সুখবরটা এলো ২০১৭ সালের ২২ জুন।
ঘোষণা এল, আইসিসির তরফ থেকে আফগানিস্তানের সাথে টেস্ট স্টাট্যাস পাচ্ছে আয়ারল্যান্ডও। আইরিশ ক্রিকেটার প্রধান নির্বাহী ওয়ারেন ডোট্রাম উঠে পড়ে লেগেছিলেন দেশকে এই টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ানোর জন্য, স্বপ্ন সফল হলো ডোট্রামের, স্বপ্ন সফল আয়ারল্যান্ডের ক্রিকেটারদের, যাঁরা এতদিন বিশ্বমঞ্চে দুর্দান্ত সব পারফরমেন্স করে এই টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার সম্ভাবনাকে একটু একটু করে উস্কে দিচ্ছিলেন।
২০০৬ থেকে নিয়মিত একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা আয়ারল্যান্ড ২০০৭-এর বিশ্বকাপে প্রথমে পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে, ২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে বা ২০১৫ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়ের মত টেস্ট খেলিয়ে দেশ গুলিকে নিয়মিত হারিয়ে চমকে দিচ্ছিলেন ক্রিকেট জগৎকে।
সবুজ জার্সির এই অভূতপূর্ব উত্থানে এড জয়েস, ট্রেন্ট জনস্টন, নিল ও’ ব্রায়েনরা সেখানে কিংবদন্তী। আজকের দিনেও আইরিশ ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সেইসব দিনের আরো কিছু সারথীদের সাথে বর্তমানের তারকাদের ও দেখে নেওয়া যাক একনজরে যাঁরা ভবিষ্যতে আরো অনেক স্বপ্নালু রাত উপহার দিতে পারেন আয়ারল্যান্ডকে।
- উইলিয়াম পোর্টারফিল্ড
ক্যারিয়ারের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছানো পোর্টারফিল্ডকে আইরিশ ক্রিকেট সার্কিটে বলা হয় ‘দ্য ক্যাপ্টেন’। বয়সভিত্তিক সমস্ত রকম আইরিশ দলের অধিনায়কত্ব করা পোর্টারফিল্ডের উজ্জীবিত অধিনায়কত্ব বিশ্ব ক্রিকেটে আয়ারল্যান্ডকে ক্রমশ জায়ান্ট কিলার করে তুলেছে।
একটুর জন্য ২০১৯ বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়া আয়ারল্যান্ডের ওপেনিংয়ে বরাবরের চওড়া ব্যাট এই পোর্টারফিল্ড, একদিনের আন্তর্জাতিকে ১১ টি সেঞ্চুরিতে চার হাজারের ওপর রানই তাঁর প্রমান। বর্তমানে অধিনায়ত্বের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়া পোর্টারফিল্ড দীর্ঘদিন ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটেও দারুণ পারফর্মার ছিলেন। ঐতিহাসিক প্রথম টেস্ট অধিনায়কও তিনিই।
- পল স্টার্লিং
মিড্লসেক্স কাউন্টি দলের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান স্টার্লিং আইরিশ ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। ২০১১ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে ৭০ বলে করা শতরান স্টার্লিংকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে দেশের সেরা ব্যাটসম্যান স্টার্লিং বল হাতেও কার্যকরী, আফগানদের বিরুদ্ধে এক ম্যাচে ছয় উইকেট তার প্রমান। আয়ারল্যান্ডের হয়ে একদিনের ক্রিকেটে নয়টি সেঞ্চুরির মালিক স্টার্লিং বর্তমান দলে সহ অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করছেন।
কানাডার বিরুদ্ধে তাঁর ১৭৭ রানের ইনিংসটি আয়ারল্যান্ডের ওয়ানডেরতে একদিন ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস। ২০২০-এর আগস্টে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩২৯ রান তাড়া করে আয়ারল্যান্ডের ঐতিহাসিক জয়ে স্টার্লিংয়ের ১৪২ রানের চোখ ধাঁধানো ইনিংসটি সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা নেয়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও দারুণ ভাবে ঝলসানো স্টার্লিং আইরিশ ক্রিকেটকে আরো বড়ো উচ্চতায় নিয়ে যাবেন আশা করাই যায়।
- কেভিন ও’ব্রায়েন
২০১১ বিশ্বকাপে বেঙ্গালুরুতে আয়ারল্যান্ড-ইংল্যান্ড ম্যাচটি আশা করি কেউ ভোলেননি। ও’ব্রায়েন পরিবারের ছোট ছেলেটির দাপুটে ব্যাটিংয়ের সামনে সেদিন অসহায় হয়ে গিয়েছিলেন ব্রড, আন্ডারসন, সোয়ানের মতো বাঘা বাঘা বোলাররা। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্রুততম সেঞ্চুরি করে ইতিহাসের পাতায় সেদিন নাম তোলেন কেভিন। ৫০ বলে ম্যাচ জেতানো কেভিনের শতরান আইরিশ ক্রিকেটকেই সেদিন অন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছিলো।
দলের বিপদে বারবার ত্রাতা হয়ে দাঁড়ানোর অপর নাম কেভিন ও’ব্রায়েন, কখনো ব্যাট হাতে, কখনো বল হাতে ম্যাজিকের মতো আইরিশদের ম্যাচ জিতিয়ে গেছেন তিনি। ২০১৮ তে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আয়ারল্যান্ডের প্রথম টেস্টে ফলো অনের পর কেভিনের সেঞ্চুরি টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ইনিংস। ক্যারিয়ারের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছানো কেভিন ও’ব্রায়েনই আইরিশ ক্রিকেটের একমাত্র খেলোয়াড় যিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিন ফরম্যাটেই সেঞ্চুরির বিরল কৃতিত্বের অধিকারী।
প্রায় দেড়শোর মত একদিনের ম্যাচে সাড়ে তিন হাজার রান ও ১১০ এর বেশি উইকেটের অধিকারী কেভিন স্লগ ওভারে ব্যাট বা বল হাতে ম্যাচ ঘোরাতে ভীষণ ভাবেই কার্যকরী।পরবর্তী টি ২০ বিশ্বকাপেও শেষ বারের মতো ছাপ ফেলে যেতে বদ্ধপরিকর নিল ও’ব্রায়েনের ছোট ভাই।
- অ্যান্ডি বালবির্নি
পোর্টারফিল্ডের ছেড়ে আসা জুতোয় পা গলানোর বর্তমান আইরিশ অধিনায়ক বালবির্নি দলের ব্যাটিংয়ের এক বড় ভরসা। টেকনিক্যালি আইরিশ দলের সেরা ব্যাটসম্যান বালবির্নি ভবিষ্যতে এদেশের একজন কিংবদন্তি হয়ে ওঠার দাবি রাখেন। একদিনের ক্রিকেটে দুই হাজারের বেশি রান ও ছয়টি সেঞ্চুরির মালিক বালবির্নি এই মুহূর্তে আইরিশ ক্রিকেটের ‘পোস্টার বয়’।
২০২০-এর আগস্ট মাসেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজের শেষ ম্যাচে ৩২৯ রান তাড়া করে অসাধারণ জয়ের নেপথ্যেও বড় ভূমিকা নিয়েছিল বালবিরনির চওড়া ব্যাট, অনবদ্য শতরান আইরিশ ক্রিকেটের এই বিশাল জয়ে অবদান রেখে যায়। কুড়ি বিশের খেলা ও সনাতনী টেস্ট ক্রিকেটেও ধীরে ধীরে নিজেকে মেলে ধরা বালবিরনির হাতে এই মুহূর্তে আইরিশ ক্রিকেটের ব্যাটন টা তুলে ধরার যোগ্যতম ব্যক্তি।
- মার্ক অ্যাডায়ার
আইরিশ ক্রিকেট যাদের ওপর ভবিষতের জন্য লগ্নি করতে পারে তাঁদের অন্যতম সেরা মার্ক অ্যাডায়ার। লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জীবনের প্রথম টেস্টেই দুই ইনিংস মিলে ছয় উইকেট তুলে নেওয়া এই অলরাউন্ডারের মধ্যে বড় তারকা হওয়ার সমস্ত রকম মশলা অটুট। ক্যারিয়ারের শেষ লগ্নে পৌঁছানো টিম মুর্তাগ ও বয়েড ৱ্যাঙ্কিনের পরে আইরিশ দলের বোলিংয়ের নেতা হবার ক্ষমতা এদের এর মধ্যে বিদ্যমান।
একদিনের ক্রিকেটে ভালো শুরু করা অ্যাডায়ার টি-টোয়েন্টিতেও দারুন ভাবে মেলে ধরেছেন নিজেকে। মাত্র ১৮ ম্যাচেই ২৭ উইকেট নেওয়া এ ভবিষ্যতে ব্যাট হাতেও ধামাকা দেখাতে প্রস্তুত।
- কার্টিস ক্যামফার
দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে যুব বিশ্বকাপ খেলা মাত্র ২১ বছর বয়সী ক্যামফারকে বলা হচ্ছে আয়ারল্যান্ড ক্রিকেটার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রতিভা। আইরিশ পাসপোর্ট থাকার সুবাদে অচিরেই আয়ারল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে ডাক পাওয়া ক্যামফার এর মধ্যেই নিজ প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন গত ইংল্যান্ড সফরে নিজের অভিষেক সিরিজেই।
তিনটি ম্যাচে দুই হাফ সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট পেয়ে গেছেন। ডানহাতি ব্যাটসম্যান ও ডানহাতি ফাস্ট মিডিয়াম বোলার ক্যামফার বিশ্ব ক্রিকেটে তাঁর অলরাউন্ড পারফরমেন্স দিয়ে কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারেন – ভবিষৎই বলবে সে কথা।
- গ্যারেথ ডেলানি
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আইরিশ দলের এক বিরাট ভরসার পাত্র ২৩ বছর বয়সী লেগ স্পিনিং অলরাউন্ডার গ্যারেথ ডেলানি। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খুব বেশি সুযোগ না পেলেও কুড়ি বিশের ক্রিকেটে নিজের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছেন ডেলানি ২৩ ম্যাচে দুই হাফ সেঞ্চুরি ও ১৯ উইকেট পেয়ৈ। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ারে ব্যাট হাতে ১৫০ রান ও বল হাতে সাত উইকেট নিয়ে তাঁর অলরাউন্ড পারফরমেন্স দলকে বিশ্বকাপের টিকিট পাওয়াতে বড়ো ভূমিকা নেয়।
- বয়েড র্যাঙ্কিন
ক্যারিয়ারের একদম সায়াহ্নে পৌঁছানো রানকিন আইরিশ দলের বোলিং বিভাগে তরুণ বোলারদের একপ্রকার মেন্টর বলা যায়। আয়ারল্যান্ডের হয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বাধিক ১৩২ টি উইকেট সংগ্রহ করা রানকিন দলের বড়ো বড়ো সব জয়ে প্রধান ভূমিকা নিয়েছেন। ২০০৭-এ ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে হওয়া বিশ্বকাপে তাঁর ১২ উইকেট ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল, সে বিশ্বকাপেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয়ে রানকিনের অসাধারণ ৩/৩২ স্পেল বিরাট ভূমিকা নেয়।
আইরিশ ক্রিকেটকে বছরের পর বছর ধরে অক্লান্ত সেবা করে চলা এই ফাস্ট বোলার মাঝে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছিলেন টেস্ট খেলার স্বপ্নে। কিন্তু পরবর্তী কালে আবার মাতৃভুমিতেই ফিরে আসেন এবং আয়ারল্যান্ডের হয়েও টেস্ট খেলেন। আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে রানকিনের অভিজ্ঞতা আয়ারল্যান্ডের এক বড়ো সম্পদ হতে চলেছে।
- জর্জ ডকরেল
২০১০ সালে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মাত্র ১৭ বছর বয়সে আয়ারল্যান্ড দলে সুযোগ পেয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন বাঁ-হাতি স্পিনার জর্জ ডকরেল। আর সেই বিশ্বকাপেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৪উইকেট নিয়ে প্রমান করে দেন অল্প বয়সে তাঁকে দলে নেওয়ায় কোনো ভুল ছিল না। তারপরের ১০ বছরে নিজেকে আরো পরিণত ও ধারালো করে তুলে আইরিশ স্পিন বিভাগকে এখন নেতৃত্ব দেন ডকরেলই।
ব্যাটের হাতও উন্নত করে তুলে লোয়ার অর্ডারে ব্যাটিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ডকরেল। মাত্র একটি টেস্ট খেললেও সাদা বলের ক্রিকেটে তাঁর কৃপণ বাঁহাতি স্পিন আয়ারল্যান্ড বোলিংয়ের এক বিরাট সম্পদ। ৮০’-এর বেশি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে দু’টি হাফ সেঞ্চুরিও তাঁর ব্যাট থেকে। ওয়ানডেতে প্রায় ৯০ ও টি-টোয়েন্টিতে প্রায় ৮০ টি উইকেট নেওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ডকরেল আগামী কুড়ি বিশের বিশ্বকাপে দলের এক বড় সম্পদ হতে চলেছেন।
- ব্যারি ম্যাকার্থি
আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি অভিষেকেই চার উইকেট তুলে নেওয়া ম্যাকার্থি এই মুহূর্তে আয়ারল্যান্ড পেস বোলিংয়ের এক বড় ভরসা। মাত্র ৩১ ওয়ানডেতে ৫৫ উইকেট পাওয়া ম্যাকার্থি আয়াল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে কম ম্যাচে ৫০ উইকেট পাওয়ার রেকর্ড গড়েছেন।
শারজাহতে আফগানদের বিরুদ্ধে ৪৬ রান দিয়ে নেওয়া পাঁচ উইকেট তাঁর সেরা বোলিং পারফরমেন্স। এছাড়া ডাবলিনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের একদিনের সিরিজে অনবদ্য বোলিংয়ে তুলে নেন চার উইকেট। চোটপ্রবণ এই ম্যাকার্থি নিজেকে চোটমুক্ত রেখে আগামীদিনে আইরিশ বোলিংকে কিভাবে নেতৃত্ব দিতে পারেন সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।