আয়েশি আভিজাত্যের আগ্নেয়গিরি

প্রায় দুই দশক ধরে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং দিয়ে দর্শকদের নির্মল ক্রিকেটীয় বিনোদনের খোরাক যুগিয়ে গেছেন তিনি। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি আলোচনায় এসেছেন হাস্যকর সব রানআউট দিয়েও। ক্যারিয়ার জুড়ে কত যে বিচিত্র সব উপায়ে তিনি রানআউট হয়েছেন অথবা সতীর্থদের ডাকে ঠিকমত সাড়া না দিয়ে রানআউট করিয়েছেন; তার কোন হিসেব নেই। ইনজির রানআউট নিয়ে একটা মজার কৌতুক প্রচলিত ছিল, ‘তাঁর অধিকাংশ রান আউটের ক্ষেত্রেই আম্পায়াররা একটু সংশয়ে ভুগতেন। কারণ তাঁদের দেখতে হত কে আউট হয়েছেন, ইনজামাম না অপর ব্যাটসম্যান!’

১.

১৯৯২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে মুখোমুখি পাকিস্তান ও স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড। জিততে হলে শেষ ১৫ ওভারে পাকিস্তানের প্রয়োজন ১২৩ রান। আস্কিং রানরেট ওভারপ্রতি ৮ এরও উপরে! এমন অবস্থায় দলের হাল ধরতে ৬ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিজে নামলেন ২২ বছরের প্রায় ‘অখ্যাত’ এক তরুণ! নাম তাঁর ইনজামাম উল হক যে কিনা তখনও পর্যন্ত টুর্নামেন্টের একটা ম্যাচেও বলার মত কোন পারফরম্যান্স উপহার দিতে পারেনি।

পরামর্শ ও অনুপ্রেরণার জন্য তরুণ এই ব্যাটসম্যান পাশে পেলেন অভিজ্ঞ মিয়াঁদাদকে। মিয়াঁদাদ নিলেন ধরে খেলার ব্রত, দ্রুত রান তোলার দায়িত্বে মারমুখী ইনজামাম। এতক্ষণ বেশ ধীর লয়ে চলা পাকিস্তান ইনিংসের রান তোলার চাকায় যেন হঠাৎ গতি এল। স্লো উইকেট, আস্কিং রেট, মাঠভর্তি দর্শক, প্রতিপক্ষের হোমগ্রাউন্ড কিংবা উইকেটে গিয়ে থিতু হওয়া এসব কোন কিছুর বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে সেদিন শুরু থেকেই কিউই বোলারদের উপর চড়াও হয়েছিলেন ইনজামাম। উইকেটের চারপাশে অনায়াসে খেলছিলেন দারুণ সব শট! তাঁর পাল্টা আক্রমণে হঠাৎ করেই যেন খেই হারিয়ে ফেলল কিউই বোলিং আক্রমণ।

চাপকে জয় করে চরম উত্তেজনার মুহুর্তেও চোখ ধাঁধানো সব স্ট্রোকের পসরা সাজিয়ে ইনজামাম খেলেছিলেন দারুণ সাহসী এক ইনিংস! ইনজামামের তান্ডবে সবচেয়ে বড় ঝড়টা বয়েছিল ক্রিস হ্যারিস আর অফ স্পিনার দীপক প্যাটেলের উপর দিয়ে। আগের ৮ ওভার বল করে মাত্র ২৮ রান দিয়ে ১ উইকেট নিয়েছিলেন প্যাটেল। কিন্তু শেষ ২ ওভারে দিলেন আরো ২২ রান! আর পুরো টুর্নামেন্টে দারুণ নিয়ন্ত্রিত বোলিং করা হ্যারিস সেদিন যেন হারিয়ে খুঁজছিলেন নিজেকে! ১০ ওভারের স্পেলে খরচ করেছিলেন ৭২ রান!

ম্যাচের ৪৫ তম ওভারে দলীয় ২২৭ রানের মাথায় হ্যারিসের দুর্দান্ত থ্রোতে রান আউটের খাঁড়ায় কাটা পড়েন ইনজামাম। নিউজিল্যান্ডের বোলারদের পিটিয়ে তুলাধুনো করে ৭ চার ও ১ ছয়ে মাত্র ৩৭ বলে ৬০ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস খেলে ইনজামাম যখন বিদায় নিলেন ততক্ষণে ম্যাচ পাকিস্তানের হাতের মুঠোয়।

ওয়াসিম আকরাম (৮ বলে ১০) আর মঈন খানের (১১ বলে ২০*) ছোট কিন্তু কার্যকরী দুটো ‘ক্যামিও’ ইনিংসের কল্যাণে আর জাভেদ মিয়াঁদাদের দৃঢ়তায় (৬৯ বলে ৫৭*) শেষ পর্যন্ত ৬ বল বাকি থাকতেই ৪ উইকেটের সহজ জয় তুলে নেয় পাকিস্তান। অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলে দলকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে তোলায় ম্যাচ সেরার পুরস্কার ওঠে ইনজামামের হাতে।

আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে ম্যাচের সমস্ত হিসাব নিকাশ পাল্টে দেয়া ইনজামামের ইনিংসটা হয়ত খুব বেশি বড় নয়। ৩৭ বলে ৬০ রান, স্ট্রাইক রেট ১৬২.৬! কেবল বিশ্বকাপের আসরেই এর চেয়েও দ্রুতগতির, এর চেয়েও বিস্ফোরক ইনিংস আরও অনেক আছে। তবে নব্বই দশকের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে ৭ বাউন্ডারি ১ ছক্কায় ইনজামামের সেই ইনিংসটা ছিল নিঃসন্দেহে বিশেষ কিছু! মার্টিন ক্রোর ৯১ রানের অসাধারণ ইনিংসকেও ম্লান করে দেয়া ইনজামামের ওই ‘স্পেশাল’ নকটাই যে পাকিস্তানকে ফাইনালের টিকিট পাইয়ে দিয়েছিল। এরপর ফাইনালেও খেলেন ৩৫ বলে ৪২ রানের ঝকঝকে একটি ইনিংস।

২.

১৯৭০ সালের ৩ মার্চ, পৃথিবীতে এসেছিলেন ’৯২ বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম নায়ক, পাকিস্তান ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তি ও আধুনিক গ্রেটদের একজন ইনজামাম-উল-হক। জন্ম পাঞ্জাব প্রদেশের মুলতানে। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন কিছুটা লাজুক আর শান্ত প্রকৃতির। তবে ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁকটা ছিল প্রবল।

‘ইনজি’ ডাকনামে পরিচিত এই নাদুসনুদুস আরামপ্রিয় ছেলেটিই কালক্রমে একদিন হয়ে উঠল ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান, অন্যতম সেরা ম্যাচ উইনার, দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ও সফল অধিনায়ক।

৩.

ছয় ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা বিশাল বপু ও দশাসই চেহারার অধিকারী, প্রতিভাবান এই ব্যাটসম্যান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তাঁর আগ্রাসী কিন্তু ঠান্ডার মাথার সংযত ব্যাটিং স্টাইলের জন্য।

ক্রিকেটীয় পরিভাষায় একটা কথা প্রচলিত আছে ‘লেজি এলিগেন্স’। ইনজামাম ছিলেন ক্রিকেটের সেই ‘লেজি এলিগ্যান্স’ কিংবা ‘অলস সৌন্দর্যের’ প্রতীক। আয়েশি ভঙ্গিমায় এমনভাবে শট খেলতেন যেন দেখে মনে হত তিনি আগে থেকেই জানতেন বলটা কোথায় পড়বে। প্রতিটা শটের আগে আর্লি পজিশন নিতে পারাটা ছিল তাঁর সহজাত ক্ষমতা।

ইনজামামকে মনে করা হয় পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। পাওয়ার হিটিং নয়; বরং নিখুঁত টাইমিং আর প্লেসমেন্টের উপরই বেশি নির্ভর করতেন তিনি।

ইমরান খানের ভাষায়, ‘পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান। ওকে দেখলে মনে হয়, বল ওর ব্যাটে পৌঁছানোর আগে ও বিস্তর সময় পায়।’

ইনজামামের ব্যাটিংয়ের বিশেষত্ব ছিল দ্রুত বলের লেংথ পড়ে ফেলতে পারার ক্ষমতা, নমনীয় কব্জির নিখুঁত ব্যবহার এবং সাবলীল ফুট মুভমেন্ট। বিশেষ করে লেগ সাইডে ছিলেন ন্যাচারালিই অনেক স্ট্রং। তাঁর প্রিয় শট ছিল পুল। এছাড়া তাঁর আরেকটা পছন্দের শট ছিল লফটেড ফ্লিক।

কেবল ফাস্ট বোলিংই নয়; তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন স্পিনারদের বিপক্ষেও। স্পিনের বিপক্ষে তাঁর সবচাইতে কার্যকরী অস্ত্র ছিল সুইপ শট। প্যাডল সুইপ এবং লেট কাটেও ছিলেন সাবলীল। স্পিনারদের বিপক্ষে কাভারের উপর দিয়ে খেলা ইনজামামের ‘ইনসাইড আউট’ ড্রাইভ ক্রিকেটের সবচাইতে রোমাঞ্চকর ও চিত্তাকর্ষক শটগুলোর একটি।

৪.

টেস্ট ক্রিকেটে ২০০ ইনিংসে ১৬৩৪৫ বল খেলে তিনি করেছেন ৮৮৩০ রান। ব্যাটিং গড় ৪৯.৬০। ২৫ টি শতরানের পাশাপাশি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন ৪৬ টি। আছে ২টা ডাবল আর ১টা ট্রিপল সেঞ্চুরিও। চার মেরেছেন ১১০৫ টি এবং ছক্কা ৪৮ টি। সর্বোচ্চ ইনিংস ৩২৯ রানের, প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড।

একদিনের ক্রিকেটে ৩৫০ ইনিংসে ১৫৮১৩ বল খেলে করেছেন ১১৭৩৯ রান। ব্যাটিং গড় ৩৯.৫৩, স্ট্রাইক রেট ৭৪.২৫। ১০ টি সেঞ্চুরির পাশাপাশি ফিফটি হাঁকিয়েছেন ৮৩টি। চার মেরেছেন ৯৭০ টি এবং ছক্কা ১৪৪ টি। সর্বোচ্চ ইনিংস ১৩৭* রানের, বিপক্ষ নিউজিল্যান্ড।

ইউনুস খান (১০,০৯৯) ও জাভেদ মিয়াঁদাদের (৮৮৩২) পর টেস্ট ক্রিকেটে পাকিস্তানের পক্ষে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। আর ওয়ানডেতে পাকিস্তানের পক্ষে এখনও পর্যন্ত ইনজামামই সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী ব্যাটসম্যান। পাকিস্তানের হয়ে মোট ৩০টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন ইনজামাম। জিতেছেন ১১টি, হেরেছেন ১০টি আর ড্র হয়েছে ৯টি টেস্ট।

ক্যাপ্টেন্সির একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল তাঁর ব্যাটিংয়ে। অধিনায়ক হিসেবে টেস্টে তাঁর ব্যাটিং গড় (৫২.৮৩) ক্যারিয়ার গড়ের (৪৯.৬০) চাইতে তুলনামূলক বেশি। ওয়ানডেতেও প্রায় একই অবস্থা। ওয়ানডে ইতিহাসে অধিনায়কের ভূমিকায় সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড়ের অধিকারী ব্যাটসম্যানদের তালিকায় এবি ডি ভিলিয়ার্স (৬৫.৯২) ও মহেন্দ্র সিং ধোনির (৫৩.৯৩) ঠিক পরের স্থানটিতেই আছেন ইনজামাম-উল-হক (৪৩.৮৯)।

ওয়ানডে ক্যারিয়ারে বেশিরভাগ সময় ব্যাট করেছেন পাঁচ নম্বরে। এই পজিশনে অন্তত ১০০ ইনিংস খেলা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ইনজামামের গড়ই সবচেয়ে বেশি। তিনি পাঁচ নম্বরে ব্যাট করেছেন মোট ১০৫ ইনিংসে। ৪১.৮৪ গড়ে করেছেন ৩৪৭৩ রান। শচীন টেন্ডুলকার (৯৬), কুমার সাঙ্গাকারা (৯৩) ও জ্যাক ক্যালিসের (৮৬) পর ওয়ানডে ইতিহাসে সর্বাধিক ফিফটির মালিক ইনজামাম-উল-হক (৮৩)।

শচীন টেন্ডুলকারের পর ওয়ানডেতে ১০,০০০ রানের মাইলফলক অতিক্রমকারী দ্বিতীয় ব্যাটসম্যানের নাম ইনজামাম উল হক।

ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশিবার রান আউট হওয়া ব্যাটসম্যানের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছেন শ্রীলংকার মারভান আতাপাত্তু (৪১ বার)। ঠিক তারপরেই দ্বিতীয় স্থানে আছেন ইনজামাম-উল-হক (৪০ বার)! ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশিবার স্টাম্পড হওয়া ব্যাটসম্যানের তালিকাতেও রিকি পন্টিং এবং ওয়াসিম আকরামের (দুজনেই ১৫ বার করে) পর দ্বিতীয় স্থানে আছেন ইনজামাম-উল-হক (১২ বার)।

৫.

ওয়ানডে কিংবা টেস্ট যেকোন ফরম্যাটেই ইনজামাম ছিলেন একজন জেনুইন ম্যাচ উইনার। তাঁর ছিল একা হাতে ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা। ওয়ানডেতে ২৫ বার আর টেস্টে ৯ বার জিতেছেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার।

পাকিস্তান জিতেছে এমন টেস্ট ম্যাচগুলোতে ইনজামামের সংগ্রহ ৪৬৯০ রান, ব্যাটিং গড় ৭৮.১৬! সেঞ্চুরি ১৭টি, ফিফটি ২০ টি। জেতা ম্যাচে কমপক্ষে ৪০০০ রান করেছেন এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ইনজামামের চেয়ে বেশি গড় আছে কেবল স্যার ডোনাল্ড ব্র‍্যাডম্যানের। অস্ট্রেলিয়া জিতেছে এমন ম্যাচগুলোতে ব্র‍্যাডম্যান করেছেন ৪৮১৩ রান; ১৩০.০৮ গড়ে। আর ৭৮.১৬ গড় নিয়ে ব্র‍্যাডম্যানের ঠিক পরেই অবস্থান করছেন ইনজামাম উল হক!

এতো গেল জেতা ম্যাচে ব্যাটিং গড়ের হিসাব। কেবল দেশের মাটিতে জয় পাওয়া ম্যাচগুলো হিসাব করলেও ব্র‍্যাডম্যানের ঠিক পরেই থাকবেন ইনজামাম উল হক। দেশের মাটিতে জেতা ২১ টেস্টে ব্র‍্যাডম্যানের গড় ১৫২.৭৭! ঠিক তার পরেই আছেন ২০ টেস্ট জেতা ইনজামাম; ব্যাটিং গড় ৯৪.৪২!

ম্যাচ জয়ী টেস্টে সেঞ্চুরি সংখ্যায় প্রথম ৫ ব্যাটসম্যানের মধ্যে ৪ জনই অস্ট্রেলিয়ান। অস্ট্রেলিয়ার বাইরে মাত্র একজনই আছেন; তিনি হলেন ইনজামাম উল হক। রিকি পন্টিং (২৬), স্টিভ ওয়াহ (২৫), ডন ব্র‍্যাডম্যান (২৩) ও ম্যাথু হেইডেনের (২১) পর ১৭ টি সেঞ্চুরি নিয়ে তালিকার ৫ম স্থানে অবস্থান করছেন ইনজি।

৬.

মুলতানের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে হাতেখড়ি; মাত্র ১৫ বছর বয়সে। এরপর ঘরোয়া ক্রিকেটে মাঠ মাতিয়েছেন ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড, ফয়সালাবাদ, রাওয়ালপিন্ডি ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের হয়ে। ১৯৯১ সালের নভেম্বরে, দেশের মাটিতে ইনজামামের ওয়ানডে অভিষেক; মাত্র ২১ বছর বয়সে।

লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে অভিষেক ম্যাচে মাত্র ২০ রান করে আউট হলেও সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছিলেন পরের ম্যাচেই; খেলেছিলেন ৬০ রানের দারুণ একটি ইনিংস। ফয়সালাবাদে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচেই ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত বল হাতে নিয়েছিলেন ইনজি আর প্রথম বলেই পেয়েছিলেন উইকেট! যেনতেন উইকেট নয়, ইনজি আউট করেছিলেন ব্রায়ান লারাকে!

এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে চার ইনিংসে দুই সেঞ্চুরি ও দুই ফিফটিসহ তুলে নেন ৩২৬ রান। ফলে তাঁর বিশ্বকাপের দলে সুযোগ পাওয়াটা একরকম অবধারিতই ছিল। ক্যারিয়ারের প্রথম ৬টি একদিনের ম্যাচে ইনজামামের সংগ্রহ ছিল যথাক্রমে ২০, ৬০, ৪৮, ৬০, ১০১ ও ১১৭ রান। ব্যাটিং গড় ৬৭.৬৭, স্ট্রাইক রেট ৮৭.৬৩!

১৯৯২ বিশ্বকাপটা ছিল ইনজামামের ক্যারিয়ারের অন্যতম প্রধান টার্নিং পয়েন্ট। কেননা ওই টুর্নামেন্টের আগে ইনজিকে সেভাবে কেউ চিনত না। বিশ্বকাপের রাউন্ড রবিন লিগে ইনজামামের পারফরম্যান্স ছিল বেশ হতাশাজনক। ৮ ম্যাচে ১৫.৩৭ গড়ে করেছিলেন মাত্র ১২৩ রান! তবুও অধিনায়ক ইমরান খান আস্থা রেখেছিলেন ২২ বছরের প্রতিভাবান এই তরুণের ব্যাটিং সামর্থ্যের ওপর। কেননা ইমরান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, মুলতানের এই ছেলেটি যেকোন মুহূর্তে ম্যাচের রঙ বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।

বিশ্বকাপ অভিষেকেই ইনজামাম-উল-হকের উত্থানটা ছিল অনেকটা রূপালি পর্দার নায়কদের মত। সেমিফাইনাল ও ফাইনালের মত ‘গুরুত্বপূর্ণ’ দু’টি ম্যাচে অমন অসাধারণ ‘দুটো’ ইনিংস দিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সেই পেয়ে যান ন্যাশনাল হিরোর খেতাব।

১৯৯২ সালের জুনে এজবাস্টনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক। তবে অভিষেকে বলার মত কিছুই করতে পারেন নি তিনি। বরং বলা ভাল, কিছু করার সুযোগই পান নি তিনি। এক ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে অপরাজিত থাকেন ৮* রানে।

১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ড সফরের একমাত্র টেস্ট ম্যাচটা পাকিস্তান জিতেছিল ৩৩ রানে। ইনজামাম পেয়েছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট ফিফটি (৭৫)। ১৯৯৩ সালের ২৭ মার্চ প্রথমবারের মত ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়ানডে জয়ের স্বাদ পায় পাকিস্তান। সে ম্যাচে ১০৪ বলে অপরাজিত ৯০ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন ইনজামাম।

১৯৯৩ সালের মার্চ-এপ্রিলে উইন্ডিজ সফরে ইনজামাম পেয়ে যান তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। অ্যান্টিগায় সিরিজের তৃতীয় টেস্টে ইনজির ব্যাট থেকে এসেছিল ১২৩ রানের স্ট্রোক ঝলমলে এক ইনিংস।

১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচটা ছিল সিরিজ নির্ধারণী। বৃষ্টির কারণে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটা নেমে এসেছিল ৪০ ওভারে। ইনজামামের ৯৪ বলে অপরাজিত ৮০ রানের অনবদ্য এক ইনিংসের সৌজন্যেই সিরিজ জিতেছিল পাকিস্তান।

১৯৯৪ সালের নিউজিল্যান্ড সফরের দ্বিতীয় টেস্টে ইনজামাম করেছিলেন অপরাজিত ১৩৫* রান। ওই ইনিংসে ভর করেই একই সাথে ম্যাচ ও সিরিজ জয় নিশ্চিত করেছিল পাকিস্তান।

নিউজিল্যান্ড সফরের ওয়ানডে সিরিজটাও ছিল দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। তৃতীয় ম্যাচে ইনজামাম খেলেছিলেন ৮৮ রানের লড়াকু এক ইনিংস। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান মাত্র ১১ রানে ম্যাচটা হেরে গেলেও ‘ম্যাচ সেরার’ পুরস্কারটা পেয়েছিলেন ইনজি।

১৯৯৪ সালের এপ্রিলে শারজায় অনুষ্ঠিত অস্ট্রেলেশিয়া কাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১৫ বাউন্ডারিতে সাজানো ১২৯ বলে অপরাজিত ১৩৭ রানের মনোমুগ্ধকর এক ইনিংস। পাকিস্তান জিতেছিল ৬২ রানে।

১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করাচীতে টেস্ট ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংসটি খেলেছিলেন ইনজি। চতুর্থ ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার দেয়া ৩১৫ রানের টার্গেট পাকিস্তান চেজ করেছিল মাত্র ১ উইকেট হাতে রেখে। ২৩৬ রানে ৮ উইকেট পড়ার পর টেইলএন্ডারদের সাথে নিয়ে বাকি কাজটুকু সেরেছিলেন ইনজামাম। শেষ উইকেটে মুশতাক আহমেদকে নিয়ে যোগ করেছিলেন ৫৭ রান; খেলেছিলেন ৮৯ বলে অপরাজিত ৫৮ রানের ‘চাপকে জয় করা’ আত্মবিশ্বাসী এক ইনিংস।

টেস্ট ম্যাচে চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়া করে জেতা সবসময়ই কঠিন। তার ওপর টেইলএন্ডারদের সাথে জুটি বেঁধে এক প্রান্ত আগলে রেখে দ্রুত রান তোলার কাজটা তো আরও কঠিন। সেই ‘কঠিন’ কাজটাই ‘সহজে’ করতে পারাটাকে এক সময় অভ্যাসে পরিণত করেছিলেন ইনজি।

একই বছর অক্টোবরে দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত উইলস ট্রায়াঙ্গুলার সিরিজে ৩ ফিফটিতে ইনজামাম করেছিলেন ২৪০ রান। রাওয়ালপিন্ডিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১১ চার ও ৩ ছক্কায় সাজানো ৮০ বলে ৯১ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলেছিলেন ইনজি; পাকিস্তান পেয়েছিল ৯ উইকেটের দাপুটে এক জয়।

১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় আয়োজিত ‘নেলসন ম্যান্ডেলা ট্রফি’তে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পাকিস্তান একটি ‘লো স্কোরিং’ ওয়ানডে জিতেছিল মাত্র ১২ রানে। সে ম্যাচে ইনজামামের ব্যাট থেকে এসেছিল ৬৮ বলে ৬২ রানের ‘ক্রুশাল’ একটি নক।

১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জিম্বাবুয়ে সফরের সিরিজ নির্ধারণী তৃতীয় ও শেষ টেস্টে ইনজামামের ৮৩ ও ১০১ রানের ‘ক্ল্যাসিক’ দুটো ইনিংসের সৌজন্যেই ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতেছিল পাকিস্তান।

এরপর ওয়ানডে সিরিজেও অব্যাহত ছিল ব্যাট হাতে ইনজামামের দাপট। হারারেতে ১১৬ রানের দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করে দলকে বাঁচিয়েছিলেন সিরিজ পরাজয়ের হাত থেকে (১-১ ব্যবধানে ড্র হয়েছিল)।

১৯৯৫ সালের এপ্রিলে শারজায় অনুষ্ঠিত চার জাতি এশিয়া কাপের তিন ম্যাচে ৯৫.০ গড়ে ইনজামাম করেছিলেন ১৯০ রান। পাকিস্তান অবশ্য ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয়েছিল সেবার।

১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজের শ্বাসরুদ্ধকর এক ম্যাচে মাত্র ১ উইকেটের ব্যবধানে হেরে যায় সফরকারী পাকিস্তান। দল হারলেও ৯৫ বলে ৮০ রানের লড়াকু এক ইনিংস খেলে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন ইনজামাম উল হক।

১৯৯৫ সালে প্রথমবারের মত আইসিসি টেস্ট র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থানে উঠেছিলেন ইনজামাম উল হক। টেস্ট ক্যারিয়ারে সর্বমোট তিন বার র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষে উঠেছেন তিনি। অবসরের আগ পর্যন্ত সবসময় টেস্ট র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষ ১৫ জন ব্যাটসম্যানের মধ্যেই অবস্থান ছিল ইনজামামের।

১৯৯৬ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপটা অবশ্য তেমন ভাল যায় নি ইনজির। ৪৮.৩৩ গড়ে করেছিলেন ১৪৫ রান; ৬ ম্যাচ খেলে মাত্র একটিতে পেয়েছিলেন ফিফটির দেখা। ১৯৯৬ সালের ইংল্যান্ড সফরটা ইনজামামের ক্যারিয়ারে একটি উজ্জ্বলতম অধ্যায় হয়ে থাকবে। স্মরণীয় এই সিরিজের হাইলাইটস ছিল ইংলিশ কন্ডিশনে সুইংয়ের বিপক্ষে ইনজির সামর্থ্য প্রমাণের প্রদর্শনী।

ওই সিরিজে ৫ ইনিংসে ব্যাট করে ৬৪.০০ গড় ইনজির সংগ্রহ ছিল ৩২০ রান। পাকিস্তান সিরিজ জিতেছিল ২-০ ব্যবধানে। ব্যাট হাতে ইনজামামের সেরা পারফরম্যান্সটা এসেছিল লর্ডসের মাটিতে। তাঁর ১৪৮ ও ৭০ রানের দুটো ‘মাস্টারক্লাস’ ইনিংসের সৌজন্যেই সহজ জয় পেয়েছিল পাকিস্তান।

১৯৯৭ সালের নভেম্বরে দেশের মাটিতে আয়োজিত টেস্ট সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করেছিল পাকিস্তান। পেশোয়ার ও রাওয়ালপিন্ডিতে প্রথম দুই ম্যাচে ইনজামামের ব্যাট থেকে এসেছিল ৯২ ও ১৭৭ রানের অসাধারণ দুটি ‘ম্যাচ উইনিং’ নক।

১৯৯৮ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ আফ্রিকার কিম্বার্লিতে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজের এক ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলেছিলেন ১১০ বলে অপরাজিত ১১৬* রানের অসাধারণ একটি ম্যাচজয়ী ইনিংস। একই বছর সেপ্টেম্বরে কানাডার টরন্টোতে ভারতের বিপক্ষে ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজটা ৪-১ ব্যবধানে জিতেছিল পাকিস্তান। দুই ফিফটিসহ ৫৮.৫ গড়ে ২৩৪ রান করে সিরিজ সেরা নির্বাচিত হয়েছিলেন ইনজামাম উল হক।

১৯৯৯ সালের মার্চে ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ‘ডাবল সেঞ্চুরি’ হাঁকিয়েছিলেন ইনজামাম উল হক। ৩৯৭ বল খেলে ২৩ চার ও ২ ছক্কায় অপরাজিত ছিলেন ২০০ রানে। পাকিস্তান জিতেছিল এক ইনিংস ও ১৭৫ রানে।

এপ্রিলে শারজায় অনুষ্ঠিত তিন জাতি কোকাকোলা ট্রফিতে ভারতের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১১৫ বলে ১০৭ রানের যথারীতি আরও একটি ম্যাচজয়ী ইনিংস। ১৯৯৯ বিশ্বকাপটা তেমন ভাল যায় নি ইনজামামের জন্য। ৯ ইনিংসে মাত্র দু’টিতে পেয়েছিলেন ফিফটি; ৩১.৭৫ গড়ে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ২৫৪ রান। পাকিস্তান হয়েছিল রানার্সআপ।

একই বছর নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিল পাকিস্তান। হোবার্টের বেলেরিভ ওভালে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ইনজি খেলেছিলেন ১১৮ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। কিন্তু জাস্টিন ল্যাঙ্গার (১২৭) আর অ্যাডাম গিলক্রিস্টের (১৪৯) জোড়া সেঞ্চুরিতে ম্লান হয়ে যায় ইনজামামের কীর্তি।

ইনজামামের ওই ইনিংসটাতে একটা লক্ষণীয় ব্যাপার ছিল দুর্দান্ত ‘রানিং বিট্যুইন দ্য উইকেট’। দৌড়ে ৩ রানই নিয়েছিলেন ৯ বার! ইনজির ‘স্বভাববিরুদ্ধ’ সেই ইনিংস প্রসঙ্গে উইজডেন লিখেছিল, ‘ইনজামাম দৌড়েছেন, দৌড়েছেন আর কেবলই দৌড়েছেনই। ওর ১১৬ রানের অপরাজিত ইনিংসে ছিল নয়টি তিন রান আর ১২ টি চার।’

২০০০ সালের মার্চে করাচি টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৮৬ ও ১৩৮ রান করে ‘ম্যাচ সেরা’ হয়েছিলেন ইনজামাম। পাকিস্তান জিতেছিল ২২২ রানে। একই মাসে শারজায় বসেছিল তিন জাতি কোকাকোলা ট্রফির আসর। ভারতের বিপক্ষে ইনজামামের ব্যাট থেকে এসেছিল আরও একটি ম্যাচ উইনিং হান্ড্রেড (১১৩ বলে ১২১*)। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ফাইনালেও ৫৩ রানের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইনিংস খেলে পাকিস্তানের শিরোপা জয়ে রেখেছিলেন বড় অবদান।

২০০০ সালের এপ্রিলে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়েকে নিয়ে আয়োজিত একটি ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল পাকিস্তান। ৭ ম্যাচে ৪ ফিফটিতে ৫৯ গড়ে ৩৫৪ রান করে সিরিজসেরার পুরস্কার জিতেছিলেন ইনজামাম।

একই বছর মে মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে গায়ানা টেস্টে ১৩৫ এবং শ্রীলংকার বিপক্ষে গল টেস্টে ১১২ রানের আরও দুটো ‘ম্যাচ উইনিং’ নক খেলেন তিনি।

২০০১ সালে নতুন বছরটা শুরু করেছিলেন সেঞ্চুরি দিয়ে। ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১৩৫ রানের দারুণ একটি ইনিংস। এপ্রিলে শারজায় অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজের পাঁচ ম্যাচ থেকে ইনজামামের সংগ্রহ ছিল ৩ ফিফটিসহ ২৯০ রান। শ্রীলংকার বিরুদ্ধে ফাইনালে পাকিস্তান হেরে গেলেও সিরিজসেরা হয়েছিলেন ইনজামাম।

এরপর মে মাসে ইনজামাম গিয়েছিলেন ইংল্যান্ড সফরে। ওল্ড ট্র‍্যাফোর্ড টেস্টের দুই ইনিংসে ১১৪ ও ৮৫ রানের দুটো ‘ক্যারিশম্যাটিক’ ইনিংস খেলে দলকে এনে দিয়েছিলেন ১০৮ রানের অবিস্মরণীয় এক জয়। এছাড়া এজবাস্টনে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৯৫ বলে ৭৯ রান করে জিতিয়েছিলেন দলকে।

২০০১ সালের নভেম্বরে শারজায় অনুষ্ঠিত খালিজ টাইমস ট্রফিতে শ্রীলংকার বিপক্ষে ১২৪ বলে ১১৮ রানের ইনিংস খেলে দলকে দারুণ এক জয় উপহার দিয়েছিলেন তিনি। ২০০২ সালের এপ্রিলে শারজায় অনুষ্ঠিত ট্রায়াঙ্গুলার সিরিজে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৬৮ রান করে হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা।

২০০২ সালের মে মাসে লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে সফরকারী নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হাঁকিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম ও একমাত্র ট্রিপল সেঞ্চুরি। যার সুবাদে পাকিস্তান জিতেছিল এক ইনিংস ও ৩২৪ রানের বিশাল ব্যবধানে। হানিফ মোহাম্মদের ( ৩৩৭) পর মাত্র দ্বিতীয় পাকিস্তানি হিসেবে টেস্টে ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকানোর এ কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন ইনজামাম-উল হক (৩২৯)।

ইনজামাম তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময়টা কাটিয়েছেন ২০০৩ বিশ্বকাপে। ৬ ম্যাচে ৩.১৭ গড়ে করেছিলেন মাত্র ১৯ রান! পাকিস্তানও বাদ পড়ে গিয়েছিল গ্রুপ পর্ব থেকেই।

২০০৩ সালের ঐতিহাসিক মুলতান টেস্টের কথা মনে আছে? যে টেস্টে একাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন ইনজামাম; তাঁর ‘অতিমানবীয়’ এক ইনিংসের কাছেই হারতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য পাকিস্তানের টার্গেট ছিল ২৬১ রান, হাতে সময় প্রায় আড়াই দিন। লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ১৬৩ রানেই ৭ উইকেট হারিয়ে ফেলে পাকিস্তান। ঠিক তখনই টেইল এন্ডারদের নিয়ে শুরু হয় ইনজামামের লড়াই। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের পথে ‘একমাত্র’ কাঁটা হয়ে দাঁড়ান তিনি। ষোলকোটি বাংলাদেশিকে কাঁদিয়ে অপরাজিত ১৩৮ রানের অনবদ্য একটি ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়ে তবেই মাঠ ছেড়েছিলেন ‘সুলতান অব মুলতান’।

মুলতান টেস্টে পাওয়া ফর্মটাকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজেও। ৫ ম্যাচে ৩ ফিফটিসহ করেছিলেন ২৩৮ রান। একই বছর ডিসেম্বরে ওয়েলিংটন টেস্টে নিউজিল্যান্ডের দেয়া ২৭৭ রানের টার্গেট ৭ উইকেট হাতে রেখেই অনায়াসে চেজ করেছিল পাকিস্তান; ইনজামামের ৮৮ বলে অপরাজিত ৭২ রানের আক্রমণাত্মক ইনিংসের সৌজন্যে।

২০০৪ সালের মার্চে দেশের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজটা ছিল তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। ভারত জিতেছিল ৩-২ ব্যবধানে। আর ৫ ম্যাচে ২ সেঞ্চুরিসহ ৬৮.০ গড়ে ৩৪০ রান করে সিরিজসেরা হয়েছিলেন ইনজি।

করাচিতে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ভারতের দেয়া ৩৫০ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে গিয়ে অল্পের জন্য মাত্র ৫ রানে হেরে যায় পাকিস্তান। ইনজামাম তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসটি উপহার দিয়েছিলেন সম্ভবত ওইদিনই।

১২ চার ও ৩ ছক্কায় সাজানো ১০২ বলে ১২২ রানের ‘মাস্টারক্লাস’ ইনিংসটা যারা দেখেছে কেবল তারাই বলতে পারবেন সেদিন ব্যাট হাতে কতটা সাবলীল ছিলেন ইনজি। একই বছর অক্টোবরে করাচিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৬ উইকেটে জয়ী টেস্টে ইনজামামের ব্যাট থেকে এসেছিল ১১৭ রানের আরেকটি দুর্দান্ত ইনিংস।

২০০৫ সালের মার্চে ফিরতি সফরে ভারত গিয়েছিল পাকিস্তান। মোহালিতে সিরিজের প্রথম টেস্টে দুই ইনিংসে ‘জোড়া ফিফটি’ পেয়েছিলেন ইনজামাম। প্রথম ইনিংসে ৫৭ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১০ রানে ৩ উইকেট পড়ার পর ‘কাউন্টার অ্যাটাক’ স্টাইলে ইনজামাম খেলেছিলেন ১০৪ বলে ৮৬ রানের একটি ‘ম্যাচ সেভিং’ ইনিংস। ইনজির ওই ইনিংস সম্পর্কে ক্রিকইনফোতে লিখেছিল, ‘যেকোনো কিছুর বিপক্ষেই তিনি ছিলেন দয়ামায়াহীন। এমনকি ভাল বলগুলোকেও বাদ রাখছিলেন না।’

ব্যাঙ্গালুরুতে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচটা ছিল ইনজামামের ক্রিকেট জীবনের শততম টেস্ট। দুই ইনিংসে ইনজির ব্যাট থেকে এসেছিল ১৮৪ ও অপরাজিত ৩১* রান। ইনজির অসাধারণ ব্যাটিং নৈপুণ্যেই সে ম্যাচে ভারতকে ১৬৮ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়েছিল সফরকারীরা। তিন টেস্টের সিরিজে ৮০.২০ গড়ে ইনজামামের সংগ্রহ ছিল ৪০১ রান।

কলিন কাউড্রে, অ্যালেক স্টুয়ার্ট, গর্ডন গ্রিনিজ ও জাভেদ মিয়াঁদাদের পর ইতিহাসের ৫ম ব্যাটসম্যান হিসেবে শততম টেস্টে শতক হাঁকানোর অবিস্মরণীয় এই কীর্তি গড়েন ইনজামাম। একই বছর জুনে জ্যামাইকার কিংস্টনে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ১৩৬ রানের ব্যবধানে জেতা টেস্টের দুই ইনিংসে ইনজামামের অবদান ছিল ৫০ ও অপরাজিত ১১৭* রান।

২০০৫ সালের নভেম্বরে দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডকে ২-০ ব্যবধানে হারায় পাকিস্তান। ফয়সালাবাদে অনুষ্ঠিত তিন ম্যাচ সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত ইনজামাম পেয়েছিলেন জোড়া সেঞ্চুরির (১০৯ ও ১০০*) দেখা। ওই ম্যাচেই জাভেদ মিয়াঁদাদের ২৩ সেঞ্চুরির রেকর্ড ভেঙে দিয়ে দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন ইনজামাম। ২ সেঞ্চুরি আর ৩ ফিফটিসহ ১০৭.৭৫ গড়ে ৪৩১ রান তুলে ওই সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও হয়েছিলেন ইনজি।

টেস্ট সিরিজ শেষে একই বছর ডিসেম্বরে হয়েছিল ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ। ২-২ সমতায় থাকা সিরিজটার নিষ্পত্তি হয়েছিল শেষ ম্যাচে। রাওয়ালপিন্ডিতে সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে ইনজামামের অপরাজিত ৮১ রানের সৌজন্যেই সেবার ইংলিশদের হারিয়ে সিরিজ জিতেছিল পাকিস্তান। ২০০৫ সালটা ছিল ইনজামামের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সেরা সময়।

৮ টেস্টের ১৫ ইনিংসে ৮৩.৩৩ গড়ে করেছিলেন ১০০০ রান। ৪টা সেঞ্চুরির সাথে ফিফটি ছিল ৬টি। সে বছর একই সাথে আইসিসি বর্ষসেরা টেস্ট একাদশ এবং আইসিসি বর্ষসেরা ওডিয়াই একাদশ’ দুটো দলেই জায়গা পেয়েছিলেন তিনি।

২০০৬ সালের জুলাইতে লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জোড়া ফিফটি (৬৯ ও ৫৬*) হাঁকানোর মধ্য দিয়ে অনন্য এক রেকর্ডের জন্ম দেন ইনজামাম। ২০০১ সালের মে থেকে ২০০৬ সালের জুলাই পর্যন্ত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টানা ‘৯ ইনিংসে’ ফিফটি করার গৌরব অর্জন করেছিলেন তিনি। টেস্টে নির্দিষ্ট কোন দলের বিপক্ষে একটানা সবচেয়ে বেশি অর্ধশতক হাঁকানোর রেকর্ড এটাই।

২০০৬ সালে পেশোয়ারে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে ইতিহাসের তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিকেটের অদ্ভুত আইন ‘অবস্ট্রাকটিং দ্য ফিল্ডের’ শিকার হয়েছিলেন ইনজামাম উল হক।

২০০৭ সালের জানুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পোর্ট এলিজাবেথ টেস্টে ৭ নম্বরে নেমে ইনজামাম উপহার দিয়েছিলেন অপরাজিত ৯২* রানের একটি ‘ক্রুশাল’ নক। ০-১ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তান সিরিজে সমতা আনতে সমর্থ হয়েছিল খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেয়া ওই ইনিংসটির কল্যানেই।

২০০৭ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচটিই ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে। রঙিন পোশাকের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শেষবারের মত ব্যাটিংয়ে নেমে খেলেছিলেন ২ চার ও ৩ ছয়ে সাজানো ৩৫ বলে ৩৭ রানের বিনোদনদায়ী এক ইনিংস। শেষ ইনিংসে আউট হয়ে ড্রেসিংরুমে ফেরার পথে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তিনি।

২০০৭ বিশ্বকাপটা পারলে স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে চাইতেন ইনজি! আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে লজ্জাজনক বিদায়, কোচ বব উলমারের রহস্যজনক মৃত্যু! হত্যা নাকি আত্মহত্যা, তা নিয়ে অনেক তদন্ত, জিজ্ঞাসাবাদ, জল্পনাকল্পনা, সমালোচনা – সব মিলিয়ে যেন এক দুঃস্বপ্ন।

২০০৭ সালের অক্টোবরে লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটা খেলেন ইনজি। ওই টেস্টে ইনজামামের সামনে একটা সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল মিয়াঁদাদকে টপকে পাকিস্তানের পক্ষে সর্বোচ্চ টেস্ট রানের মালিক হওয়ার।

১২ অক্টোবর, ২০০৭। ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট, শেষ ইনিংসে মিয়াঁদাদকে ছুঁতে ইনজির প্রয়োজন ছিল ৬ রান। ব্যক্তিগত ৩ রানের মাথায় হঠাৎ ইচ্ছে হল রেকর্ডটা ভাঙবেন ছক্কা মেরে। বাঁহাতি স্পিনার পল হ্যারিসের বলে ডাউন দ্য উইকেটে মারতে গিয়ে হয়ে গেলেন স্টাম্পড! ফলে মাত্র ৩ রানের জন্য অনেক বড় একটি অর্জন থেকে বঞ্চিত হলেন তিনি।

৭.

ক্রিকেট ছাড়ার পর ইনজামাম বেছে নিয়েছিলেন পেশাদার কোচিং ক্যারিয়ার। ২০১২ সালে কিছুদিন কাজ করেছেন পাকিস্তান জাতীয় দলের ব্যাটিং পরামর্শক হিসেবে। এরপর ২০১৫ সালে আফগানিস্তানের হেড কোচ নিযুক্ত হন তিনি।

ইনজামামের কোচিংয়েই জিম্বাবুয়ের মাটিতে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতে ইতিহাস গড়েছিল আফগানরা। অবশ্য ২০১৬ সালের এপ্রিলেই দলটির হেড কোচের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন ইনজি।  কোচিং ছেড়ে তিনি পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) নির্বাচক পদে যোগ দেন। সাফল্যও পান, পাকিস্তান নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মত জিতে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। তবে, ২০১৯ বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর অনেকের মত ইনজির সাথেও চুক্তির মেয়াদ বাড়ায়নি পিসিবি।

৮.

প্রায় দুই দশক ধরে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং দিয়ে দর্শকদের নির্মল ক্রিকেটীয় বিনোদনের খোরাক যুগিয়ে গেছেন তিনি। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি আলোচনায় এসেছেন হাস্যকর সব রানআউট দিয়েও। ক্যারিয়ার জুড়ে কত যে বিচিত্র সব উপায়ে তিনি রানআউট হয়েছেন অথবা সতীর্থদের ডাকে ঠিকমত সাড়া না দিয়ে রানআউট করিয়েছেন; তার কোন হিসেব নেই।

ইনজির রানআউট নিয়ে একটা মজার কৌতুক প্রচলিত ছিল, ‘তাঁর অধিকাংশ রান আউটের ক্ষেত্রেই আম্পায়াররা একটু সংশয়ে ভুগতেন। কারণ তাঁদের দেখতে হত কে আউট হয়েছেন, ইনজামাম না অপর ব্যাটসম্যান!’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...