এটাই কি আপনার প্রাপ্য ছিল কপিল দেব!

কপিল দেব রাম লাল নিখাঞ্জ,

আপনি হৃদয় উপুর করে ক্রিকেট খেলতেন। আপনি হৃদয় দিয়ে কথা বলেন। হৃদয়ের ডাক শুনে কী হল বলুন তো? হৃদয়ের কথা বলেইবা কী লাভ হলো? তেইশের বিশ্বকাপ ফাইনালে আপনি আমন্ত্রণই পেলেন না।

কপিল দেব রাম লাল নিখাঞ্জ, আপনি দেশের প্রথম বিশ্বজয়ী অধিনায়ক। সেই আপনিই কিনা।

রবিবার রোহিত শর্মার ‘টিম ইন্ডিয়া’ ২৪০ রানের পুঁজি নিয়ে লড়েও বিশ্বকাপ ঘরে তুলতে পারল না। শোকে পাথর গোটা দেশ। আমিও শোকে মূহ্যমান।

রোহিত শর্মাদের খেলা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে আপনাদের কাজটা সত্যিই কঠিন ছিল। অসম্ভব কঠিন। কতটা কঠিন তা আমার পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

হাতে মোটে ১৮৩ রান। আর সেই রান নিয়ে বিশ্বকাপ ঘরে তোলা যায়! এও কি সম্ভব!

ওহ একটা কথা তো বলাই হল না। আপনাদের প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। রিচার্ডসের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গ্রিনিজের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। হেইন্সের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাক্কাসের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। হোল্ডিংয়ের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গার্নারের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মার্শালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ, রবার্টসের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বিভীষিকার নাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মাটি ধরিয়ে লর্ডসের ব্যালকনিতে কাপ হাতে তুললেন আপনি। তার পর সেই ভুবনভোলানো হাসি। লর্ডসের ব্যালকনিতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জামা ওড়ানোর বহু আগেই যে আপনি বিজয়কেতন উড়িয়েছিলেন।

কপিল দেব রামলাল নিখাঞ্জ, কী করে ভুলি আপনার সেই হাসি। তখন তো আমার প্রজন্ম হাঁটি হাঁটি পা পা করছে।

শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিশ্বজয়ী কপিল’ পড়ে আপনার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়।

অলস দুপুরে আমার মা পাতা উলটে উলটে পড়ে শোনাতেন আপনার কিংবদন্তি হয়ে ওঠার গল্প।

আপনার কোচ দেশপ্রেম আজাদকে একবার বলেছিলেন, ‘স্যার, চিন্তা করবেন না। আমরা একশো করেছি তো কী হয়েছে? ওদের পঞ্চাশের আগে ফেলে দেব।’ বল হাতে করেওছিলেন তাই। আপনি হৃদয় দিয়ে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে হৃদয় উপুর করেও যে খেলতেন!

কপিল দেব রামলাল নিখাঞ্জ,

আপনার ক্রিকেটের মতোই আপনি সহজ-সরল। রাজধানীর ভরা রাজপথে নারী কুস্তিগিরদের অসম্মানিত, লাঞ্চিত হতে দেখেও দেশ চুপ থাকল।

শচীন রমেশ টেন্ডুলকার চুপ। সৌরভ গাঙ্গুলি চুপ। রাহুল দ্রাবিড় চুপ। বিরাট কোহলি চুপ। রোহিত শর্মা চুপ। এরকম অনেকেই চুপ থাকলেন।

আর আপনি! লিখে ফেললেন, ‘উইল দে এভার গেট জাস্টিস?’ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল আপনার সেই পোস্ট। ভালো লাগল না অনেকের।

আমার মনে পড়ছে শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষের অবিস্মরণীয় কিছু লাইন-

তুমি বললে মানবতা

আমি বললে পাপ

বন্ধ করে দিয়েছে দেশ

সমস্ত তার ঝাঁপ

তুমি বললে হিটলারিও

জনপ্রেমে ভরা

আমি বললে গজদন্ত

তুমি বললে ছড়া…

কপিল দেব রামলাল নিখাঞ্জ,

হৃদয়ের কথা সবসময়ে বলতে নেই। সেদিন আপনি বাকিদের মতো চুপ করে থাকলে অভিমানী আপনাকে রবিবার আর বলতে হতো না, ‘বড় ইভেন্ট সামলাতে হয়তো ওরা ব্যস্ত ছিল। কাভি কাভি লোগ ভুল যাতে হ্যায়।’

আপনাকেই আমরা ভুলে গেলাম কপিল দেব রামলাল নিখাঞ্জ! চল্লিশ বছর আগের এক পৃথিবীতে আপনার নেতৃত্বে ভারত চ্যাম্পিয়ন না হলে, আজকের দিনটিই যে আসত না।

টলমলে পায়ে হাঁটতে থাকা দেশের ক্রিকেট যে আজ বড় বড় লাফ দিতে পারত না। ধোঁয়া ধোঁয়া সাদা-কালো ছবিগুলোও যে রঙিন হতো না।

বড় দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। বিরুদ্ধ মত এদেশে গ্রহণীয় নয়। মুখ খুললে তুমি শত্রু। অন্যায়ের প্রতিবাদ দেখে চুপ করে থাকাই শ্রেয়। গর্জে উঠলেই তুমি অন্য পক্ষ।

কপিলদেব রামলাল নিখাঞ্জ, ‘আইডল’ বইতে গাভাস্কার আপনার সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘মোস্ট ন্যাচারাল ক্রিকেটার’। সহজিয়া আপনার ক্রিকেট। সহজিয়া আপনার জীবনচর্যা।

আপনার ঈশ্বরদত্ত আউটসুইংয়ের সঙ্গে সন্ধি কে কবে করতে পেরেছে! একবার অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে অ্যালান বর্ডারকে দুই ইনিংসে একই রকম আউটসুইংয়ে বোল্ড করেছিলেন আপনি। বর্ডারের ব্যাট আর প্যাডের মধ্যে যে সামান্য ফাঁক রয়েছে, তা দিয়ে গলে গিয়েছিল বল।

কপিলদেব রামলাল নিখাঞ্জ, পরিবেশ-পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। মানুষ আর সহজ নেই। আমরা ভুলে যাচ্ছি সব। কাজের চাপে ভুলছি। ইচ্ছা করে ভুলছি। রাজনীতি করে ভুলছি।

আপনাকে কী করে ভুলি মিস্টার ক্যাপস!

ওই তো, ওই তো ফলো থ্রুতে বুটের টোকা দিয়ে বল নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন। ঘাড় ঘুরিয়ে সূর্যের দিকে তাকাতে তাকাতে ব্যাট করতে নামছেন আপনি। ওই তো ভিভের ক্যাচটা ধরার জন্য কেমন আকাশের দিকে চেয়ে দৌড়চ্ছেন।

নরেন্দ্র হিরওয়ানিকে সঙ্গে নিয়ে এডি হেমিংসকে চার ছক্কা মারছেন। গালে সাবানের ফেনা নিয়ে কেমন করে বলছেন, ‘‘পামোলিভ কা জবাব নেহি’।

কপিলদেব রামলাল নিখাঞ্জ, আপনাকে কি ভোলা সম্ভব! পড়শি দেশেও যে আপনি শ্রদ্ধার আসন পান।

পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার বাসিত আলী বলেছিলেন, ‘অনেকেই এটা জানেন না। কপিল পাজির বাবা আর আমার বাবা আগে হরিয়ানায় এক মহল্লায় থাকতেন। পড়তেন একই স্কুলে। দু’জনে একসঙ্গে কত ভলিবল খেলেছেন। দেশভাগের ফলে দুই বন্ধুর দেশ বদলে যায়। কিন্তু দু’জনের ভালবাসায় কোনও কমতি ছিল না।’

পাকিস্তান সফরে গিয়ে বাসিতের বাড়িতে গিয়েছিলেন আপনি, কপিল দেব রামলাল নিখাঞ্জ। তখন বাসিত আলী খুব ছোট। তাঁর বাবার জন্য হাতে করে কোলাপুরি জুতো আর কুর্তা নিয়ে গিয়েছিলেন আপনি। সেই কুর্তা পরে প্রতি শুক্রবার নমাজ পড়তে যেতেন বাসিত আলির বাবা। সাবেক পাক ক্রিকেটারের বাবা কোলাপুরি জুতোটা আগলে রাখতেন।

কপিলদেব রামলাল নিখাঞ্জ, আপনি ওয়াঘার ওপারে সমাদৃত। আপনি অস্ট্রেলিয়ায় প্রণম্য, ওয়েস্ট ইন্ডিজেও। ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড সম্মান করে আপনাকে।

এদেশেই আপনি ব্রাত্য। এটাই কি আপনার প্রাপ্য ছিল কপিল দেব রামলাল নিখাঞ্জ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link