নাইটওয়াচম্যানের নীরব লড়াই

নিজের শেষ টেস্টটা স্মরণীয় করে রাখতে ক’জনই বা পারে বলুন? হাতে গোনা কয়েকজন। সে গুটিকতক খেলোয়াড়দের মধ্যে রয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার এক সময়ের পেস বোলার জেসন গিলেস্পি। না তিনি তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টটা বল হাতে নয় স্মরণীয় করে রেখেছেন ব্যাট হাতে দূর্দান্ত এক ইনিংস খেলে। তবে, গিলেস্পি তখনও জানতেন না যে সেটাই হতে যাচ্ছে তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট।

ক্রিকেটে ‘নাইট ওয়াচম্যান’ শব্দটা বেশ প্রচলিত। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে। ২০০৬ সালের এমন এক এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে টেস্ট সিরিজ খেলতে এসেছিল অস্ট্রেলিয়া। সে দলের সঙ্গী ছিলেন গিলেস্পি। সঙ্গী ছিলেন বললে ভুল হবে। তিনি ছিলেন অন্যতম সেরা পারফরমার। বাংলাদেশ তখনও টেস্ট ক্রিকেটে নবজাতক। প্রথম দিনেই অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ।

দিনের খেলার তখনও বাকি ছিল ত্রিশ ওভারে কাছাকাছি। অস্ট্রেলিয়া ব্যাটিং করতে নেমে দুই ওপেনার ম্যাথু হেইডেন ও ফিল জ্যাকসের উইকেট হারিয়ে ফেলে। অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের আগে দিনের খেলাটুকু শেষ করে আসার জন্যে নামানো হয়েছিল গিলেস্পিকে। তিনি সেদিন শুধু প্রথম দিনের শেষ সেশনটুকু সামলে নেননি। তিনি পরদিনও ব্যাটিং করেছিলেন বীরদর্পে। পন্টিংয়ের সাথে ৯০ রানের জুঁটি গড়েন।

সেখানেই হয়ত শেষ হতে পারত গল্প। না গিলেস্পি যেন নিজের জীবনের সেরা উপন্যাসটুকু লিখে রেখে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি তাই করেছিলেন। দ্বিশতকের এক বিশাল বড় উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। ১৯ এপ্রিল ১৯৭৫ সালে জন্মেছিলেন সিডনিতে। সেখানেই ক্রিকেটের সাথে সখ্যতা, ক্রিকেটের সাথে বেড়ে ওঠা। তিনি তাঁর বাসার গ্যারেজে স্ট্যাম্প এঁকে একটানা বোলিং করে যেতেন খুব ক্ষুদে বয়স থেকেই।

সে সময়ের আর দশটা শিশুর মতই গিলেস্পিও ডেনিস লিলির বোলিং অ্যাকশন অনুকরণ করার চেষ্টা করতেন। তিনি এতটাই ক্রিকেতে মগ্ন ছিলেন যে ১৯৮৫ সালের দিকে মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি বর্ষসেরা জুনিয়র ক্রিকেটারের খেতাব জেতেন তাঁর শৈশবের ক্লাবের হয়ে। বয়সের সাথে তাঁর ক্রিকেটের পরিপক্কতাও আসতে শুরু করে। মাঝে স্বপরিবারে পারি জমান অ্যাডিলেডে।

সেখানেই তাঁর ক্রিকেটার হয়ে গড়ে ওঠার ‘ফাইন টিউনিং’ চলতে থাকে অ্যাডেলেড ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে। সেখান থেকেই দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া স্টেট দলের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে আলো কাড়তে শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে পা রাখা গিলেস্পি বছর দুই বাদেই নিজেকে আবিষ্কার করেন বিশ্বকাপ দলে। উপমহাদেশে অনুষ্ঠিত হওয়া ১৯৯৬ বিশ্বকাপের অন্যতম আয়োজক দেশ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এক ম্যাচে দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের রঙিন পোশাকে পদার্পণ করেন জেসন গিলেস্পি।

সেখানে খুব একটা ভাল সময় পার করেছেন তাঁর বলার সুযোগ না থাকলেও ওয়ানডে দলে তাঁর অন্তর্ভুক্তিতে সে পারফরমেন্স অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে অভিষেক হয় তাঁর। এরপর থেকে শুরু হয় সেরা হবার যাত্রা। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে পঞ্চম সফল বোলার হিসেবে গন্য করা হয় গিলেস্পিকে।

তিনি অস্ট্রেলিয়ার আরেক গতিদানব গ্লেন ম্যাকগ্রার সাথে জুঁটি বেঁধে শাসন করেছেন বাইশ গজ। তবে গিলেস্পি তাঁর বোলিং অপেক্ষা তাঁর রকস্টারের মত লম্বা চুলের জন্যে বেশি প্রসিদ্ধ ছিলেন। তবে বোলিংটা যে একেবারেই খারাপ করতেন তাও কিন্তু নয়। টেস্টে তাঁর উইকেটে কলামে উইকেটের সংখ্যা ২৫৯টি, ওয়ানডেতে সেটা ১৪২। লাল বলে তাঁর গড় ২৬.১৩, আর সাদা বলে ২৫.৪২।

তবে তাঁর ক্যারিয়ারটা হয়ত আরেকটু সমৃদ্ধ হতে পারত, পরিসংখ্যানগুলো আরেকটু হৃষ্টপুষ্ট হতে পারত। তবে সেখানটায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইনজুরি। নানান রকমের ইনজুরি তাঁর ক্যারিয়ারের একটা বড় সময় কেড়ে নেয় তাঁর কাছ থেকে। সে সাথে একেবারেই বিতর্কমুক্তও থাকতে পারেননি তিনি। নিজের আদিবাসি শেকড়ের কথা লুকিয়ে তিনি হয়েছিলেন সমালোচিত। তব সব ছাপিয়ে তিনি ছিলেন একজন দূর্দান্ত বোলার।

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের মাঝামাঝি হয়ে তাঁর ক্যারিয়ার যখন গোধুলী লগ্ন ছুঁয়ে ফেলেছে ঠিক তখনই তিনি  বর্ণিল করে নেন ক্যারিয়ার। বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজের খেলা শেষ টেস্টে তিনি পন্টিংয়ের সাথে প্রায় শত রানের জুটি গড়ার পাশপাশি তিনি মাইকেল হাসির সাথে গড়েছিলেন ৩২০ রানে জুটি। ক্রিকেট ইতিহাসে সত্যিকার নাইট ওয়াচম্যানদের মধ্যে তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে তিনি শতক হাঁকিয়ে কীর্তি গড়েন।

তবে শতকেই থেমে যাননি তিনি। নিজের ইনিংসকে বড় করেছেন। ধরে খেলে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন তিনি। মার্ক ওয়াহ, ইয়ান চ্যাপেল, মাইকেল অ্যাথারটন, অ্যান্ড্রু স্ট্রস, মাইকেল ভনদের মত নন্দিত ব্যাটারদের ক্যারিয়ারে যে আক্ষেপ রয়ে গেছে সে কাজটা গিলেস্পি করে গেছেন নিজের শেষ টেস্ট ম্যাচে। শতকটাকে টেনে তিনি পার করেন ২০০ রানের মাইলফলক।

সেটাই অবশ্য তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম ও শেষ শতক। এর আগে তাঁর সর্বোচ্চ রান ছিল কেবলমাত্র ৫৪। নিজেকে ছাড়িয়ে গিয়ে আবারও সেই প্রবাদটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলেন ‘শেষ ভাল যার, সব ভাল তাঁর।’ যদিও তাঁর শেষটা নিয়ে রয়েছে ধোয়াশা, বিতর্ক কিংবা চর্চা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link