কেন বিক্রি হচ্ছে ইন্টার মিলান!

গত শতকে ফুটবল পরিবর্তন হয়েছে বিশাল পরিমানে।

এখন ফুটবল আর প্যাশন আর শুধু একটা খেলার মধ্যে আটকে নেই। বরং ফুটবলে প্যাশনের পাশাপাশি দরকার টাকার। ‘গ্যালাক্টিকো’ গড়তে রিয়াল প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ এই শতাব্দীর শুরুতে যা দেখিয়েছিলেন, সেটাই এখন স্বাভাবিক ঘটনা।

দু’হাতে খরচ না করতে পারলে যেন বর্তমান ফুটবলে দলের কোনো মূল্যই নেই। চেলসির আব্রামোভিচ, পিএসজির নাসের-আল খেলাইফি, ম্যানচেস্টার সিটির শেখ মনসুর; দলের ভোলই পালটে ফেলেছেন টাকা খরচ করে। আবার মূদ্রার উলটো পিঠও আছে বৈকি। রোমা-ভ্যালেন্সিয়ার মালিকের অর্থ থাকলেও ক্লাবকে ভেবে বসেছিলেন একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ফলাফল, অর্থ থাকার পরেও ক্লাবের উন্নতি প্রায় শূণ্য।

কিন্তু ইন্টার মিলান কর্তৃপক্ষ একটু আলাদাই ছিল বৈকি। ইন্টার মিলানের মালিকপক্ষ শুরু থেকেই বেশ বড়সর প্ল্যান নিয়ে এগিয়েছিল। সে কারণে ইনভেস্টমেন্টও করেছিল। কিন্তু গত ডিসেম্বরে এসে ক্লাবের মালিক স্টিভেন জ্যাং কনফার্ম করেন যে তারা ক্লাবকে বিক্রি করার চিন্তা ভাবনা করছেন।

মাত্র সাড়ে ৪ বছর আগে ক্লাবের ম্যানেজমেন্টে পরিবর্তনের পর আবার এমন পরিবর্তন বড় ধাক্কা দিয়েছে নেরাজুউরিদের। একসময় স্বপ্ন নিয়ে কেনা ক্লাবকে হঠাৎই কেন বিক্রির চিন্তা আসলো কর্তৃপক্ষের মাথায়? তাঁর আগে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।

২০০৯ সালে পুরো বিশ্বে যখন অর্থনৈতিক মন্দা ধাক্কা দেয় তখন সবচেয়ে বড় প্রভাব পরেছিল ইউরোপে। ইতালি, স্পেনের মত দেশগুলো একপ্রকার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এই ধাক্কায়। এসি মিলান, ইন্টার মিলানের মতন পুরোনো একক মালিকানাধীন ক্লাবগুলোর উপর দিয়েও সেই ঝড় বয়ে গিয়েছে। মালিকের লস মানেই দলের লস, সে হিসেবে মিলানের বড় দুই ক্লাবের মালিক, বার্লুসকোনি পরিবার ও মোরাত্তি পরিবার তাদের ক্লাবের একট বড় অংশ বিক্রির চিন্তাভাবনা শুরু করতে থাকে।

গত দশকের মাঝামাঝি এসে ইউরোপীয়ান ফুটবলে নজর পরতে থাকে চাইনিজ কোম্পানিদের। সেই সময়ে ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন ক্লাব কিনতে শুরু করে কোম্পানিগুলো। আর সেই সময়েই ইন্টারকে কিনতে সারা দেয় চাইনিজ কোম্পানি ‘সুনিং গ্রুপ’। তাদের কাছে মালিকানার ৭০ শতাংশ বিক্রি করে তারা। শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালে হংকংভিত্তিক ইনভেস্টমেন্ট ফার্ম ‘লায়নরক ক্যাপিটাল’এর কাছে বাকি ৩০ শতাংশও বিক্রি করে দেয় তারা। নতুন মালিকের অধীনে আস্তে আস্তে উঠে আসতেও শুরু করে ইন্টার।

ফুটবল দুনিয়ায় শুধু পয়সা থাকলেই খেলাতে ভালো করা সম্ভব হয়ে উঠে না। বরং তার সাথে দরকার প্রপার প্ল্যানিং আর টাকা পয়সার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। ‘সুনিং গ্রুপ’ শুরু থেকেই এই ব্যাপারে পারদর্শী। এমনকি কোম্পানির শেয়ার না থাকার পরেও মোরাত্তি ফ্যামিলি মেম্বারদের বোর্ডে জায়গা দিয়েছে তাঁর। কারণ তারা জানেন, ফুটবল শুধু টাকার নয়, অভিজ্ঞতারও খেলা। গত ৪ বছরের মধ্যেই চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রবেশ করতে পেরেছে ইন্টার। অ্যান্তোনিও কন্তের অধীনে জুভেন্টাসের বিপক্ষে স্কুদেত্তোর জন্যও ফাইট দিচ্ছে তারা।

কিন্তু সে অবস্থা যে আর বেশিদিন থাকছে না। জানুয়ারির মাঝামাঝিই খবর রটেছে, এই ৭০% মালিকানা বিক্রি করে দিয়ে উদ্যত হয়েছে ‘সুনিং গ্রুপ’। ইন্টার মিলান খুজছে তাদের নতুন মালিক। গত দশকের মাঝমাঝি ফুটবলে চাইনিজ মানি ঢুকবার পর থেকে সবচেয়ে ভালোভাবে রান করা ক্লাব ছিল ইন্টার। দলের মালিকের দলের প্রতি ভালোবাসাও ছিল চোখে পরার মতন। তবে কী কারণে এমন সময়ে ক্লাব বিক্রি করতে উঠেপরে লেগেছে তারা?

উত্তরটা খুবই সোজা, তাদের সরকার। সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণায় চলে চাইনিজ সরকারের কাছে গরিব ধনী সকলেই সমান। তাদের নিত্যনতুন নিয়মে তারা ক্লাব বিক্রি করতেই বাধ্য হচ্ছে। চীনে অনেক আগে থেকেই ইউরোপে ব্যবসা খোলার ক্ষেত্রে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এখন তা আরো প্রবল হয়েছে।

‘সুইনিং গ্রুপ’ দায়িত্ব নেবার এক থেকে দেড় বছর পরেই কিন্তু চাইনিজ সরকার নতুন এক নিয়ম করেছিল, যাতে করে ইউরোপে ইনভেস্ট করতে হলে তাঁর সমান পরিমাণ অর্থ তাদের দেশীয় খাতেও ইনভেস্ট করতে হতো কিংবা সরকারি কোষগারে দিতে হতো। অর্থাৎ যা ইউরোপে বিনিয়োগ করতে হতো তার সমান দেশেও দিতে হতো। এক কথায় ডবল খরচ। যে কারণে তারা চাইলেই বেশি করে ইনভেস্ট করতে পারতো না। তবুও বেশ কিছু ফাঁকফোকর দেখে ঠিকই নিজেদের ব্যবসা ও ক্লাব চালিয়ে গিয়েছে তারা। পরিকল্পনায় হয়তো বাঁধা পরেছিল, যেমনটা চাচ্ছিল তেমনটা ঠিক হচ্ছিল না। কিন্তু দল ঠিক পথেই এগুচ্ছিল।

কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনার বিপর্যয়ের পর চাইনিজ সরকার আবার নতুন নিয়ম করেছে। দেশের এই সময়ে বিদেশে ইনভেস্টমেন্ট করতে আরো কড়াকড়ি আরোপ করেছে। আগের নিয়মকে পাশ কাটাতে ‘সুইনিং গ্রুপ’ চায়নিজ লিগে জিয়াংশু সুনিং নামে একটি ক্লাবও খুলেছিল। যারা গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়নও হয়েছে। তাদের ক্লাবে ইনভেস্ট করে ইন্টারে ইনভেস্ট করতে বেশ সুবিধা হতো। কিন্তু এবছর থেকে ক্লাবের ইনকামের উপরে আরো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে চাইনিজ সরকার। যে কারণে তাদের চাইনিজ দল থেকে লাভ্যাংশও কমেছে বহুগুণে। চাইনিজ ফুটবল লিগে ক্লাবের নামের পাশে মালিকানা প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহারও নিষিদ্ধ করেছে তারা। সবমিলিয়ে এক হযবরল অবস্থায় পরেছে সুইনিং গ্রুপ।

সবমিলিয়ে এখন ইন্টার মিলানের জন্য ইনভেস্টমেন্ট করা বেশ কঠিন হয়ে পরেছে তাদের জন্য। যেহেতু তারাই বেশিরভাগ অংশের মালিক, সেহেতু তাদের উপরেই দলের দায়ভার বেশী। আর সেটি করতেই হিমশিম খাচ্ছে তারা। এই মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে কেনা রাইট ব্যাক আশরাফ হাকিমির পুরো মূল্য চুকাতে পারেনি তারা। বরং রিয়ালের কাছে সময় চেয়েছে তাদের অর্থ কিস্তিতে পরিশোধ করার জন্য। যে কারণে নতুন বছরেরর শুরুতেই ক্লাব মালিক স্টিভেন জ্যাং নতুন খেলোয়াড়ের বদলে নতুন মালিক খুজছিলেন। হাজার হলেও ক্লাবের প্রতি মায়া জন্মে গিয়েছে। অন্য সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো না দেখে ক্লাবকে ক্লাব হিসেবেই দেখেছেন তিনি। তাই এই সময়ে ধরে না রেখে বিক্রির চিন্তা ভাবনা করছেন তিনি।

বর্তমান বাজারে ইন্টারের স্টক প্রায় ১.২৫ বিলিয়ন ডলারের কাছেকাছি। কোভিড-১৯ এর কারণে সব ক্লাবের স্টকই কমতির দিকে। ২০২২ সালে ‘সুনিং গ্রুপ’এর ৪৫৬ মিলিয়ন ডলারের স্টক বন্ডের মেয়াদ শেষ হবে। তার আগেই বেশি দামে বিক্রির চিন্তা ভাবনা চালাচ্ছে তারা। সেদিকে সারাও দিয়েছে ব্রিটিশ ইনভেস্টমেন্ট ফার্ম ‘বিসি পার্টনার্স’। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এই মৌসুমের শেষেই নতুন মালিক পেতে চলেছে মিলানের পুরোনো ক্লাবটি।

ফুটবলে হঠাৎ করে চাইনিজ মানির আগমণ শুরু হলেও তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে দ্রুতই। পার্মা, এসি মিলানকে কিনেও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে চাইনিজ কোম্পানিগুলো। সাউদাম্পটন, ওয়েস্ট ব্রমকে বিক্রির জন্য কথাবার্তা চলছে। সবমিলিয়ে ফুটবলে হঠাৎ করে আসা চাইনিজ মানি হঠাৎ করেই লোপ পেতে শুরু করেছে। ইন্টার মিলানও সেই পথই ধরেছে। তবে ইন্টার সমর্থকদের জন্য সান্তনা এটুকুই যে অন্যসব ক্লাবের মতন তাদের অথৈ সাগরে ফেলে দিয়ে যায়নি ‘সুনিং গ্রুপ’!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link