নির্ভরতার বটবৃক্ষ

সেই হাসি আনন্দের ছিল না, সে হাসিতে লুকিয়েছিল হতাশা, অপ্রাপ্তি। টানা তিনটি বিশ্বকাপ ফাইনালে পরাজয়ের বেদনা। সেই হাসি হয়তো আবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছিল আবার একটি নতুন লড়াইয়ের জন্য, যা বারবার তিনি বা তার দল বিশ্বের কাছে ধরেছে নিজেদের সীমিত সামর্থ্যের পরও।

‘ধোনি ফিনিশেস অফ ইন স্টাইল, ইন্ডিয়া লিফট দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ আফটার ২৮ ইয়ার্স!’

২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনালের সেই অসাধারণ রাত। খারাপ শুরু করেও একজন লড়াকু বাঁ-হাতির অদম্য লড়াই এবং ভারতীয় অধিনায়কের অসাধারণ ইনিংসের পর শেষে যখন বিপক্ষ দলের পেসারকে অবলীলায় মাঠের বাইরে ফেলে দিয়ে গোটা ভারতের মুখে এক অনাবিল আনন্দের হাসি ফুটে উঠেছিল তখন উইকেটের পেছনে দাঁড়ানো আরেক জন মানুষের মুখের রেখা বলে দিচ্ছিল তিনি হাসছেন।

কিন্তু, সেই হাসি আনন্দের ছিল না, সে হাসিতে লুকিয়েছিল হতাশা, অপ্রাপ্তি। টানা তিনটি বিশ্বকাপ ফাইনালে পরাজয়ের বেদনা। সেই হাসি হয়তো আবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছিল আবার একটি নতুন লড়াইয়ের জন্য, যা বারবার তিনি বা তার দল বিশ্বের কাছে ধরেছে নিজেদের সীমিত সামর্থ্যের পরও। আর এই জায়গাতেই কুমার সাঙ্গাকারা বা শ্রীলঙ্কা দল ও তাঁর যোদ্ধারা বরাবরই বিশ্বের সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে।

জীবনে সফল হতে গেলে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব ঠিক কতখানি তা আমরা মোটামুটি জানি। বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতো খেলাধুলাতেও অধ‍্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। হ‍্যাঁ, তার মাঝেও কিছু বিরল প্রতিভা আসেন, কিন্তু অধ‍্যবসায় সাফল্যের প্রধান ও শেষ অবলম্বন। ক্রিকেটেও প্রতিভার মাঝে অধ‍্যবসায়ের অবদান বারবার চোখে পড়েছে শুরুর লগ্ন হতে বর্তমানেও, এমনকি ভবিষ্যতেও থাকবে। কিছুটা সীমিত প্রতিভা নিয়েও শুধুমাত্র অধ্যবসায় দিয়ে নিজেকে ঠিক কতটা উঁচু অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তী ক্রিকেটার কুমার সাঙ্গাকারা।

সাঙ্গাকারা ক্রিকেটের এক নিখুঁত শিল্পী। তার খেলায় সবদিন দেখনদারীর থেকে সৌন্দর্য বেশি ফুটে উঠতে দেখেছি আমরা। অনেকেই তাঁকে বিশ্বের সেরা ব‍্যাটসম‍্যান হিসেবে মানেন, একজন ব‍্যাটসম‍্যানের থেকেও তিনি একজন প্রকৃত অলরাউন্ডার।

প্রকৃত অলরাউন্ডাররা যেমন যেকোনো দলে তাদের ব‍্যাটিং বা বোলিং দক্ষতা দিয়ে দলে নিজের জায়গা করে নিতে পারেন, তেমনই ইনি ব‍্যাটিং কিংবা উইকেট রক্ষা যে কোনো একটি দিয়েই বিশ্বের যেকোনো দলে নিজের জায়গা করে নিতে পারতেন। সাঙ্গাকারা মানেই একজন যিনি ব‍্যাটিংয়ে সৌন্দর্য ও সুরুচির সাথে বাইশ গজে কাব‍্য লিখতেন, একজন যিনি তার ভাবনাকে খেলার তখনকার বর্তমান অবস্থার থেকে এগিয়ে রাখতেন, একজন মহীরুহ যার ছায়ায় শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট প্রায় দেড় যুগ লালিত-পালিত হয়েছে।

দীর্ঘ ১৫ বছরে নিজের সেরা বন্ধু ও কিংবদন্তী মাহেলা জয়াবর্ধনেকে সঙ্গে নিয়ে দলকে বহু সাফল্য এনে দিয়েছেন তা ব‍্যাটিং হোক বা দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়াই হোক। প্রায় ২৮০০০ এর কাছাকাছি আন্তর্জাতিক রান, ৭৫০ এর কাছাকাছি ডিসমিস‍াল – নিজেকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন।

টেস্ট ক্রিকেটে দ্রুততম নয়-দশ-এগারো-বারো হাজার রান,প্রিয় বন্ধুর সাথে সর্বোচ্চ টেস্ট রানের পার্টনারশিপ কিংবা সবচেয়ে বেশি টেস্ট রানের পার্টনারশিপ, তিন নম্বরে রেকর্ড সেঞ্চুরি ও রান, বিশ্বকাপে টানা চার সেঞ্চুরি, এতোগুলো বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা, বিশ্বকাপের ফাইনালে ম‍্যাচের সেরা, আরও যা আছে তা বলে শেষ করতে পারা যাবে না। সত্যি ক্রিকেটের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে আপনি ওনার শিল্পকর্মের অসাধারণ নৈপুণ্যতা দেখাননি।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে যেখানে খেলোয়াড়দের খেলার ধার কমতে থাকে সেখানে সাঙ্গাকারার খেলার ধার বয়স বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে। এর প্রধান কারণ ক্রিকেটের প্রতি তাঁর নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতা, অধ‍্যবসায় এবং মনোযোগ। তাঁর কাভার ড্রাইভকে বলা হয় ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম নিখুঁত কাভার ড্রাইভ, তবে এটা কিন্তু মোটেও ঈশ্বরপ্রদত্ত কোনো প্রতিভার ফসল নয়!

নেটে হাজার হাজার বার কভার ড্রাইভের অনুশীলনের ফলেই এমনটা সম্ভব হয়েছে। তিনি নিজেও জানতেন, তার হাতে তার সমসাময়িক মাহেলার মতো অনেক বেশি শট নেই, কিংবা তিনি ব্রায়ান লারার মতো ন্যাচারাল স্ট্রোক-মেকারও নন কিংবা শচীন টেন্ডুলোরের মতো ঐশ্বরিক প্রতিভা নেই। কিন্তু সেই সব কাটিয়ে উঠেও নিজেকে ক্রিকেটের একজন সেরা ‘আইকন’ বা ‘অ্যাম্বাস‍্যাডার’ হয়ে উঠেছেন তা সত্যিই কৃতিত্বের।

ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে স্কোয়ার অফ দ্য উইকেটের শটগুলোতেই তিনি শুধুমাত্র পারদর্শী ছিলেন, কিন্তু ক্যারিয়ার শেষ করবার সময়ে সুইপ, রিভার্স সুইপ, ওভার দ্য উইকেট,ওভার দ‍্য কভার, স্লগ সুইপ – সব শটে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সিদ্ধহস্ত। পরিসংখ্যান ও সাফল্য উভয় দিকেই ক‍্যারিয়ার যেভাবে শেষ করেছেন তা ওনার নিজের অধ‍্যবসায়ের ফল।

অন‍্যদিকে, উইকেট কিপিংয়েও নিজেকে এমন এক অন‍্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন যা অন‍্যদের কাছে অনুপ্রেরণা, একজন প্রকৃত অলরাউন্ডার যিনি যার সৌরভ ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রতিটি ক্রিকেট প্রেমীদের অন্তরে সর্বদা। আর মানুষ হিসেবে বলতে গেলে ক্রিকেটের অন‍্যতম সেরা ‘ভদ্রলোক’ তিনি। এমন একজন মানুষ যাকে মাঠে দেখলেই মনটা ভাল হয়ে যেত, সে যতই তিনি বিপক্ষে খেলুন। তাকে পছন্দ করে না, এমন ক্রিকেট সমর্থকই খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link