সুপ্রাচীনকাল থেকেই সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই একটি নতুন দিনের শুরু হয়। দিনের প্রারম্ভিকা, এরপর প্রত্যুষ থেকে সূর্য যখন মধ্যগগণে, তখন মধ্যাহ্ন হয়। তারপর মধ্যাহ্ন থেকে সূর্যাস্ত পেরিয়ে আঁধার নেমে আসে। তখন হয় রাত্রি।
দিন-রাত্রির এই সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই নৈসর্গিক, প্রাকৃতিক। একজন ক্রিকেটারের জীবনও অনেকটা এই ২৪ ঘন্টার ৮ প্রহর বিশিষ্ট দিনের মতোই। শুরুটা হয় সূর্যোদয়ের মতো। যেখানে অনেকেই তারুণ্যের আভা ছড়িয়ে ধাবিত হন মধ্যগগণে। এরপর সেই গোধূলিলগ্ন। শেষের শুরু।
যা হোক, এবারের আইপিএলে অনেক তরুণ ক্রিকেটারই তারুণ্যের আভা ছড়িয়েছেন। যাদের মধ্যে অনেকে আবার এখন পর্যন্ত ভারতের জার্সি গায়ে চাপাতে পারেননি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখনও রয়েছেন অনভিষিক্ত। খেলা ৭১ মূলত তাদের নিয়েই একটি একাদশ বানিয়েছে, যাদের পা এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পড়েনি, কিন্তু আইপিএলের মতো বড় মঞ্চে নিজের প্রতিভার সাক্ষর দেখিয়েছেন দুর্দান্ত ভাবে। চলুন দেখে নেওয়া যাক।
- প্রভসিমরান সিং (পাঞ্জাব কিংস)
আইপিএলের মঞ্চে সুযোগ পেয়েছিলেন বছর চারেক আগেই। কিন্তু সব মিলিয়ে একাদশে ঠাই মিলেছিল মাত্র ৬ ম্যাচে। তবে এবারের আইপিএল দিয়ে রীতিমত পাদপ্রদীপের আলোয় নিজেকে আলোকিত করেছেন প্রভসিমরান সিং।
পুরো মৌসুমে ২৫.৫৭ গড়ে এ ব্যাটার রান করেছেন ৩৫৮। যার মধ্যে একটি অর্ধশতকের পাশাপাশি ছিল শতকের ইনিংস। তবে প্রভসিমরান মূলত এ আসরে নজর কেড়েছেন তাঁর ১৫০.৪২ স্ট্রাইকরেটের ব্যাটিং দিয়ে। বাঁহাতি এ ব্যাটারের দুর্দান্ত স্ট্রোকমেকিং সক্ষমতা আর ক্ল্যাসিকাল ব্যাটিং অ্যাপ্রোচে— দুটোর ছাপই দারুণভাবে মিলেছে এবারের আসরে।
- যশস্বী জয়সওয়াল (রাজস্থান রয়্যালস)
২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। আর এই জয়সওয়ালই এবারের আইপিএলে নিজের জানান দিয়েছেন দুর্দান্ত ভাবে। পুরো টুর্নামেন্টে ৫ ফিফটি আর ১ সেঞ্চুরিতে ৪৮.০৮ গড়ে করেছেন ৬২৫ রান।
শুধু তাই নয়, বাঁহাতি এ ব্যাটার পুরো আইপিএল কতটা আগ্রাসী ছিলেন তার প্রমাণ মেলে ১৬৩.৬১ স্ট্রাইকরেটের ব্যাটিং। এ ছাড়া এই আইপিএলেই ১৩ বলে ফিফটি হাঁকিয়ে আইপিলের ইতিহাসে দ্রুততম ফিফটি রেকর্ড গড়েন তিনি। এছাড়া মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের বিপক্ষে তাঁর ৬২ বলে ১২৪ রানের ইনিংসেই জয় পেয়েছিল রাজস্থান রয়্যালস।
- তিলক ভার্মা (মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স)
দল খাদের কিনারায়। টপ অর্ডার, মিডল অর্ডার প্রতিপক্ষ বোলারদের আক্রমণে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়েছে। এবারের আইপিএলে দলের এমন সব ক্রান্তিলগ্নে যারা নিজ দলকে ম্যাচে ফিরিয়েছেন তাদের মধ্য অন্যতম মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের তিলক ভার্মা।
আইপিএলের মতো বড় মঞ্চে অসম চাপের মধ্যেই যেন এ ব্যাটার এবার নিজের ব্যাটিং দ্যুতি ছড়িয়েছেন। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে ম্যাচের কথাই ধরা যাক। মুম্বাইয়ের তখন ৪৮ রানে ৪র্থ উইকেটের পতন ঘটেছে। এমতাবস্থায় অল্প রানেই আটকে পড়ার শঙ্কা দলটার।
কিন্তু তিলক ভার্মার ব্যাটে সেই ক্রান্তিকালীন মুহূর্ত থেকে ঠিকই বেরিয়ে আসে মুম্বাই। চরম চাপের মধ্যে ব্যাটিং করেও এ ব্যাটার সে ম্যাচে ৪৬ বলে ৮৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। ইনজুরির কারণে যদিও ৫ ম্যাচ মিস করেছিলেন। তবে সব মিলিয়ে প্রায় ৪৩ গড়ে আর ১৬৪.১১ স্ট্রাইকরেটে ৩৪৩ রান করে নিজের প্রতিভা দেখিয়েছেন তিলক ভার্মা।
- নেহাল ওয়াধেরা (মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স)
তিলক ভার্মার মতো দলের বিপদে মুম্বাইকে টেনে তুলেছেন আরেক ব্যাটার নেহার ওয়াধেরা। পুরো মৌসুমে ২৬.৭৮ গড়ে ২৪১ রান করেছেন। তবে মিডল অর্ডারে প্রায় ম্যাচেই কার্যকরী ইনিংস খেলে দলকে এগিয়ে দিয়েছেন তিনি।
এর মধ্যে দুটি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন তিনি। ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে ৩৪ বলে ৫২ রানের ইনিংসের পর চিপকের কঠিন উইকেটে চেন্নাইয়ের বিপক্ষে এ ব্যাটার খেলেছিলেন ৬১ বলে ৬৪ রানের ইনিংস।
- রিঙ্কু সিং (কলকাতা নাইট রাইডার্স)
এবারের আইপিএলে রিঙ্কু সিং কী করেছেন, তা এখন ভেঙ্গে না বললেও চলে। কলকাতা নাইট রাইডার্সকে বলতে গেলে একাই টেনেছেন এ ব্যাটার। এর মধ্যে গুজরাটের ইয়াশ দয়ালের শেষ ৫ বলে ২৮ রানের সমীকরণে ৫ ছক্কা হাঁকিয়ে কলকাতাকে জয় এনে দেওয়া মুহূর্ত তো গোটা আইপিএলেরই বিস্ময় হয়ে আছে।
রিঙ্কুর তাণ্ডব সেখানেই শেষ নয়। পুরো আইপিএলেই তিনি ব্যাট হাতে ছিলেন দুর্দান্ত ধারাবাহিক। প্রায় দেড়শো স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করেছেন। তার চেয়েও বড় কথা, ৫৯.২৫ ব্যাটিং গড়ে বাঁহাতি এ ব্যাটার ৪ ফিফটিতে এবারের আইপিএল সাজিয়েছেন ৪৭৪ রান করে।
- ধ্রুব জুরেল (রাজস্থান রয়্যালস)
১৭২.৭৩ স্ট্রাইকরেটে ১৫২ রান। সর্বোচ্চ- অপরাজিত ৩৪ রানের ইনিংস। এমন সাদামাটা পরিসংখ্যান দিয়েও আলোচনা এসেছেন ধ্রুভ জুরেল। কারণটা হলো, রাজস্থানের হয়ে এ ব্যাটার অধিকাংশ ম্যাচেই শেষ দিকে ঝড় তুলেছেন। আর তাঁর এই দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ের কারণে রাজস্থান রয়্যালসও বেশ কয়েকটা ম্যাচে উপকৃত হয়েছে।
- জিতেশ শর্মা (পাঞ্জাব কিংস)
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনভিষিক্ত এই একাদশে উইকেটরক্ষকের দায়িত্বে আবর্তিত হবেন কে? তা বেছে নিতে একটু ধন্দে পড়তে হয় না।
পাঞ্জাব কিংসের উইকেটরক্ষকের ভূমিকায় থাকা জিতেশ শর্মা এবারের আইপিএলে রান করেছেন ৩০৯। আর তাতে স্ট্রাইক রেটও ছিল ঈর্ষণীয়, ১৫৬.০৬। তাই তরুণ তুর্কিদের এই একাদশে উইকেটের পিছনে গ্লাভস সামলানোর দায়িত্ব থাকছে জিতেশের উপরেই।
- আকাশ মাধওয়াল (মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স)
টেপ টেনিস থেকে পেশাদার ক্রিকেটার হয়ে ওঠা। আকাশ মাধওয়ালের গল্পটা এখন প্রায় সবারই জানা। কেনই বা হবে না। এবারের আইপিএলে ১৪ টা উইকেট নিয়েছেন। এলিমিনিটরে লখনৌর বিপক্ষে বাঁচা মরার লড়াইয়ে এ পেসার একাই নেন ৫ উইকেট।
৫ রানে ৫ উইকেট নেওয়া এ বোলিং ফিগার আবার আইপিএলের ইতিহাস নকআউট পর্বেরই সেরা বোলিং ফিগার। অবশ্য উত্তরাখণ্ডের এ পেসার তারুণ্য ফেলে এসেছেন বহু বছর আগেই। তারপরও কখনোই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা না রাখা এ পেসার থাকছেন এই একাদশে।
- ইয়াশ ঠাকুর (লখনৌ সুপার জায়ান্টস)
সৈয়দ মুশতাক আলী টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট দিয়ে নজরে এসেছিলেন। এরপর সেই ছন্দ টেনে এনেছেন এবারের আইপিএলেও। ৯ ম্যাচে ১৩ উইকেট নেওয়া এ পেসারকে তাই এই একাদশে না রাখার কোনো কারণ নেই।
- তুষার দেশপাণ্ডে (চেন্নাই সুপার কিংস)
২০২১ আইপিএলে নেট বোলার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এর দুই বছর বাদে বোলিং দ্যুতিতে নিজের ক্যারিয়ারটাই এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন এ পেসার।
পুরো আইপিএলে ২১ টা উইকেট রেখেছেন। চেন্নাইয়ের শিরোপা জেতার পথে রেখেছেন দারুণ অবদান। যদিও গোটা আসরেই কিছুটা খরুচে ছিলেন, তবে ম্যাচের ক্রাঞ্চ মুহূর্তে চেন্নাইকে ব্রেক থ্রু এনে দিয়েছেন বেশ ক’বার।
- সুয়াস শর্মা (কলকাতা নাইট রাইডার্স)
লেগ স্পিনার সুয়াষ শর্মার গল্পটা একটু অন্যরকম। কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে আইপিএল খেলার আগে এ লেগি কখনোই পেশাদার কোনো ম্যাচ খেলেননি। পুরো উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো অবস্থা। নিজের লেগস্পিন শৈলীতে নজর কেড়েছেন দুর্দান্ত ভাবে।
এবারের আইপিএলে নিজের নামের পাশে যোগ করেছেন ১০ টা উইকেট। কে জানে, এই সুয়াষ শর্মাই হয়তো ভারতীয় ক্রিকেটে হতে পারেন যুজবেন্দ্র চাহলের যোগ্য উত্তরসূরি।