২৭ জানুয়ারি, ১৯৯৩। টেস্ট ইতিহাসের রোমাঞ্চকর এক দিন। অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়াকে মাত্র ২ রানে হারিয়ে সেই টেস্টে শ্বাসরুদ্ধকর এক জয় পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ! ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলারদের সামনে দাঁড়াতেই পারছিল না অস্ট্রেলিয়ার অভিজ্ঞ ব্যাটাররা।
সেই টেস্টের শ্বাসরুদ্ধকর এক লড়াইয়ের মাঝে বিশেষভাবে নজর কাঁড়েন ২২ বছরের এক তরুণ। ইয়ান বিশপ, কার্টলি অ্যাম্ব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশের সামনে যেখানে দাঁড়াতে পারছিলনা অজি ব্যাটাররা, সেখানে ক্যারিবিয়ান পেস দানবদের সামনে দ্বিতীয় ইনিংসে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছিল সেই তরুণ।
সাদা পোশাকে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে সফল ওপেনারদের একজন জাস্টিন ল্যাঙ্গারের কথাই বলছিলাম।
প্রায় দুই দশক ধরে বিশ্ব ক্রিকেটে ত্রাশ করা ক্যারিবিয়ানদের সামনেই ২২ বছর বয়সে অভিষিক্ত হন ল্যাঙ্গার। অভিষেকে প্রথম ইনিংসে করেছিলেন মাত্র ২০ রান; তাও কিনা দলের হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ! এরপর ১৮৬ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে দ্বিতীয় ইনিংসে একপ্রান্তে বাকিরা দাঁড়াতে না পারলেও ক্যারিবীয় পেস দাপটের সামনে ১৪৬ বল মোকাবেলা করে ৫৪ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন ল্যাঙ্গার।
তিন নম্বরে ব্যাট করতে এসে নবম উইকেটে যখন ল্যাঙ্গার আউট হন দলের রান তখন ১৪৪। শেষ উইকেটে ৪২ রান এলেও মাত্র ২ রানের ব্যবধানে হেরে যায় অজিরা। ম্যাচ থেকে ছিটকে যাওয়া অজিদের সেই ম্যাচে জয়ের সম্ভাবনাটা জাগিয়েছেন তরুণ ল্যাঙ্গার। অ্যাডিলেড টেস্টের সেই দিনটি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম রোমাঞ্চকর এক দিন। ওই টেস্টে দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ জাস্টিন ল্যাঙ্গারের।
অভিষেকের বছরে পাঁচ টেস্ট খেললেও পরের তিন বছরে সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র ৩ টেস্ট! ব্যাট হাতে আগ্রাসন, মারকুটে কিংবা ন্যাচারালি স্ট্রোক মেকার – এর কোনোটিই ছিলেন না ল্যাঙ্গার। কভারের উপর দিয়ে বাউন্ডারি আর পুল শটগুলো ছিল দেখার মত। গায়ে কোনো তকমা লাগিয়েই আসেননি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। তবে পরিশ্রম আর নিজের সেরাটা দেওয়ার ক্ষুদাটা দেখিয়েছিলেন ল্যাঙ্গার। সেটিই তাঁকে পৌঁছে দেয় সফলতার দুর্গম পথে।
প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ইতিহাসে ৪০ গড়ে ব্যাট করেছেন তিনি। তবে ক্যারিয়ারের পুরোটা সময়ই ম্যাথু হেইডেনের ‘বিধ্বংসী’ ব্যাটিংয়ের ছায়ায়। হেইডেনকে নিয়ে যে পরিমাণ চর্চা কিংবা আলোচনা হত সেদিক থেকে অনেকটাই আড়ালে ছিল ল্যাঙ্গারের পারফরম্যান্স।
তর্ক-সাপেক্ষে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে সফল ওপেনিং জুটি হেইডেন ও ল্যাঙ্গারের। যে দশকে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দুনিয়ায় একক রাজত্ব করেছে সেই দশকের গ্রেট ক্রিকেটারদের তালিকা করলে সন্দেহ ছাড়াই আসবে ল্যাঙ্গারের নাম।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অ্যাডিলেড টেস্টে অভিষেকের পর সিরিজের শেষ টেস্টেও পেয়েছিলেন সুযোগ। তবে নিজেকে আর মেলে ধরতে পারেননি ল্যাঙ্গার। অধারাবাহিক পারফরম্যান্স তাকে ছিটকে দেয় দল থেকে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম চার বছরে খেলেছেন মোটে আট টেস্ট।
ঘরোয়া ক্রিকেটে রান পেলেও সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছিলেন না আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। তবে চেষ্টা ঠিক চালিয়ে গিয়েছিলেন, ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স, পরিশ্রম আর কষ্টের ফল স্বরূপ ১৯৯৮ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে আবারও ডাক পান তিনি।
তবে ফেরার অভিজ্ঞতাটা ছিল তিক্ত। প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ডাক! দ্বিতীয় ইনিংসে পাননি ব্যাট করার সুযোগ। শেষ সুযোগ হিসেবে দ্বিতীয় টেস্টে জায়গা পেলেন তিনি। জানতেন এবার হতাশ করলে হয়ত আবার সুযোগের অপেক্ষায় গুনতে হবে লম্বা প্রহর। তবে হতাশা কাটিয়ে দলকে দেখয়েছিলেন আশা! পরের টেস্টের প্রথম ইনিংসেই দেখা পেলেন ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির।
পরের বছর পাকিস্তানের বিপক্ষে হোবার্টে ৩৬৯ রান তাড়া করতে নেমে দ্বিতীয় ইনিংসে ১২৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে তখন ব্যাকফুটে ছিল অজিরা। সেখান থেকে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের সাথে ২৩৮ রানের জুটির পথে ৩৮৮ মিনিট ব্যাটিং করে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করে দলকে জেতান ল্যাঙ্গার! সময়ের হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সবচেয়ে মন্থর সেঞ্চুরিও ছিল সেটি। ধীরে ধীরে নিজেকে করে তুলেছিলেন দলের নিয়মিত এই মুখ।
বছরের শেষটা অবশ্য ভাল যায়নি ল্যাঙ্গারের। ভারতের বিপক্ষে দুই টেস্টেই করেন হতাশাজনক পারফরম্যান্স। তবে তৃতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসেই ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি গড়েন তিনি। বছরের প্রথম টেস্ট খেলতে নেমে প্রথম ইনিংসেই গড়েন অসাধারণ এক ডাবল সেঞ্চুরি। ২০০১ সাল পর্যন্ত তিন নম্বরেই খেলছিলেন নিয়মিত। এরপর ২০০১ সালে ভারতের বিপক্ষে ২-১ এ সিরিজ হারের পরই বাদ পড়েন ল্যাঙ্গারের।
পরবর্তীতে মাইকেল স্ল্যাটারের ইনজুরিতে কপাল খুলে যায় ল্যাঙ্গারের। প্রথমবার সুযোগ পেলেন ওপেনিংয়ে! আর প্রত্যাবর্তনের ম্যাচে ওপেনিংয়ে নিজের প্রথম ইনিংসেই করলেন অসাধারণ এক সেঞ্চুরি! ম্যাথু হেইডেনের সাথে ওপেনিংয়ের শুরুটা সেখানেই। ওপেনিংয়ে দু’জনের রূপকথার গল্পটা এখানেই শুরু। এখান থেকেই দু’জনে মিলে বনে যান অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের সেরা ওপেনিং জুটি!
ওপেনিংয়ে প্রমোট করার পর থেকেই ক্যারিয়ার বদলে যায় ল্যাঙ্গারের। প্রথম পাঁচ টেস্টেই ওপেনিংয়ে করেন চার সেঞ্চুরি আর এক ফিফটি। ‘অনিয়মিত’ শব্দটা ছেঁটে ফেলে দিয়ে বনে গেলেন দলের নিয়মিত এক মুখ।
২০০২-০৩ অ্যাশেজ সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মেলবোর্নে করেন ক্যারিয়ার সেরা ২৫০ রান। দেখা মিলেছিল ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরির। এরপর ২০০৪ সালে পার্থে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে গড়েছিলেন অদ্ভুত আক্ষেপের এক কীর্তি! ওই টেস্টের দুই ইনিংসে ল্যাঙ্গার করেছিলেন ১৯১ ও ৯৭ রান! অপরদিকে, টেস্টে পাকিস্তান দল দুই ইনিংসে করেন ১৭৯ ও মাত্র ৭২ রান! ইতিহাসে প্রথম ব্যাটার হিসেবে দুই ইনিংসে ১৯০ ও ৯০ এর ঘরে আউট হন ল্যাঙ্গার।
২০০৫ অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়া হারলেও দলের হয়ে ৩৯১ রান করে সেরা পারফর্মার ছিলেন তিনি। ২০০৬ পর্যন্ত দলের নিয়মিত মুখই ছিলেন ল্যাঙ্গার। প্রায় সাত বছর ধরে ছিলেন দলের অন্যতম এক আস্থা আর ভরসা।
বয়সটা তখন ৩৬! ল্যাঙ্গারের ক্যারিয়ার তখন প্রায় শেষের দিকে। দুই ওপেনারের উপর চাপ কমাতে অস্ট্রেলিয়ার টিম ম্যানেজমেন্ট সিদ্ধান্ত নিলো তরুনদের সুযোগ দিবেন। ইনজুরির সাথেও অনেকটা লড়াই করছিলেন ল্যাঙ্গার। এরপর ইনজুরিতে ছিটকে যাওয়ায় তরুণ ফিল জ্যাকসকে সুযোগ দেওয়া হল ল্যাঙ্গারের বদলি হিসেবে।
ল্যাঙ্গার ভেবেছিলেন ক্যারিয়ারের শেষটা হয়ত দেখে ফেলেছেন। মাঠ থেকে বিদায় হয়তো নেওয়া হবে না। তবে নির্বাচকরা আবার সেই সুযোগটা করে দিয়েছিল ল্যাঙ্গারকে।
২০০৬-০৭ অ্যাশেজ সিরিজে ফিল জ্যাকসকে টপকে দলে সুযোগ পেয়েছিলেন ল্যাঙ্গার। প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরি ও ৮২ রানের এক ইনিংস খেলেছিলেন। ওই সিরিজের শেষ ম্যাচেই ঘোষণা দেন টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের। টেস্টে অবসর! অর্থাৎ ওয়ানডে খেলবেন?! কিন্তু ওয়ানডেতে ক্যারিয়ারে শুরুতে যে আট ম্যাচ সুযোগ পেয়েছিলেন, এরপর আর সুযোগই পাননি। তাই বলা চলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকেই অবসরের ঘোষণাটা দিয়ে দেন ল্যাঙ্গার! কারণ রঙিন পোশাকে নিজেকে চেনানোর সেই সুযোগই যে তিনি পাননি।
ঘরোয়া ক্রিকেটে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলেছেন ক্যারিয়ারের প্রায় ১৭ বছর! ধারাবাহিক পারফরম্যান্স করলেও রঙিন পোশাকে সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র ৮ ম্যাচ! এছাড়া কাউন্টি ক্রিকেটেও মিডলসেক্স ও সমারসেটের হয়ে খেলেছেন দীর্ঘ সময়।
রঙিন জার্সিতে সুযোগ না পেলেও সাদা পোশাকে নিজেকে রেখেছেন সময়ের অন্যতম সেরা ওপেনার হিসেবে। ম্যাথু হেইডেনের সাথে প্রায় একশোর বেশি টেস্টে জুটিতে ৫১ গড়ে ৫৬৫৪ রান করেন! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই জুটি আছে দুইয়ে। ৬৪৮২ রান নিয়ে সবার উপরে আছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের গর্ডন গ্রিনিজ ও ডেশমন্ড হেইনস।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অবসরের দুই বছর পরই বিদায় জানান ঘরোয়া ক্রিকেটকেও। এরপর ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়া টেস্ট দলের সহকারী ব্যাটিং কোচ হিসেবে দায়িত্ব পান। কাজ করেন ঘরোয়া ক্রিকেটেও। ২০১৮ সালে ‘স্যান্ডপেপার’ কান্ডের পর ঘৃণায় জর্জরিত অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন ল্যাঙ্গার।
দলকে টেনে তুলে আবার দাঁড় করান সাবেক এই ওপেনার। সেখান থেকে তিন বছরের মাথায় তার অধীনেই চলতি বছর ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয় করে অজিরা। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের পর কোচ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে নিজের সফলতার ছাপ রাখেন ল্যাঙ্গার।
ক্রিকেট ছাড়াও মার্শাল আর্টে ল্যাঙ্গার ছিলেন ব্ল্যাক বেল্টধারী। ল্যাঙ্গারকে অনেকেই ডাকতেন ‘আলিফে’ নামে। এই আলিফে নামটিও রাখা হয় অস্ট্রেলিয়া রাগবি সুপারস্টার অ্যালান জেফ্রি ল্যাঙ্গারের নাম থেকে। সতীর্থরা অবশ্য ‘জেএল’ নামেই ডাকে তাঁকে।
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হলেন ল্যাঙ্গার। ৫০.২৩ গড়ে পুরো ক্যারিয়ারে করেছেন ২৮৩৮২ রান। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের পর সর্বোচ্চ সেঞ্চুরিও তাঁর দখলে। পুরো ক্যারিয়ারে ল্যাঙ্গার সেঞ্চুরি করেছেন ৮৬টি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০৫ টেস্টে ৪৫ গড়ে ৭৬৯৬ রান করেছেন তিনি। নামের পাশে যোগ করেছেন ২৩ সেঞ্চুরি। অপরদিকে ৮ ওয়ানডেতে করেছেন মাত্র ১৬০ রান।
ল্যাঙ্গারের ব্যাপারে একটা অজানা তথ্য হল ক্যারিয়ারের শুরুতে তিনি ছিলেন একজন উইকেটরক্ষক ব্যাটার। এমনকি ১৯৯৪ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নিজের ওয়ানডে অভিষেক ম্যাচে একজন জেনুইন কিপার ব্যাটার হিসেবেই খেলেছিলেন তিনি। ২ ক্যাচ আর এক স্টাম্পিংও করেছেন নিজের নামে। তবে পরবর্তীতে ওয়ানডেতেও আর ভীত জমাতে পারেননি, সাদা পোশাকেও ক্যারিয়ারের বাকি সময় ছিলেন পুরোদস্তুর ওপেনার হিসেবে।