পবিত্র এক ক্রিকেট জীবন

২০০৭-এর একদিনের বিশ্বকাপ টিমে থাকলেও কোন ম্যাচে খেলানো হয়নি তাকে। কিন্তু কুড়িবিশের ২০০৭-এ জয়ী ভারতের বিশ্বকাপ টিমে তার উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। সেবার ফাইনালে পাকিস্তানকে হারানোর পেছনে তার চার ওভারে মাত্র ১৬ রান দিয়ে তিন উইকেটের স্মৃতি মুছে ফেলা খুব কষ্টকর, ভারতীয় ক্রিকেটের পক্ষে।

২৯ জানুয়ারি ২০০৬। রবিবার। দিনটা চোখের সামনে ভাসছে এখনও।

বারানসীতে পোস্টেড তখন আমি। অডিটে। আগের দিন থেকে আমাদের অল ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের কনফারেন্স ওখানে।কলকাতা থেকে অনেকেই গিয়েছেন। তাদেরই একজন, সত্যেনদার সাথে দেখা করতে গিয়েছি ২৯ জানুয়ারি ২০০৬ সকালে সাড়ে ন’টা নাগাদ।

হোটেলে তার ঘরে তার সঙ্গে বসেই করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে সেদিনই শুরু হওয়া ভারত বনাম পাকিস্তান ৩য় টেস্ট দেখতে বসলাম ১০টা নাগাদ। ভারত টসে জিতে ফিল্ডিং নিল। ঐ টেস্টে খেললেও সেই সময় দাদা’র সুযোগ না পাওয়া নিয়ে চ্যাপেল সমেত টিম ম্যানেজমেন্টের উপর টগবগ করে তখনও ফুটছিল আপামর বাঙালি। এই রকম একটা আবহে শুরু হল খেলা।

প্রথম ওভারেই অপরূপকথা, চোখের সামনে, সেদিন। ছবির এই ভদ্রলোক জাস্ট ছ’টি বল করেই ভারতপ্রেমের ছাদের নীচে দাঁড় করিয়ে দিলেন আসমুদ্রহিমাচল দেশবাসীকে। প্রথম তিনটি ডট বলের পরে চতুর্থ বলে সলমান বাটকে দ্রাবিড়ের হাতে তুলে দিলেন তিনি, স্লিপে। পঞ্চম বলে তখন সেরা ফর্মের ইউনুস খানের পা মিডল স্টাম্পের সামনে পেয়ে গেল তার বল।

আর ষষ্ঠ বলে মোহাম্মদ ইউসুফের স্টাম্প ছিটকে গেল তার স্যুইংয়ে। পাক-ভারত টেস্ট সিরিজে এখনও অবধি হ্যাটট্রিকের নজির এই একটিই। এই কারণেই অমর হয়ে আছে ঐ ম্যাচ। কারো মনেই নেই ঐ টেস্টেরই চতুর্থ ইনিংসে যুবরাজ সিংয়ের লড়াকু ১২২ এবং তা সত্ত্বেও ভারতের ৩৪১ রানে বিশাল হার। ঐ হ্যাটট্রিকের ইনিংসে ১৭.১ ওভার বল করে চারটি মেইডেন নিয়ে ৬১ রানে ৫ উইকেট পেয়েছিলেন এই ভদ্রলোক।

তার মত এত ভাল ডানহাতের ব্যাটসম্যানের জন্য ইনস্যুইং করানোর ক্ষমতাসম্পন্ন খুব কম বাঁ-হাতি বোলারই পেয়েছে ভারত। ব্যাটটাও খারাপ করতেন না তিনি। কিন্তু জাস্ট খারাপ পি আর, ঘন ঘন চোট আঘাত এবং খাটনির অনীহা তাকে তার যোগ্য স্থান পেতে দেয়নি ভারতীয় ক্রিকেটে। টিমে ঢুকেছেন আর বেরিয়েছেন বহুতলে লিফটের ওঠা আর নামার মত।

২০০৩ থেকে ২০১২ – ২৯ টেস্টে ১০০ (৭ বার ইনিংসে ৫ উইকেট সহ), ১২০ একদিনে ১৭১ আর ২৪ কুড়িবিশে ২৮ – মোট ২৯৯ উইকেট ছিল তার ঝুলিতে। এর বাকি ২৯৬টি না পেলেও ভারতের বোলিং ইতিহাসে বড় একটা জায়গা তার নামে লেখা থাকত এই করাচির হ্যাটট্রিকের জন্য। এছাড়াও ২৯ টেস্টে একটি শতরানসহ (১০২) ১১০৫, ১২০ একদিনে ১৫৪৪ (সর্বোচ্চ ৮৩) আর ২৪ কুড়িবিশে ১৭২ (সর্বোচ্চ অপরাজিত ৩৩) – মোট ২৮২১ রান ছিল তার ব্যাটের সংগ্রহে।

২০০৭-এর একদিনের বিশ্বকাপ টিমে থাকলেও কোন ম্যাচে খেলানো হয়নি তাকে। কিন্তু কুড়িবিশের ২০০৭-এ জয়ী ভারতের বিশ্বকাপ টিমে তার উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। সেবার ফাইনালে পাকিস্তানকে হারানোর পেছনে তার চার ওভারে মাত্র ১৬ রান দিয়ে তিন উইকেটের স্মৃতি মুছে ফেলা খুব কষ্টকর, ভারতীয় ক্রিকেটের পক্ষে।

২০১২ সালে শেষবার ভারতের হয়ে খেলার পরে সাত-আট বছর ধরে তার নিরন্তর আর আপ্রাণ চেষ্টা ছিল টিমে ফেরার আর রঞ্জি খেলে যাচ্ছিলেন, সেই চেষ্টার অঙ্গ হিসেবে। তার সেইসব চেষ্টা ইতিহাস হয়ে গিয়েছিল চার জানুয়ারি ২০২০ তারিখে। সেদিন সব ধরণের ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছিলেন লড়াকু অলরাউন্ডার ইরফান পাঠান। জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসেও ভাল থাকুন ইরফান পাঠান, তার পবিত্র ক্রিকেট জীবনের মত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link