানের জীবনের সব প্রথমের সূচনা ভিনসেন্তের হাত ধরে।

ভিনসেন্টই প্রথম তাঁকে স্থানীয় এক বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট খেলতে নিয়ে যান। তাঁর ক্রমাগত উৎসাহ আর অনুপ্রেরণাতেই ক্রিকেটে লেগে থাকার সাহস পান রোভম্যান। তাঁর জীবনে প্রভাব আছে আরেকজন রাসেলেরও, তাঁকে অবশ্য সবাই চেনেন। হ্যাঁ, আন্দ্রে রাসেল – বিশ্বক্রিকেটের আরেক বিস্ময়। রাসেলকে রোভম্যান চিনতেন সেই স্কুল ক্রিকেটের সময় থেকেই। জাতীয় দলেও দুজনে কাধে কাঁধ মিলিয়ে সামনে বইয়ে নিয়ে যান ক্যারিবীয় ঝান্ডা। কৈশোরেই একপর্যায়ের রোভম্যান বুঝতে পারেন তাঁর আর রাসেলের বেড়ে উঠার গল্পটা একই।

পাওয়েল বলেন, ‘দুজনের মাঝে মিল সম্পর্কটাকে আরো সহজ করে তোলে। আন্দ্রে রাসেল আমার জীবনের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একজন  মানুষ। ক্রিকেটের প্রতি ওর আত্ননিবেদন আর পরিশ্রম আমি দেখেছি, দেখেছি ওর যাত্রাপথের পুরো যাত্রা। ওর ক্রমাগত উন্নতি দেখে আমি আত্নবিশ্বাস পেয়েছি, আমার মতো শূন্য থেকে শুরু করে ওর যাত্রাটা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। ও পারলে আমি কেন নয়, আমিও পরিশ্রমের মাত্রাটা বাড়িয়ে দিয়েছি।’

২০১৫ সালে সিপিএলে দল পাবার আগের বছর রাসেল এবশ কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁকে যেগুলো পরবর্তীতে ভীষণ কাজে এসেছিল রোভম্যানের। ২৩ বছর বয়সে এসে প্রথম বড় সাফল্যের দেখা পান পাওয়েল। সিপিএলের ড্রাফটে চল্লিশ হাজার ডলারের বিনিময়ে তাঁকে দলে ভেড়ায় জ্যামাইকা তাল্লাওয়াহস।

মূলত রাসেলের উত্তরসূরী হিসেবে জাতীল লিগে তাঁর পারফরম্যান্স দেখেই তাঁকে দলে ভিড়িয়েছিল দলটি। সেবারের লিগে পাঁচ ইনিংসে ৪৭ গড়ে রান করেন পাওয়েল। জ্যামাইকার হয়ে সেবার সিপিএলের সবগুলো ম্যাচে সুযোগ পান তিনি। সুযোগটা কাজে লাগিয়েছিলেন দুহাত ভরে, দলকে চ্যাম্পিয়ন করার দৌড়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। বিশ্ববাসী গর্জন শুনেছে নতুন এক মারকুটে ব্যাটারের আগমণের।

দারু পারফর্ম করার সুবাদে তিনি নজরে আসেন আইপিএলের স্কাউটদের। নিলাম থেকে ৪২ হাজার ডলারে তাঁকে দলে ভেড়ায় কলকাতা নাইট রাইডার্স। সেবারের নিলামের তিনিসহ মাত্র দুজন আনক্যাপড  ক্রিকেটার দল পেয়েছিলেন। এর এক মাস পরই অবশ্য আরব আমিরাতে পাকিস্তানের  বিপক্ষে ক্যারিবীয়দের হয়ে অভিষেক ঘটে তাঁর। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শুরুতে মানিয়ে নিয়ে বেশ সমস্যা হয়েছে তাঁর।

পেস বোলিংটা দারুণ খেললেও স্পিনের বিপক্ষে দুর্বলতা ছিল পাওয়েলের। বিশেষ করে লেগস্পিনের বিরুদ্ধে তাঁকে ভুগতে হয়েছে ভীষণ। দলগুলোও তাঁর দুর্বলতা বুঝতে পেরে সেভাবেই পরিকল্পনা সাজাতো। ‘আমি এক তরুণকে দেখতে পাচ্ছি যে খুবই অপ্রস্তুত। খুব ভালো জানি না তাঁর ব্যাপারে, জোরে মারার দারুণ দক্ষতা আছে তাঁর মাঝে। প্রতিভাবান কিন্তু টেকনিকের দিক থেকে সে খুবই দুর্বল।’ তাঁর ব্যাপারে বলেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কিংবদন্তী এবং ধারাভাষ্যকার ইয়ান বিশপ। 

২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত রোভম্যানের খেলা ১৮ টি টোয়েন্টির মাঝে ১৫টিই খেলেছিলেন উপমহাদেশের দলগুলোর বিপক্ষে। ফলে স্পিনের বিপক্ষে তাঁর দুর্বলতা আরো বাজেভাবে ধরা পড়ছিলো। ২০২১ সালে ভারত সফরে পাঁচ ওডিয়াই আর এক টি টোয়েন্টি খেলে সংগ্রহ করেন মাত্র ৬৫ রান। মাঝেমাঝে আলো ছড়ালেও ধারাবাহিকভাবে ভালো করার কোনো লক্ষণ ছিল না তাঁর ব্যাটিং এ। ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পরেন রোভম্যান। 

জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার সময়টাতে নিজের ব্যাটিং নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন পাওয়েল। স্পিনের বিপক্ষে উন্নতি করার জন্য এশিয়াতে আরো বেশি ম্যাচ খেলতে শুরু করেন। পিএসএল, টি টেনের মতো ফ্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর নিয়মিত মুখ হয়ে উঠেন। লংকা প্রিমিয়ার লিগে ক্যান্ডি ওয়ারিহর্সের হয়ে খেলেন ১৯ বলে ৬১ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। একই সময়ে কিয়েরন পোলার্ড ইনজুরির কারণে পাকিস্তান সফরের দল থেকে বাদ পড়লে পুনরায় ডাক পান পাওয়েল। যদিও সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেননি, তিন ম্যাচে করেন মাত্র ৩৩ রান। 

ধারাবাহিক হতে না পারলেও স্পিনের বিপক্ষে দুর্বলতা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছিলেন তিনি। স্বয়ং ইয়ান বিশপ জানিয়েছিলেন তাঁর উন্নতির কথা, ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন অচিরেই ব্যাট হাতে বড় ইনিংসের দেখা পাবেন পাওয়েল। ২৬ জানুয়ারি, ২০২২। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেদিন সেরা ফর্মের পাওয়েলেকে দেখা গিয়েছিল। ইংলিশ বোলারদের পিটিয়ে ছাতু করে খেলেছিলেন ১০৭ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস। এই ম্যাচের পর আর পাওয়েলের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস করেননি কেউই, ওয়েস্ট ইন্ডিজের পরবর্তী ২০ টি টোয়েন্টির প্রতিটিতেই মাঠে নেমেছেন তিনি। 

দারুণ পারফর্ম করার সুবাদে সে বছরের আইপিএল নিলামে তাঁকে দলে ভেড়াতে আগ্রহী প্রকাশ করে প্রায় সব দলই। ২.৮০ কোটি রুপির বিনিময়ে শেষপর্যন্ত তাঁকে দলে ভেড়াতে সক্ষম হয় দিল্লী ক্যাপিটালস। দিল্লীর কোচ কিংবদন্তি রিকি পন্টিং এর অধীনে নিজের ব্যাটিং আরো শাণিত করেন পাওয়েল। নিজের দামের প্রতি সুবিচার করেন ব্যাট হাতে পারফরম্যান্স নিয়ে, ১২ ম্যাচে ১৫০ স্ট্রাইকরেটে সংগ্রহ করেন ২৫০ রান। 

তাঁর ব্যাটিং এ উন্নতির বড় দাবিদার রবার্ট স্যামুয়েলস, সাবেক ক্যারিবীয় ক্রিকেটার মারলন স্যামুয়েলসের ভাই। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই পাওয়েলের ব্যাটিং পরামর্শক তিনি। যখনই তিনি কোনো সমস্যায় পড়তেন, রবার্টের কাছে ছুটে যেতেন। এছাড়াও বার্বাডোসের জাতীয় একাডেমিতে ফ্লয়েড রেইফারের সাথেও ব্যাটিং নিয়ে কাজ করেছেন পাওয়েল। বিশপ পাওয়েলের সবচেয়ে ভালো গুণ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জানান পাওয়েল কথা বলার সময় কোনো রাখডাক রাখেন।

মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে, সিনিয়ক হোক জুনিয়র ভুল করতে সবার সামনেই তা প্রকাশ করেন পাওয়েল। তাঁর নেতৃত্বেই খর্বশক্তির এক দল নিয়েও এই বছরের সিপিএল জিতে নিয়েছে জ্যামাইকা তাল্লাওয়াহস। মাঠ এবং মাঠের বাইরে পুরো দলকে এক সুতোয় গেঁথে রাখেন পাওয়েল। ২০২১ বিশ্বকাপের পর ক্যারিবীয় দল থেকে সরে যান কিয়েরন পোলার্ড, সুনীল নারাইন, আন্দ্রে রাসেলদের মতো অভিজ্ঞরা। নতুনদের বিজয় কেতন উড়ানোর নতুন মিছিলে সহ অধিনায়ক নির্বাচিত হন পাওয়েল।

বিশপ বিশ্বাস করেন পাওয়েলদের হাত ধরেই পুরনো রূপে ফিরবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট। ফিরে পাবে হারানো ঐতিহ্য। ওল্ড হারবার থেকে উঠা আসা এক তরুণ যে স্বপ্ন দেখতো পরিবারকে মুক্ত করবে দারিদ্র্যের হাত থেকে , সে স্বপ্ন পূরণের পর এখন তাঁর কাঁধেই বর্তেছে পুরো ক্যারিবীয়ানের ভার বহনের দায়িত্ব।   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link