গোঁফের নিচে রক্ষীর হাসি

কিরমানিকে চাইলে আপনি অভিনেতাও বলতে পারেন। হিন্দি, কন্নড়, মালায়ালাম - ভারতের তিনটি ভাষার ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি বরাবরই অভিনেতা হতে চাইতাম। পর্দায় আমার টাকমাথাটা কেমন দেখায় - বুঝতে চাইতাম!’ বুঝুন অবস্থা!

গলি ক্রিকেটে ইটকে গ্লাভস বানিয়ে উইকেটকিপিং করা ছোট্ট এক বালক ভারতের হয়ে জাতীয় দলে উইকেটকিপিংয়ের স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্ন তো পূরণ করলেনই, নিজেকে নিয়ে গেলেন সেরাদের কাতারে। মহেন্দ্র সিং ধোনি আসার আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন টেস্টে ভারতের হয়ে সবচেয়ে বেশি ডিসমিসালের মালিক!

১৯৮৩ বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ী ভারত দলের অন্যতম একজন সদস্য ছিলেন তিনি। গলি ক্রিকেটে ইট দিয়ে কিপিং করা ওই ছোট্ট বালক পরবর্তীতে ভারতীয় ক্রিকেটে অন্যতম সেরা উইকেটকিপার হিসেবে নিজেকে রেখে গিয়েছিলেন!

হ্যাঁ, নামটা সৈয়দ কিরমানি। যিনি ভারতের হয়ে টেস্টে বর্তমানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডিসমিসালের মালিক, আজো! টাক মাথা, বিশাল এক গোফ – যেন পর্দার সুসজ্জিত এক ভিলেন – যার রুঢ় হাসিতে ভীতি সৃষ্টি হয়!

কিরমানি নামে পাকিস্তানের আরো একজন গ্রেট ক্রিকেটার ছিলেন। নাম সৈয়দ জহির আব্বাস কিরমানি। আশির দশকের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান পরিচিত অবশ্য শুধু জহির আব্বাস নামে। অবশ্য দলে দুই কিরমানির ভূমিকাটাও আলাদা। ভারতীয় উইকেটকিপার সৈয়দ কিরমানি টেস্টে ১৯৮ টি ডিসমিসাল করেছেন। পরবর্তীতে সেই রেকর্ড গুড়িয়ে সাবেক ভারতীয় কাপ্তান মহেন্দ্র সিং ধোনি ৩০০ ডিসমিসাল করেন!

নিজের স্কুল মাইশোরের হয়ে ইংল্যান্ড সফরে সুযোগ পান একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে। ১৯৬৭ সালে ইন্ডিয়ান স্কুল ক্রিকেট ট্যুরে মাইশোরের হয়ে খেলেন তিনি। জুনিয়র লেভেলে নজরকাঁড়া পারফরম্যান্স করায় দলে জায়গা পেয়েছিলেন তিনি। সেখানে কিপিংয়েও দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন তিনি।

এরপর ১৯৭১ সালে ইংল্যান্ড সফরে তৃতীয় উইকেটর হিসেবে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডাক পান কিরমানি। ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার ও পচিয়াহ কৃষ্ণামূর্তি দলে থাকায় পুরো সিরিজেই তিনি ছিলেন উপেক্ষিত। সুযোগ পাননি এক ম্যাচেও। এর পাঁচ বছর পর ১৯৭৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষিক্ত হন কিরমানি। দলে তখনকার নিয়মিত মুখ ফারুখ ইঞ্জিনিয়ারকেই টপকে দলে জায়গা করে নেন কিরমানি। তবে, সেবার নিউজিল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুই সিরিজেই ব্যাট হাতে বেশ হতাশাজনক পারফরম করেন তিনি।

তবে উইকেটের পেছনে ছিলেন দুর্দান্ত। অভিষেক সিরিজেই কিরমানির ক্রাইস্টচার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে পাঁচ ক্যাচ ও এক স্টাম্পিংয়ে মোট ৬ ডিসমিসাল করে ভারতের হয়ে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ডিসমিসালের রেকর্ড গড়েন। যদিও পরবর্তীতে এই রেকর্ডে ভাগ বসান মহেন্দ্র সিং ধোনি ও ঋদ্ধিমান সাহা।

১৯৭৯ সালে মুম্বাইয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের ষষ্ঠ টেস্টে নাইটওয়াচম্যান হিসেবে নেমে ক্যারিয়ারে মেইডেন সেঞ্চুরি করেন কিরমানি! প্রথম দিনের শেষ সময়ে সুনীল গাভাস্কার আউট হওয়ায় নাইটওয়াচম্যান হিসেবে আসেন কিরমানি। ওইদিন ৩ উইকেটে ২৩১ রান নিয়ে দিনশেষ করে ভারত।

পরের দিন ব্যাট করতে নেমে ক্যারিয়ারে মেইডেন সেঞ্চুরির দেখা পান কিরমানি। ওই ইনিংসে ১০১ রান করেন তিনি। অবাক করা ব্যাপার হলো কিরমানি তাঁর ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ও শেষ সেঞ্চুরির দেখাও পেয়েছিলেন সেই মুম্বাইতেই!

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মেইডেন সেঞ্চুরির ৫ বছর পর ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে আট নম্বরে নেমে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করেন তিনি। ওই ইনিংসে ১০২ রান করেন তিনি। মাঝে ১৯৭৯ বিশ্বকাপের আগে বোর্ডের নিষেধ অমান্য করে অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়া টাইকুন হিসেবে পরিচিত ক্যারি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটে (ডব্লিউএসসি) খেলতে যাওয়ায় ১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপ ও ইংল্যান্ড সফর থেকে বাদ পড়েন কিরমানি! তাঁর বদলি দলে সুযোগ পেয়েছিলেন ভারত রেড্ডি ও সুরিন্দর খান্না।

ক্যারিয়ারে বাজে সময় থেকে উৎরাতে আবারো ইটকে গ্লাভস বানিয়ে শুরু করেন কঠোর অনুশীলন। উইকেটকিপিং স্কিল ও ফিটনেস বাড়াতে কঠোর সাধনা করে পুনরায় কামব্যাক করেন তিনি। আর উইকেটের পেছনে দলের জন্য হয়ে উঠেন বড় অনুপ্রেরণা।

ভারতের ১৯৮৩ বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের পেছনেও বড় অবদান রয়েছে সৈয়দ কিরমানির। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই বেশ কিছু নজরকাঁড়া ক্যাচ নিয়ে সাবেক ইংলিশ গ্রেট উইকেটরক্ষক গডফ্রে ইভান্সের কাছে বেস্ট উইকেটরক্ষক অব দ্যা টুর্নামেন্ট পুরস্কার জেতেন তিনি।

এরপর ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলেন কিরমানি। পরবর্তীতে কিরণ মোরের কাছে জাতীয় দলে জায়গা হারান তিনি। এরপর আর জাতীয় দলের সুযোগ পাননি তিনি। তবে, ঘরোয়া ক্রিকেট চালিয়ে যান কিরমানি। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেন তিনি।

টেস্টে ১৬০ ক্যাচের পাশাপাশি ৩৮ বার স্ট্যাম্পিং করেছেন কিরমানি। এছাড়া ব্যাট হাতে ২৭ গড়ে করেছেন ২৭৫৯ রান। অ্যাডাম গিলক্রিস্টের আগের যুগের জন্য ২৭ গড় বেশ ইম্প্রেসিভই ভাবা হতো। এছাড়া ৪৯ ওয়ানডে ম্যাচে ২১ গড়ে ৩৭৩ রান করেন তিনি।

গ্লাভস হাতে করেছেন ৩৬ ডিসমিসাল। ঘরোয়া ক্রিকেটেও তিনি ছিলেন সে সময়ের সেরাদের একজন। ৩০ গড়ে ৯৬২০ রানের পাশাপাশি করেছেন ৪৭৯ ডিসমিসাল! সত্তরের দশকে ঘরোয়া ক্রিকেটে কর্ণাটককে উপরে উঠতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন কিরমানি।

মজার ব্যাপার হল, উইকেটরক্ষক হলেও তিনি বোলিংও করতেন। টেস্টেও বোলিং করেছিলেন। একবার পাকিস্তানের বিপক্ষে এক টেস্টে ম্যাচের ফলাফল ড্রয়ের দিকেই এগোচ্ছিলো। একাদশে থাকা বেশ কয়েকজন ভারতীয় ব্যাটসম্যানও সেদিন বল করছিলেন। সুনিল গাভাস্কারও সেদিন বল করেছিলেন! কিরিমানি ১৮ রানে ব্যাট করা আজিম হাফিজের উইকেট তুলে নেন।

কিরমানি ছিলেন বড্ড ঘুম প্রিয়। নিজের ব্যাটিং আর ফিল্ডিং ছাড়া প্যাভিলিয়ানে থাকাকালীন বাকিরা মাঠে কি করছে সে ব্যাপারে খুব একটা ভাবতেন না তিনি। ভারতের সাবেক কিংবদন্তি ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কার কিরমানির ব্যাপারে নিজের বই আইডলসে এক মজার তথ্য দেন।

সুনীল বলেন, ‘কিরমানি ঘুমাতে পছন্দ করতো। যদি দল (ভারত) ফিল্ডিংয়ে না থাকতো আর কিরমানি ব্যাটিংয়ে না থাকতো তাহলে সে প্যাভিলিয়নে বসে ঘুমাতো। ১৯৭১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে এক টেস্টে ঘুম থেকে তরুন কিরমানিকে ডেকে তুলেন ভারতের ম্যানেজার রাম প্রকাশ মেহরা। আর তাকে বলেন ইংলিশ উইকেটকিপার অ্যালান নটের কিপিং ফলো করতে। এরপর মেহরা সেখান থেকে চলে যাওয়া মাত্রই আবারো ঘুমিয়ে পড়েন কিরমানি! পরবর্তীতে তাঁরই এক সতীর্থ ক্রিকেটার মেহরার কাছে গিয়ে বলেন কিরমানি সাইটস্ক্রিনের কাছে বসে ম্যাচ দেখছে; যাতে করে সবচেয়ে ভাল ভাবে খেলাটা দেখতে পারেন!’

কিরমানিকে চাইলে আপনি অভিনেতাও বলতে পারেন। হিন্দি, কন্নড়, মালায়ালাম – ভারতের তিনটি ভাষার ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি বরাবরই অভিনেতা হতে চাইতাম। পর্দায় আমার টাকমাথাটা কেমন দেখায় – বুঝতে চাইতাম!’

বুঝুন অবস্থা!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...