Social Media

Light
Dark

আর কোনো ৪ নম্বর থাকতেই পারে না!

১.

মেক্সিকোর দক্ষিণে শিয়াপাস অঞ্চল। নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই আগ্রাসী অর্থনৈতিক নব্য উদারনীতিকরণের আঁচ লাগল এখানেও। আইনানুগ জমির মালিকানার চরিত্র বদল, উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য নীতি-সহ একাধিক প্রকল্পের মাধ্যমে শোষণ বেড়ে চলল, বিশ্বায়নের চুম্বনে শঙ্কিত হল আঞ্চলিক অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি।

রুখে দাঁড়ালেন মূলনিবাসী মানুষ, ‘জাপাতিস্তা’দের আন্দোলন দানা বাঁধল ১৯৯৪ সাল থেকেই। কখনও সশস্ত্র, কখনও অন্যান্য পথে। পাশে দাঁড়ালেন দুই আমেরিকা মহাদেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা।

দশ বছর পরে ইতালির মিলানের ক্লাব ইন্টার থেকে এল অর্থ সাহায্য, একটা অ্যাম্বুলেন্স, ইন্টারের চার নম্বর জার্সি এবং একটা চিঠি। নেপথ্যে এক আর্জেন্টাইন, ইন্টারের ‘এল কাপিতানো’ খাভিয়ের জানেত্তি। জার্সিটা তাঁর, চিঠির প্রেরকও তিনি। চিঠিতে তিনি লিখলেন- ‘আমরা বিশ্বায়ন-হীন এক উন্নত পৃথিবীতে ভরসা রাখি, যে পৃথিবী সমস্ত মানুষের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা আর রীতিকে মর্যাদা দেয়। ঠিক এই কারণেই আপনাদের শিকড় রক্ষার আদর্শ ও লড়াইয়ের প্রতি আমাদের হাত বাড়িয়ে দিতে চাই।’

ইউরোপের কোটিপতি তেল ব্যবসায়ী মাসিমো মোরাত্তির ক্লাব ইন্টারের এমন কাজ সম্ভব হয়েছিল জানেত্তির আবেদনের জন্যই। ক্লাবের এই কিংবদন্তির কথা অগ্রাহ্য করতে পারেননি কেউই!

২.

১৯৯৫-এ মাসিমো মোরাত্তি ক্লাবের দায়িত্বে আসার পর থেকে একাধিক লাতিন আমেরিকান ফুটবল প্রতিভা ইন্টারে আসতে থাকে। আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব-২২ দলের প্রতিভাবান ফরোয়ার্ড এরিয়েল ওর্তেগাকে দেখার জন্য একটা ভিডিও ক্যাসেট এসে পৌঁছায় মোরাত্তির কাছে।

অথচ খেলা দেখতে দেখতে চোখ চলে যায় অন্য এক ফুটবলারের দিকে। খুবই সামান্য দামে ব্যানফিল্ডের রাইট ব্যাক খাভিয়ের জানেত্তি যোগ দেন ইন্টারে। সঙ্গে স্বদেশী প্রতিভাবান স্ট্রাইকার রাম্বার্ট। একই বছরে আসেন পরবর্তীকালে ব্রাজিলের কিংবদন্তি হয়ে ওঠা লেফট ব্যাক রবার্তো কার্লোস। খেলোয়াড়দের যেদিন দর্শকদের সামনে আনা হচ্ছিল সাধারণ চেহারার জানেত্তিকে দেখে দর্শকদের অনেকেই নাকি অবাক হয়েছিলেন!

ইন্টারে আসা যাওয়া চলতে থাকে দক্ষিণ আমেরিকানদের। রোনাল্ডো, রেকোবা, জামোরানো, বাতিস্তুতা, ক্রেসপো, ক্রুজ, স্যামুয়েল, লুসিও, ক্যাম্বিয়াসো, মাইকন, আদ্রিয়ানো, জুলিও সিজার, মিলিতো এরকম কত কত তারকাদের পাশে চেনা অচেনা অজস্র নাম। কেউ কেউ দুরন্ত পারফরম্যান্সে ভর করে চলে গেলেন অন্য ক্লাবে, কেউ বা মানিয়ে নিতে পারলেন না, আবার কেউ কেউ ক্লাবেই থিতু হয়ে গেলেন।

তবে সবাইকে ছাপিয়ে জানেত্তি রইলেন একটানা ১৮ বছর! ১৯৯৫ থেকে ২০১৪। এর মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে চেলসি সব বড় ক্লাবের প্রস্তাবই ফিরিয়ে দিলেন সমর্থকদের আদরের ‘এল ট্রাক্টর’। তাঁকে ফুটবল বিশ্বে পরিচিতি দিয়েছে ইন্টার, তাই ইন্টার ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না!

রাইভাল ক্লাব এসি মিলানের অধিনায়ক প্রবাদপ্রতিম মালদিনি আর ইন্টারের অধিনায়ক জানেত্তি। বছরের পর বছর এই ছবি দেখে এসেছে বিশ্ব ফুটবল।

ফুটবলার হিসেবে কেমন ছিলেন জানেত্তি?

ফুলব্যাক হিসেবে ডিফেন্সিভ রোলের বিচারে সমকালীন মালদিনি কিংবা কাফুর থেকে খানিক পিছিয়েই থাকবেন হয়তো। আক্রমণের দিক থেকেও রবার্তো কার্লোসকে এগিয়ে রাখতেই হবে। তবু জানেত্তি আধুনিক ফুটবলের পরিভাষায় একজন মাল্টিফাংশনল খেলোয়াড় হিসেবে বাকিদের থেকে আলাদা ভাবে উচ্চারিত হবেন।

তিনি রাইট ব্যাকে, রাইট উইং ব্যাকে, কখনও ইনভার্টেড উইং ব্যাক হিসেবে (বিয়েলসার সিস্টেমে), প্রয়োজনে লেফট ব্যাক হিসেবে আবার ক্যারিয়ারের শেষ দিকে একটা বড় সময় মিডফিল্ডার হিসেবে খেলেছেন। ২০১০ সালে ইন্টারের ত্রিমুকুট জয়ের মরসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে নক আউটে মোরিনহো এক রাউন্ডে জানেত্তিকে খেলিয়েছেন লেফট ব্যাকে আবার পরের রাউন্ডে তাঁকে ব্যবহার করেছেন মিডফিল্ডার হিসেবে।

২০১০-এ বার্সেলোনার বিরুদ্ধে ইন্টারের ঐতিহাসিক জয়ের দুই পর্বেই জানেত্তি খেলেছেন লেফট ব্যাক হিসেবে; আবার ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের বিরুদ্ধে তিনি খেলেছেন মিডফিল্ড ডাবল পিভটে, স্বদেশীয় ক্যাম্বিয়াসোর সঙ্গে জুটি বেঁধে। সেমি ফাইনালে স্বদেশীয় মেসির বিরুদ্ধে ‘জেলখানা’ তৈরির প্রকল্পে জানেত্তির বড় অবদান ছিল।

এত বৈচিত্র্য-সহ বিভিন্ন রোলে নিজেকে অনায়াসে মানিয়ে নিতে পারার ক্ষমতাই তাঁকে ফুটবল ইতিহাসে স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছে। পরবর্তীকালে জার্মানির ফিলিপ লাম কিংবা কিমিখকে এরকম বৈচিত্র্যময় রোলে বারবার দেখা গিয়েছে। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে রয় হজসন, মার্সেলো লিপ্পি, হেক্টর কুপার, মানচিনি, বেনিতেজ, রানিয়েরি-র মত নানা কোচের প্রশিক্ষণে বিবিধ ফুটবল সিস্টেমে খেলার পারদর্শিতাই হয়তো জানেত্তিকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল।

৪.

শৈশবে জানেত্তির বেড়ে ওঠার গল্পটা আরও পাঁচজন আর্জেন্টাইন ফুটবল তারকার মতই। বুয়েনোস আইরেস-এর মূল শহরের বাইরে কুখ্যাত জায়গায় দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বড় হওয়া। কখনও ভোরে উঠে বাড়ি বাড়ি দুধ পৌঁছে দেওয়া কিংবা নির্মাণ শ্রমিক বাবার কাজে ইট বয়ে দেওয়া – এসব পেরিয়ে শীর্ণকায় জানেত্তির পক্ষে আন্তর্জাতিক ফুটবলে জায়গা করে নেওয়া সহজ ছিল না।

ফুটবল জীবনের প্রথম দিকে যথেষ্ট শারীরিক শক্তি না থাকায় তেমন ভাবে পাত্তা পাননি। ফলে এ ক্লাব সে ক্লাব ঘুরে ব্যানফিল্ডে আসা। সেখানেই প্রতিভার বিচ্ছুরণ আর সেখান থেকেই ইন্টারে পাড়ি। তারপরে আর পিছনে ফিরে তাঁকাতে হয়নি। ১৯৯৯ এই ইন্টারের অধিনায়ক।

আর্জেন্টিনার যুব দল পেরিয়ে ১৯৯৪-এই সিনিয়র দলে সুযোগ মেলে। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে করা বিখ্যাত ফ্রি-কিক গোলে ট্রেনিং অনুযায়ী পা ছোঁয়ানোর কথা ছিল এরিয়েল ওর্তেগার। দীর্ঘ চার বছর ধরে প্রশিক্ষক পাসারেল্লার তত্বাবধানে ওই সেট পিস অনুশীলন করতেন আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা। কিন্তু ম্যাচের মাঝে কোচের নির্দেশ পাল্টে যায়, দায়িত্ব এসে পড়ে জানেত্তির ওপর, গোল করার ক্ষেত্রে ভুল করেননি তিনি।

বিয়েলসা দায়িত্ব নেওয়ার পরে জানেত্তি আর্জেন্টিনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন। তাঁর নিজের কথাতেই স্পষ্ট, ফুটবল আরও ভাল করে শেখার জন্য বিয়েলসার কোচিং তাঁর দরকার ছিল। ২০০২ বিশ্বকাপে অন্যতম দাবিদার হিসেবে শুরু করেও আর্জেন্টিনার গ্রুপ লিগ থেকে বিদায়ে শেষ হয়ে যায় জানেত্তির বিশ্বকাপ অধ্যায়।

খানিক আশ্চর্যজনক ভাবেই। ২০০৬ সালে পেকেরম্যান কী কারণে জানেত্তিকে বিশ্বকাপ দলে রাখেননি তা স্পষ্ট করেননি তিনি, অবাক হয়েছিল ফুটবলবিশ্বও। অন্যদিকে, জানেত্তিকে সব সময় প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন যিনি সেই দিয়েগো মারাদোনাও ২০১০ সালে দলে রাখেননি জানেত্তিকে। অথচ তার কিছু মাস আগেই ইন্টারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ে বিশাল অবদান ছিল এল কাপিতানোর।

আর বিশ্বকাপ না খেললেও আর্জেন্টিনার হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলেছেন তিনি। একই সঙ্গে ইন্টারের হয়ে সর্বোচ্চ ৮৫৮টা ম্যাচ খেলেছেন প্রায় দীর্ঘ তিন দশকের সময়সারণী ধরে।

৫.

সারা মাঠ চষে ফেলতে পারতেন অক্লান্ত পরিশ্রমে। তাই আর্জেন্টিনাতে থাকাকালীনই সমর্থকেরা ভালবেসে নাম দিয়েছিল ‘এল ট্রাক্টর’। ২০০১-এ ইন্টারের অধিনায়ক হওয়ার পরে সেই ডাকনাম উধাও হয়ে গিয়েছিল, ইল ক্যাপিতানো-ই তখন তাঁর পরিচয়। যদিও পরিশ্রমের দিক থেকে খেলায় কোনও পার্থক্য আসেনি। হোসে মোরিনহো তাঁর প্রশিক্ষণাধীন প্রিয় অধিনায়ক ও নেতা হিসেবে টেরির সঙ্গে বেছে নিয়েছেন জানেত্তিকে।

স্বভাবজাত নেতৃত্ব দানের ক্ষমতাই তাঁকে ক্লাবে রেখেছে ২০১৪ সাল পর্যন্ত। ইন্টারের হয়ে জীবনের শেষ ম্যাচে যখন খেলতে নামছেন জানেত্তি তখন তাঁর অধিনায়কের আর্মব্যান্ডে জ্বলজ্বল করছে তাঁর অধিনায়কত্বে খেলে আসা সমস্ত সতীর্থ খেলোয়াড়দের নাম।

ফুটবল জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ কী? জানেত্তি একাধিকবার জানিয়েছেন ব্রাজিলিয়ান সতীর্থ আদ্রিয়ানোকে গভীর ডিপ্রেশন থেকে ফিরিয়ে আনতে না পারা অধিনায়ক হিসেবে তাঁর একরকম ব্যর্থতা। বাবার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে আদ্রিয়ানো জীবন ও ফুটবলের প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, প্রবল সম্ভাবনাময় ফুটবলজীবন ঢেকে যায় অন্ধকারে।

লাতিন আমেরিকান খেলোয়াড়দের জীবন বড়ই বৈচিত্র্যময়। এক মুহূর্তে আলোর বিচ্ছুরণ, পরক্ষণেই ধেয়ে আসে বিতর্ক। ইউরোপীয় ফুটবল সংস্কৃতির মানদণ্ডের নিরিখে বারবার করে আতসকাঁচের তলায় ধরা পড়ে আফ্রিকা কিংবা লাতিন আমেরিকান ফুটবলারদের ভিন্নধর্মী সাংস্কৃতিক বহি:প্রকাশ, তাদের ব্যবহার। জানেত্তি এসবকে এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন, বরাবরের স্থিতধী, মাথা গরম না করা খেলোয়াড় হিসেবেই তাঁকে জেনে এসেছে ফুটবল দুনিয়া।

ক্যারিয়ার জুড়ে চোট আঘাতও তাঁকে তেমন কাবু করতে পারেনি। আর ছিল অবিচল লক্ষ্য। বারো বছর বয়স থেকে চুল কাটার ধরণ বদলে ফেলেছিলেন, খেলার আগে সেই ট্রেডমার্ক চুলের বিন্যাস একটু ঘেঁটে গেলেও সেটা ঠিক করতেই হত তাঁকে। যেন চুলেই বাঁধা পড়ে ছিল তাঁর পারফরম্যান্সের রহস্য।

৬.

একুশ শতাব্দীর আইকনিক ফুটবলারদের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে ব্র্যান্ড, বিজ্ঞাপনের ঝকঝকে দুনিয়া। ফুটবলের বিশ্বায়নে সহজ পণ্য হয়েছেন খেলোয়াড়রা। এরকম সময়ের প্রতিনিধি হয়ে কোন খেলোয়াড় চাইবেন সুদূর মেক্সিকোয় বিশ্বায়ন বিরোধী গেরিলাদের সাহায্য করতে? জাপাতিস্তাদের সঙ্গে ইন্টারের হয়ে খেলতে চেয়েছিলেন এক ফুটবল ম্যাচও যদিও সেই ম্যাচ আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। এত কিছু ‘অন্যায়’ আবদার সত্ত্বেও ক্লাবের সমর্থক থেকে কর্তাদের কাছে তিনি দলের সম্পদ।

ইন্টার তাঁকে বিশ্বে পরিচিতি দিয়েছে, তিনিও ইন্টারকে উজাড় করে দিয়েছেন সর্বস্ব। তাই এসি মিলানে মালদিনির তিন নম্বর জার্সির মত ইন্টারের চার নম্বর জার্সি বরাবরের মত চলে গেছে ইতিহাসের পাতায়। নেরাজ্জুরিদের ইতিহাসে জানেত্তির পরে আর কোনও নম্বর চার যে থাকতেই পারে না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link