ক্রিকেটের জার্সি, জার্সির ক্রিকেট

‘জার্সির আমি জার্সির তুমি, জার্সি দিয়ে যায় চেনা’ – হ্যাঁ খাঁটি কথা, ওই আকাশি নীল রঙের ১০ নম্বর টা দেখলেই চোখ বুজে বলে দেওয়া যায় ওটা এক আরাধ্য ক্রিকেট দেবতার জার্সি। ওই একই রঙের ৭ নম্বর টা ভারতের আরেক ক্রিকেট রত্নের জার্সি। বা ওই আকাশি জার্সি টাই কেউ যদি লর্ডসের ব্যালকনিতে ট্রফি জেতার আনন্দে বা ইংরেজ দের দর্প চূর্ণ করার আনন্দে বনবন করে ঘোরায় তা তো ক্রিকেটের সর্বকালীন একটা ফ্রেমেবন্দি হয়ে থাকারই মতো হয়ে যায়।

কিংবা, লাল সবুজের ৭৫ নম্বরে জার্সিধারী যখনই মাঠে নামেন তিনি কোটি কোটি বাঙালির আশা ভরসার প্রতীক হয়ে দাঁড়ান আবার ঐ একই রঙের ২ নম্বর জার্সিধারী হয়ে দাঁড়ান কোটি কোটি বাঙালির সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে এগিয়ে চলা আর অনুপ্রেরণার শেষ কথা। হ্যাঁ, সেই জার্সি নিয়েই আজ যত কথা।

লাল বলের ক্রিকেটে সাদা আর সাদা বলের ক্রিকেটে রঙিন জার্সি টাই এখন দস্তুর। কিন্তু সাদা বলের ক্রিকেট টাও যখন লাল বলে চলত তখন ক্রিকেটার দের গায়ে সাদা জার্সিই উঠতো। জার্সি রঙিন করায় বিপ্লব ঘটালো সেই ক্যারি পাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট। সাল টা তখন ১৯৭৮।

এরপর অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৮৫ এর বেনসন এন্ড হেজেস ওয়ার্ল্ড সিরিজ, যেখানে ভারত জিতলো সেখানে পুরোদস্তুর রঙিন জার্সিই চলতে লাগলো। তখন জার্সি তে থাকতো না দলের নাম বা স্পনসরের নাম কোনোটাই। কিন্তু, এমনি একদিনের ম্যাচ গুলোতে সাদা জার্সি, লাল বলই চলতে লাগলো।

রঙিন জার্সির ব্যবহার পূর্ণ মাত্রায় চালু হলো ১৯৯২ এর বিশ্বকাপ থেকে। একপ্রকার বিপ্লবই এলো বলা চলে সে বিশ্বকাপে। রঙিন জার্সি, সাদা বল আর দিনরাতের ম্যাচের বিশ্বকাপ আলোড়ন তুলে দিলো। চলছিল এমনি ভাবেই। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ থেকে খেলোয়াড় দের নাম এর সাথে নম্বরটাও দেওয়া শুরু হলো, যে নম্বর দেখে আমরা একডাকে চিনে ফেলি আমাদের পছন্দের ক্রিকেটারকে।

এখন তো টেস্ট ক্রিকেটেও কাউন্টি ক্রিকেটের মত নামের সাথে নম্বর চালু হয়েছে। ২০১৯-এর বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে। এটাও একপ্রকার বিপ্লবই বলা যায়। এই জার্সিই হয়ে ওঠে এক এক টা দেশের ক্রিকেটের প্রতীকি।

আকাশি নীলের প্লাবনে যেমন ভেসে যায় কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, উদ্বেলিত হয় ইডেন থেকে ওয়াংখেড়ে, এই জার্সি যেমন হয়ে ওঠে ১৪০ কোটির কাছে আশা আকাঙ্খার স্বরূপ, তেমনি একটা সবুজ লাল জার্সি প্লাবিত করে পদ্মাপাড়ের দেশকে।

একটা হলুদ জার্সি পড়ার জন্য ছোট থেকে স্বপ্ন দেখে নিউ সাউথ ওয়েলস এর কোনো কিশোর, বা একটা মেরুন জার্সি যখন আবারো ক্যারিবিয়ান সাম্রাজ্যের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে  উঠে পড়ে লাগে, তখন বোঝা যায় এই পরিধানটির মাহাত্ম্য, যার জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্ত কোনো কিছুর জন্য দেশের জার্সি কে বোধহয় ত্যাগ করা যায় না।

জার্সি যেমন ক্রিকেটার দের স্বপ্নের বস্ত্র, সেই জিনিস টার নম্বর যখন চলে আসে, ক্রিকেটার দের সংস্কার গুলো ও সামনে আসে। যেমন জনৈক মহেন্দ্র সিং ধোনি তাঁর জন্ম তারিখের সাথে মিলিয়ে ৭ নম্বর টাই চাই, কোনো এক সৌরভ গাঙ্গুলী বিশ্বকাপে রান না পেলে ৯৯ নম্বরটা বদলে সটান ২৪ নম্বরটা পড়লেই শতরান পান।

কোনো এক টেন্ডুলকার জ্যোতিষীর পরামর্শে ৯৯ নম্বর ছেড়ে ১০ নম্বর গায়ে চাপান, কোনো এক তরতাজা তরুণ বিরাট কোহলি তাঁর পিতার মৃত্যু দিনটিকে সর্বদা স্মরণে রাখতে ১৮ নম্বর জার্সি বেছে নেন। বা এ জগতে থাকেন কোনো এক বীরেন্দ্র শেবাগ, যাঁর আবার জার্সি নম্বরটাই পছন্দ নয়।

এবি ডি ভিলিয়ার্সের মতো কোনো মহাতারকা ও নিজের জন্ম তারিখ আর টেস্ট অভিষেকের দিন দুটোই সমান সংখ্যা অর্থাৎ ১৭ বলে গায়ে তোলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ১৭ নম্বর। আবার কুমার সাঙ্গাকারার মত কোনো মহাতারকা ক্রিকেটার মনে করেন ১১ সংখ্যাটা জ্ঞানের প্রতীক, তাই তিনি গায়ে চাপান শ্রীলঙ্কার ১১ নম্বর জার্সি।

আবার কোনো ফ্রাঞ্চাইজি টি ২০ দল সাফল্য না পেলে জার্সির রঙ বদলাতেও দ্বিধাবোধ করে না। যেমন আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্স তাদের প্রথম তিন বছরের কালো, সোনালি বদলে, বেগুনি জার্সিতে ফিরতেই পরের চার বছরে দু’বার চ্যাম্পিয়নভ এখন তো আবার এই ফ্রাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগগুলোতে হরেক রকম জার্সির মেলা। সাথে স্পনসর দের ও মেলা বসে জার্সির মধ্যে আর কি!

এবার যদি বলি ‘তারা জার্সির কি বোঝে, যারা শুধুই জার্সি বোঝে’ – ময়দানের ভাষায় ওই ভ্যাবচ্যাক ডেলিভারির মতো লাগলো তাই না! বা যদি একটু অন্যরকম ভাবে বলি ‘জার্সির ও জার্সি আছে’ – এ আবার কী! এতো মুরালিধরণের দুসরার মতো শোনালোভ

এবার তবে পরিষ্কার করে দিচ্ছি। বলছি আসলে জার্সি ক্রিকেট দলের কথা। সে আবার কোন দল? অ্যাসোসিয়েট ক্রিকেট জগতে কান পাতলে কিন্তু এই দলটির নাম শুনতে পাবেনই। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন দলটার নামই হলো জার্সি।

ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মধ্যে যে ইংলিশ চ্যানেলে লোকে সাঁতার কাটতে যায়, সেখানেই চ্যানেল আইল্যান্ডের একটা ১২০ বর্গ কিমি, যা কিনা ঢাকা শহরের থেকেও ছোট আর মাত্র এক লক্ষ দশ হাজার মানুষের দেশ জার্সি। তারা আবার ক্রিকেট ও খেলে।

হ্যাঁ, শুধু খেলেই না, বর্তমানে টি-টোয়েন্টি র‌্যাংকিংয়ে ২৪ নম্বরে থাকা এ দেশটি রাঙ্কিংয়ে একসময়ের জায়েন্ট কিলার কেনিয়ার ঠিক পরেই। অধিনায়ক চার্লস পেরিচার্ড টি-টোয়েন্টিতে সে দেশের প্রথম পাঁচ উইকেট পাওয়া বোলার।

গত ২০১৫ ও ২০১৯ এর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ায়ে চুটিয়ে খেলেছে এরা, ২০১৫ তে হারিয়েছে আগের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলা নেপাল আর হংকংকে। গত বছরের কোয়ালিফায়ারে আরব আমিরাত আর ওমান কে হারিয়েও চমকে দিয়েছে তারা, কিন্তু চমকের এখনো বাকি আছে।

প্রথম চমক জার্সি ক্রিকেটে আছেন এক জন্টি জেনার, যিনি জন্টি রোডসের মত দুর্ধর্ষ ফিল্ডার না হলেও খুব খারাপ নয়। ২০১৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একটি টেস্টে স্টুয়ার্ট ব্রডের বদলি ফিল্ডার হিসাবে বহুক্ষণ ফিল্ডিং করেন তৎকালীন সাসেক্সে খেলা এই ব্যাটসম্যানটি। মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবেই যদি ও বেশি পরিচিতি তাঁর।

দ্বিতীয় চমকটা শুনলে আরো অবাক হতে হয়, ওই চ্যানেল আইল্যান্ডের মধ্যেই আরেকটা দ্বীপ আছে গার্নসি। এই জার্সি আর গার্নসির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অ্যাশেজের থেকেও পুরানো। ঠিকই শুনলেন অ্যাশেজের থেকেও পুরনো। ১৮৬২ সাল থেকে এই দুই দ্বীপের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু, পরবর্তী কালে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্বজুড়ে চলার কারণে অনেকসময় বন্ধ থাকলেও ১৯৫০ থেকে এই দুই দ্বীপের মধ্যে শুরু হয় বার্ষিক ইন্টার ইনসুলার কাপ, যা তাদের কাছে কোনো অংশেই ভারত-পাক বা অ্যাশেজ যুদ্ধের থেকে কম কিছু নয়।

এই টুর্নামেন্ট চলাকালীন ক্রিকেটে মেতে ওঠে দুই দেশই। যাই হোক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জার্সির মোটামুটি পথ চলা শুরু ২০০৭ থেকে। যখন তারা আইসিসির সহযোগী সদস্যপদ পেলো। আগামী দিনে ইউরোপের পঞ্চম দল হিসাবে যদি অন্তত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও সুযোগ পেয়ে যায় এই দেশটি আরেকটা জার্সির বিপ্লব ও কি তখন বলা হবে না।

আর তাদের ও বিপ্লবের প্রতীক হয়ে থাকবে লাল নীলের জার্সিটা। মন্দ নয় তাদের জার্সিটাও, জার্সির জার্সি বলে কথা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link