বিতর্কের বেড়াজাল ছিড়ে

ক্রিকেটকে বলা হয় ভদ্রলোকের খেলা। সুতরাং ধারণা করা যায় - ক্রিকেটারদের মধ্যে থাকবে সকল শিষ্টাচার। তাই অধিকাংশ ছেলে ছোকড়া অন্ধের মতো অনুসরণও করেন কোনো কোনো ক্রিকেটারকে। তবে ক্রিকেটারাও মানুষ। তাঁদেরও হতে পারে ভুল। অনেক স্বনামধন্য ক্রিকেটারও তাঁদের জীবনে করেছে কিছু নিন্দিত ভুল।

একটা প্রশ্ন ছিল। বর্তমান বিশ্ব সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা কোনটি? থাক উত্তর খুঁজে বের করা দুষ্কর এবং নানারকম তর্কেরও সৃষ্টি হতে পারে। তবে ক্রিকেট যে অন্যতম জনপ্রিয় একটি খেলা তাতে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই কারো। বিশেষ করে এই উপমহাদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা যেন রয়েছে তুঙ্গে। ক্রিকেটের সাথে সারাবিশ্বে খেলোয়াড়দেরও জনপ্রিয়তা যেন সমানুপাতিক হারে বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

ক্রিকেটকে বলা হয় ভদ্রলোকের খেলা। সুতরাং ধারণা করা যায় – ক্রিকেটারদের মধ্যে থাকবে সকল শিষ্টাচার। তাই অধিকাংশ ছেলে ছোকড়া অন্ধের মতো অনুসরণও করেন কোনো কোনো ক্রিকেটারকে। তবে ক্রিকেটারাও মানুষ। তাঁদেরও হতে পারে ভুল। অনেক স্বনামধন্য ক্রিকেটারও তাঁদের জীবনে করেছে কিছু নিন্দিত ভুল।

তবে তাঁরা তাঁদের ভুল বুঝতে পেরে আবার ফিরেছেন স্বরুপে। আবার ফিরেছেন ক্রিকেটের ময়দানে। এ থেকেও তো প্রত্যাবর্তনের বার্তা পাওয়া যায়। চলুন এমন কিছু খেলোয়াড়দের গল্প থেকে ঘুরে আসি। যারা কিনা বিভিন্ন সময়ে নানারকম বিতর্কে জড়িয়ে কিছুকাল ছিলেন ক্রিকেট থেকে দূরে। তবে তাঁরা আবার ঠিকই এসেছেন ফিরে মাতাচ্ছেন মাঠ।

  • স্টিভ স্মিথ (অস্ট্রেলিয়া)

স্যান্ডপেপার বিতর্কে জড়িয়ে, বেশ নিন্দিত ও সমালচিত হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ। পুরো বিশ্বজুড়ে হওয়া সমালোচনা ও নিজের কৃতকর্মের প্রতিক্রিয়া জানাতে এসে সংবাদ সম্মেলনে কেঁদেছিলেন এই ডান-হাতি মিডেল অর্ডার ব্যাটার স্টিভ স্মিথ। কান্নার জলে তো আর দোষ ধুয়ে নাহি যায়। অগ্যতা তাঁকে সম্মুখীন হতে হলো শাস্তির।

একবছরের জন্য সবধরণের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে তাঁকে বহিষ্কার করে আইসিসি। আইসিসির দেখানো পথ দেখে বিভিন্ন ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক টুর্নামেন্ট কর্তৃপক্ষও তাঁর উপর নিষেধাজ্ঞা জাড়ি করেন। এক বছর ক্রিকেট থেকে নির্বাসনে থেকে ২০১৯ সালের আইপিএল দিয়ে প্রত্যাবর্তন করেন স্টিভ স্মিথ। মাঝে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কের পদের পাশাপাশি সব ধরণের ক্রিকেটে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব থেকে নিজেকে সড়িয়ে নেন স্মিথ।

২০১৯ এ ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি আবার সুযোগ পান জাতীয় দলে। এমনকি জায়গা করে নেন বিশ্বকাপ দলেও। সেখানে দলের বিপর্যয় সামলে নিতেও সচেষ্ট ভূমিকা পালন করেন তিনি। তাতে অবশ্য খুব একটা লাভ হয়নি। সেমিফাইনালেই বাদ পড়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। তবে স্মিথ রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন সে বছরের অ্যাশেজ সিরিজে।

সেবারের অ্যাশেজে সিরিজ সেরা খেলোয়াড়ের খেতাবটা বাগিয়ে নিয়েছিলেন স্টিভ স্মিথ। পাঁচ ম্যাচে ৭৭৪ রান করেছিলেন তিনি প্রায় ১১০.৫৭ গড়ে। যার মধ্যে রয়েছে তিনটি শতক ও সমান সংখ্যক অর্ধশতক। স্মিথ ব্যাট হাতেই সকল নেতিবাচক অতীত বলকে মাঠ ছাড়ার মতো করেই তাঁর ক্রিকেট জীবনের বাউন্ডারি পার করেছেন। আর শিখিয়েছেন ভুল থেকে শিখতে হয়, সেখান থেকে নিজেকে পুনঃরায় নতুন উদ্যমে গড়ে তুলে এগোতে হয় সামনের দিকে।

  • ডেভিড ওয়ার্নার (অস্ট্রেলিয়া)

স্টিভ স্মিথের সহযোগী অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়া দলের সহকারী-অধিনায়ক ছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার। বল টেম্পারিং এর মূল প্রণোদনাকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন তিনি। ফলস্বরুপ তাঁর কপালেও জুটেছিলো নিষেধাজ্ঞা, বছর খানেকের। স্বাভাবিকভাবেই সবধরণের ক্রিকেট থেকে দূরে সড়ে গিয়েছিলেন তিনি, তাঁরই সতীর্থ স্টিভ স্মিথের মতো। ২০১৯ এ আবার ক্রিকেটের ময়দানে পদার্পণ করেন ওয়ার্নার।

তাঁকেও বিশ্বকাপ দলে বিবেচনা করে অস্ট্রেলিয়া  ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সেই টুর্নামেন্টে তিনি ছিলেন দলে হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। পুরো টুর্নামেন্ট বিবেচনায় তাঁর উপরে কেবল অবস্থান করছিলেন ভারতের রোহিত শর্মা। ফের ২০২০ ক্রিকেটই খানিক বিরতি নিয়ে নিলো মহামারী প্রকোপে। তারপর যেন অফ-ফর্ম ঘিরে ধরে ডেভিড ওয়ার্নারকে। ২০২১ এর শুরুতে ফর্মহীন ওয়ার্নারকে নিয়ে হয়েছে নানান রকমের নিন্দা, সমালোচনা। অনেকে তো মোটাদাগে বলেই দিয়েছিলেন বিদায় ডেভিড ওয়ার্নার কিংবা ডেভিড ওয়ার্নার শেষ। 

কিন্তু নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আবার নতুন উদ্যমে শুরু করা ডেভিড ওয়ার্নার তো অল্পতে দমে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি আবার তাঁর ব্যাট চালিয়ে বনে গেলেন ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়। সমালোচনার জবাবে ব্যাট হাতে তিনি রান তুলেছেন ১৪৬.৭০ স্ট্রাইকরেটে সাত ম্যাচে ২৮৯।

  • বেন স্টোকস (ইংল্যান্ড)

বর্তমান বিশ্বক্রিকেটে বেন স্টোকস অন্যতম সেরা একজন অলরাউন্ডার সে বিষয়ে খুব বেশি সন্দেহের কিংবা তর্কের অবকাশ নেই। তবে নিজের খেলোয়াড়ী জীবনে নির্ভেজাল ক্রিকেটীয় শৈলীতে যেমন দর্শকদের মুগ্ধ করেন দর্শকদের ঠিক তাঁর উল্টো গল্পের হিরো চরিত্রেও থাকেন তিনি। মাঠের বাইরে সাধারণ দর্শকদের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে ২০১৭-১৮ সালের অ্যাশেজ সিরিজ ও ভারতের বিপক্ষে একটি টেস্ট ম্যাচ মিস করেছিলেন তিনি, তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সুনানী চলমান থাকায়।

তারপর সেখান থেকে ফিরে এসে সত্যিকার অর্থেই নিজেকে একজন নায়কে পরিণত করেন স্টোকস। ইংল্যান্ডের প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক তো তিনিই। তাছাড়া নিজেকে একজন কিংবদন্তি অলরাউন্ডার পর্যায়েও পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বকাপ জয়ের টুর্নামেন্টে বেশ কয়েকবার তিনি দলের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাছাড়া ফাইনালে তাঁর অবদান কি করে ভুলবে ক্রিকেট বিশ্ব। টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জিতেছিলেন তিনি।

বিশ্বকাপের পরের অ্যাশেজ সিরিজে তিনি একাই ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়া এবং অ্যাশেজ শিরোপার মাঝে। তাঁর অনবদ্য ১৩৫ রানের অপরাজিত এক ইনিংস ইংল্যান্ডকে শুধু যে বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়েছিল তা নয় বরং জয়ও এনে দিয়েছিল। ৩৫৯ রান তাড়া করতে নেমে দলে ব্যাটিং কলাপ্স করার প্রক্কালে তাঁর অমন সময় উপযোগী ইনিংস পরবর্তীতে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস হিসেবে আখ্যা পায়।

  • হার্দিক পান্ডিয়া (ভারত) 

ভারতীয় ক্রিকেটের প্রমিসিং একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়া খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচ্য হয়ে আসতেন তাঁর ক্যারিয়ারের শুরু থেকে। তবে তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার যতটানা ছিল সমাদ্রিত ঠিক ততটা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল বিতর্কিত। এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তাঁর করা কিছু বেফাস মন্তব্যে পুরো ভারত জুড়ে তাঁর নিন্দা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

যার ফলস্বরুপ তাঁকে এবং এবং লোকেশ রাহুলকে সম্মুখীন হতে হয় সাময়িক নিষেধাজ্ঞার। এর পাশপাশি তাঁদের বিরুদ্ধে চলতে থাকে তদন্ত। পরবর্তীতে দলে ডাক পান তাঁরা দুইজনই। কিন্তু হার্দিক তাঁর বিতর্কিত তথ্য এবং মন্তব্যের ফলাফল হিসেবে হারান তাঁর সকল স্পন্সরশীপ। কিন্তু ২০১৯ সালে তিনি ছন্দে ফেরেন আইপিএলের মধ্য দিয়ে। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের শিরোপা জয়ে রেখেছনে কার্যকরী ভূমিকা। পরবর্তীতে ২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় বিপক্ষে দ্বিপাকক্ষিক টি-টোয়েন্টি সিরিজে বেশকিছু ক্যামিও ইনিংস খেলে নিজের ফিনিশান সত্ত্বার পরিচয় দেন। যদিও বর্তমানে তিনি নানা রকম ইনজুরি জনিত কারণে ক্রিকেট থেকে খসে পড়া এক তারকা হবার দাড়প্রান্তে রয়েছেন।

  • সাকিব আল হাসান (বাংলাদেশ)

ম্যাচ ফিক্সিং রীতিমত এক ত্রাসের নাম। যেকোন খেলার ক্ষেত্রেই ফিক্সিং এক হুমকি। তাইতো ম্যাচ ফিক্সিং ইস্যুতে খুবই সতর্ক ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি। সেই সর্তকতার এবং নিয়মের বেড়াজালে ফেসে গিয়েছিলেন বর্তমান বিশ্বের সেরাদের সেরা অলরাউন্ডার বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান। ফিক্সিং প্রস্তাবের কথা আইসিসির ফিক্সিং দমন সংশ্লিষ্টদের না জানানোয় সব ধরণের ক্রিকেট থেকে বছর খানেকের নিষেধাজ্ঞায় পড়েন সাকিব আল হাসান।

২০১৯ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদশের সেরা পারফর্মার সাকিব যখন ফর্মের তুঙ্গে ঠিক তখনই আসে এই নিষেধাজ্ঞা। হতাশায় ডুবে যায় বাংলাদেশি ক্রিকেট সমর্থকেরা। হতাশ চিত্তে সাকিবও সংবাদ সম্মেলনে শুনিয়েছিলেন আশার বাণী। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে সাকিব ফিরলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাঠে টি-টোয়েন্টি সিরিজ দিয়ে। সেখানে পাঁচ ম্যাচে সাত উইকেটের বিপরীতে রান করেছিলে ১১৪। সিরিজ জুড়েই ম্যাচ হয়েছিল স্বল্প রানের। সেই তাতেই রান সংগ্রাহকদের তালিকায় সাকিব ছিলেন দ্বিতীয়তে।

তারপর এই ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা পারফর্মার। ব্যাট হাতে ১০৯ এর কাছাকাছি স্ট্রাইকরেটে রান করেছিলেন ১৩১ ছয় ম্যাচে। অন্যদিকে তাঁর উইকেট সংখ্যা ছিল ১১টি। ছিলেন দলের সেরা উইকেট শিকারি, তাছাড়া পুরো টুর্নামেন্টের উইকেট শিকারিদের তালিকার চতুর্থ স্থানে ছিলেন সাকিব।

সাকিব, স্মিথ, স্টোকসরা ক্রিকেট খেলতে যেমন অনুপ্রাণিত করে ঠিক তেমনি ভাবে জীবনের চলার পথের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাও মেলে তাঁদের কাছ থেকে। ভুলভ্রান্তি ঝেড়ে ফেলে যে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়, দেখিয়ে দিতে হয় পুরো বিশ্বকে, কাজে দিতে হয় জবাব সমালোচনার।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...