কপিল দেব, অধিনায়কদের অধিনায়ক

তখন আজহার ক্যাপ্টেন। কিন্তু মাঠে কপিলের ব্যক্তিত্ব ও পারফরম্যান্স দেখে ( এবং ততদিনে কপিলের অধিনায়ক হিসেবে তৎকালীন একমাত্র বিশ্বকাপ জয়, অলৌকিক ১৭৫* ইত্যাদির গল্প শোনা হয়ে গেছে) কিছুতেই বুঝতে পারতাম না, এই লোকটা মাঠে থাকতে, ‘মিয়াঁ ক্যাপ্টেন বানলেন ক্যয়সে?’।

আমার বাবা কপিল দেবের থেকে প্রায় চার বছরের বড়ো। স্বভাবতই আমার বাবা কপিল দেবের পুরো ক্যারিয়ার নিজের চোখের সামনে দেখেছেন। আমি কপিলকে দেখেছি শেষ চার বছর মত, যখন অনেকের কথামতে, তিনি ফুরিয়ে এসেছেন, তাঁকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হ্যাডলির রেকর্ড ভাঙার জন্যে! কিন্তু সত্যিই কি তাই?

আমি খেলা দেখা শুরু করি যখন, তখন আজহার ক্যাপ্টেন। কিন্তু মাঠে কপিলের ব্যক্তিত্ব ও পারফরম্যান্স দেখে ( এবং ততদিনে কপিলের অধিনায়ক হিসেবে তৎকালীন একমাত্র বিশ্বকাপ জয়, অলৌকিক ১৭৫* ইত্যাদির গল্প শোনা হয়ে গেছে) কিছুতেই বুঝতে পারতাম না, এই লোকটা মাঠে থাকতে, ‘মিয়াঁ ক্যাপ্টেন বানলেন ক্যয়সে?’।

কপিল তখন টেস্ট আর ওয়ান ডে প্রতি ম্যাচেই খেলতেন! আজকের ক্যাপ্টেনের মত একটা সিরিজ খেলে বিশ্রাম, আবার সেটাকে ম্যানেজ করার জন্যে চারজন ক্যাপ্টেন এইসব পদ্ধতি ছিলনা। তাই কপিল ক্যাপ্টেন থাকতেই পারতেন হয়তো! জানিনা, এটা আমার ব্যক্তিগত মত।

আজহার ক্যাপ্টেন হিসেবে ভারতকে আহামরি কিছু দিতে পেরেছেন বলে আমার কোনোদিনই মনে হয়নি, আজহার ভক্তেরা আমাকে মার্জনা করবেন। কপিলের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ পরবর্তীতে ভারত অধিনায়ক সৌরভ ও বিরাটের মধ্যে একমাত্র লক্ষ্য করেছি, যেখানে বিপক্ষ অধিনায়ক কে সমীহ করতে বাধ্য হয়েছে।

সেই সময়েও অনেকেই ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া কলোনিয়াল হ্যাংওভার থেকে মুক্ত ছিলেন না। তাদের মধ্যে কপিলের শ্বেতাঙ্গদের সাথে চোখে চোখ রেখে লড়াই আমার মনে আলাদা ভালোলাগার জন্ম দিয়েছিল। পিটার কার্স্টেনকে বোলিং এন্ডে রান আউট করে কপিলের অ্যাংরি আউটবার্স্ট ক্রিকেটের অন্যতম আলোচিত একটি দৃশ্য।

হিরো কাপে কুম্বলের ৬/১২ সবার মনের মণিকোঠায় স্থান পেয়েছে, অনেকে সেটাকে ভারতীয় হিসেবে ওয়ান ডে ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ বোলিং ও মনে করেন, কিন্তু কুম্বলে পেয়েছিলেন শেষ ছটি উইকেট। যার মধ্যে চার জন টেল এন্ডার। কপিল দুটি উইকেট পান। রিচি রিচার্ডসনের কট অ্যান্ড বোল্ড টা, আপনারা কতজন মনে রেখেছেন জানিনা, কিন্তু আজকের দিনে বুমরা বা শামির থেকে আমরা এরকম ক্যাচ দেখলে বিস্মিতই বেশি হবো হয়তো! আমার বাবা ওই আউটটা দেখে বলেছিলেন – দেখেছিস, ছেলেটা কত খাটে??

শেষদিকে কপিল অনেকটাই নিজের সেরা সময়ের ছায়ামাত্র হয়ে খেলেছিলেন। কিন্তু সেটাও কপিলের নিজের সঙ্গে তুলনায়। আজহার কপিলের রিটায়ারমেন্ট প্রসঙ্গে বলেছিলেন – এনিবডি ক্যান টেক হিস প্লেস!

কিন্তু ছিয়ানব্বই বিশ্বকাপে প্রভাকরের দুর্দশা বা শ্রীনাথ এর পার্টনার হিসেবে প্রসাদ এর পাশাপাশি ডোড্ডা গণেশ, প্রশান্ত বৈদ্য, দেবাশীষ মহান্তি, আবে কুরুভিল্লা, হরবিন্দর সিং, পরশ মামব্রের মত এতজন বোলারকে কপিলের অবসরের পরে ২-৩ বছরের মধ্যে সুযোগ দিয়েও একটা ভালো ফাস্ট বোলিং ইউনিট বানাতে না পারা কপিলের শেষ বয়সেও অবদানের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। কপিল কিন্তু শেষদিন অবধি ও বাকিদের স্ট্যান্ডার্ডে নামেন নি।

কপিল দেব তথাকথিত ভাবে উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না, ভালো ইংরেজি বলতে পারতেন না। এই নিয়ে কথা ওঠায় একবার বলেছিলেন যে তাহলে ইন্টারভিউ দেবার জন্যে আলাদা ক্যাপ্টেন রাখলেই হয়!

কতো বড়ো দেশপ্রেমিক ছিলেন সেটা বোঝানোর জন্যে বিশ্বকাপ জয় নয়, ভারতের দ্বিতীয়বার ওয়ান ডে বিশ্বকাপ জেতার পরে রণতুঙ্গার সাথে একটি টিভি শো তে ভারতের ২০১১ ফাইনাল জেতার পরের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়ায় তাঁর কেঁদে ফেলার দৃশ্যই যথেষ্ট।

কপিলের ১৭৫* ভারতীয় ক্রিকেটের লোকগাথা। এটা হয়তো পোয়েটিক জাস্টিস যে এই ইনিংসের কোনো সর্বজনের দেখার মত রেকর্ডিং নেই। কেননা ইনিংসটির বর্ণনা পড়লে বা যাঁরা রেডিও শুনেছিলেন ( আমার এক বন্ধুর কাকার মুখে ওই ম্যাচের রেডিও কমেন্ট্রি শোনার গল্প শুনেছিলাম) তাদের কথা শুনলে মনে হতো – এও সম্ভব! এই অবস্থা থেকে এমন ইনিংস খেলা সম্ভব!

অবিশ্বাস্য, অলৌকিক এসব বিশেষণ কম মনে হতো। কি জানি, আজকাল পুরনো দিনের খেলার হাইলাইটস দেখে যেমন অনেক কিছুকেই আর তত অসাধারণ লাগে না, তেমনি এই ইনিংসটির ৫ মিনিটের হাইলাইটস ও হয়তো ফুটিয়ে তুলতে পারতো না পরিবেশ পরিস্থিতি ও অনন্ত চাপের প্রকৃত ছবি। বরং একটা এজ বা একটা মিসটাইম শট, একটা মিসফিল্ড দেখে অতি বোদ্ধা কেউ কেউ হয়তো একটা অপ্রিয় সমালোচনা করে বসতেন, যা অন্যান্য ক্রিকেটারদের নিয়ে হয়।

সেটা এই ইনিংসের মাহাত্ম্য খুন্নই করতো। তাই, যা হয়েছে ভালই হয়েছে। এই ইনিংসটি ভারতীয় ক্রিকেটের চিরকালীন রূপকথা হয়েই থেকে যাক। আর রূপকথা যেমন বাস্তব হলে তার আকর্ষণ কমে যায়, তেমনি এটাও থেকে যাক একটা অন্য উচ্চতায়, আমাদের মত আমজনতার নিন্দা প্রশংসা সমালোচনার আওতার বাইরে!

কপিল দেব! আপনি কি সত্যিই ঘটেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটে? আজও দ্বিতীয় একজন এলেন না আপনার মত! আপনিই সবার রোল মডেল! আর সবার রোল মডেলদেরও রোল মডেল আপনি! আপনি সব ক্যাপ্টেনের ক্যাপ্টেন! স্কিল, ফিটনেস, ডেডিকেশন, আপনাকে কেউ ছুঁতে পারলো না ক্রিকেটের তিন বিভাগ মিলিয়ে।

ভারতীয় ক্রিকেটে সব মহাতারকার আলাদা নিন্দুক গোষ্ঠী আছে। গাভাস্কার, শচীন, ধোনি, সৌরভ, কোহলি, সবার! একমাত্র আপনি অজাতশত্রু!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...