কোহলিফায়েড

অমায়িক সূর্যাভারা গাঢ়সবুজ পাতাদের ফাঁক দিয়ে গলে মাটির গায়ে হাত বুলিয়ে যেন আরেক নতুন স্নিগ্ধ সকালের আবিষ্কার করে। তবু সেই নয়া প্রাত তার পূর্ণতা পাওয়ার আগেই ভরে ওঠে বিষাদ, বিষণ্ণতা আর বিমর্ষতায়। গহন আঁধারে ভরা সারারাতের কালিমাভরা উপচে পড়া পাত্রে বাধ্য হয়ে মুখ ডোবায় সুন্দর আর একটা নতুন দিন।

কিন্তু, এসবের মাঝেই লড়াই করতে হয়। হাজারো মিথ্যের হুড়োহুড়ির মাঝে লক্ষ্যপুরণের বাস্তব সত্যিটাকে ফুটিয়ে তুলতে হয় চোখের সামনে। বিষাদগ্রস্ত নিদ্রাহীন একটা রাত কাটিয়ে উঠে আবার নামতে হয় সবুজ গালিচায়, ব্যাটের চকচকে মুখটা ছুঁইয়ে দিতে হয় বলের সেলাইয়ের ওপর ঠিক ওই সেদিনের বছর আঠেরোর ছেলেটার মতো।

হঠাৎই এল বাবার মৃত্যুসংবাদ, গোটা রাত্তির চোখের পাতা এক হয়নি, চল্লিশ রানে নট আউট হয়ে রয়েছে ছেলেটা যাকে পরের দিন আবার মাঠে নামতে হবে টিমের ফলো-অন বাঁচাতে গেলে। চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছে তখন দিল্লির রঞ্জি দলের কোচ। কিন্তু সকাল হতেই দুটো ভেজা চোখ নিয়ে কোচের সামনে গিয়ে ছেলেটা বলল ‘আমি নামছি’। পিতৃশোকের যন্ত্রণা বুকে লুকিয়ে রেখে নব্বই রান করে গেল সেই ছেলে!

ফলো-অন বাঁচল দিল্লীর। সেদিন শুধু কি একটা রঞ্জি দলের ফলো-অন বাঁচিয়েছিল মাত্র ছেলেটা? নাকি ভারতীয় ক্রিকেটের সামনে খুলে দিয়েছিল এক অনন্ত পথ, নাকি ক্রিকেটবিশ্বের সামনে এক সম্রাটের আগাম আগমনের হুঙ্কার দিয়েছিল, নাকি সবার অলক্ষ্যে অস্ফুটে বলে দিয়েছিল সেদিন, লক্ষ্যপূরণের পথে যন্ত্রণা বিষাদ আর শোকের যায়গা নেই। সেই রাস্তায় নিজের বিশ্বাস কে বিছিয়ে দিতে হয় কার্পেটের মতো, ভালোবাসতে হয় স্বপ্নকে, আত্মত্যাগের পাহাড় গড়ে দিতে হয় সামনে।

সেদিনের ওই ছেলেটার নাম ছিল বিরাট কোহলি, আজ যে কিং কোহলি। আজ সেই কিং কোহলির কাঁধে একটা গোটা জাতির বহু আবেগমন্ডিত একখানা তেরঙা, সেই কিং কোহলি যার মাথায় আজ ‘বিশ্বশ্রেষ্ঠ’-এর মুকুট। সেদিনের পিতৃবিয়োগ আর আজকের মাঝের এই সফরটায় প্রতিটিদিন উচ্চশিরে তেরঙ্গাখানা বয়ে নিয়ে গেছে কোহলি, তার চওড়া ব্যাটখানা ত্রাস হয়ে উঠেছে তাবড় তাবড় বোলারদের সামনে।

মেলবোর্ন থেকে ওয়াংখেড়ে, আলতো ঠেলে দেওয়া একটা স্ট্রেট ড্রাইভের মতোই বিপক্ষকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে এই চিকু। আর একটা মোহালি? মনে আছে? কোহলির শ’য়ে শ’য়ে অতিমানবিক ইনিংসের মাঝে আরেকটি অনন্যসুলভ সৃজনী।

দুঁদে অজি বোলিং লাইন আপের সামনে ১৬০ এর বেড়া টপকাতে গিয়ে প্রায় নুইয়ে পড়ছে টিম ইন্ডিয়া, ভারতের নিখাদ ভরসা হয়ে ক্রিজে পড়ে রয়েছে শুধু চেজ-মাস্টার। যুবির ফিরে যাবার পর কব্জির মোচড়ে ঘুরল সেই চিরাচরিত এমআরএফ।

ক্রমশ এভারেস্টগামী আস্কিং রানরেট এক একটা ট্রেডমার্ক শটের সৌজন্যে মাথা ঝোঁকাল নীচের দিকে আর চকচকে উইলোটার সামনে ভেসে রইল শুধু অসহায় হেজেলঊড-ফকনার-কুল্টারনাইলদের বিকৃত মুখগুলি। অনবদ্য বিরাশী রানের ইনিংস খেলে গিয়ে সেদিন অজিদের একলাই গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন কিং কোহলি। সেমিফাইনালে কোহালিফাই করেছিল ভারত। মোহালি মজেছিল কোহালিতে।

এই কোহলিকে আবার যখন ইংল্যান্ডমাটিতে তাঁর ব্যর্থতা নিয়ে তীর ছোঁড়া হয়, সংকল্পবদ্ধ একফালি উইলো সেই মাটিতেই জুড়ে দিয়ে যায় সাড়ে পাঁচশোর ওপর রান। একলা সৈনিক হয়ে লড়ে যায় অ্যান্ডারসন-ব্রডের সামনে।

আসলে কোহলি শুধু সত্তরখানা সেঞ্চুরি, রেকর্ডের পর রেকর্ড আর কোনো গাধা স্কোরবোর্ডটার অলিখিত মালিক নয়; কোহলি মানে সেই বাইশ গজের মাঝে স্লেজিং-এর বদলে স্লেজিং, চোখে চোখ ঠেকানো আর চ্যালেঞ্জ। কোহলি মানে তো জয় অথবা পরাজয় এর একনিষ্ঠ নির্ণায়ক যার ক্রিকেটাভিধানে কোনো ‘ড্র’ শব্দের জায়গা নেই।

কোহলি মানে তো মিচেল জনশনের ভয়ঙ্কর ‘থ্রো’-এর জবাবে তাকে বাউন্ডারির রোপে ডিপোজিট করা। এত্ত আগ্রাসন, এত স্লেজিং এর সত্ত্বেও আবেগের বশে ভুল শট সিলেক্সন করে বসতে দেখিনা কোনোদিন, বরং জবাব স্বরুপ ছোট ছোট সিঙ্গেলস কিম্বা কখানা প্রপার ক্রিকেটিং শট খেলে বিপক্ষের জার্সী ভিজিয়ে দিয়ে যায় কিং কোহলি।

আর তার রানের খিদে? সে নিজের উইকেট খোয়ানোর পরের কয়েক সেকেন্ড লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, মাঠেই খানিক্ষণ থমকে যাওয়া আর একটা অস্বাভাবিক মুখভঙ্গি যেন আরো অনেককিছুর ঘাটতি রয়ে গেছে নিজের মধ্যে! এখানেই কোহলি সবার চেয়ে কয়েক গজ এগিয়ে। এখানেই কোহলি সচীন পরবর্তী ভারতের যথার্থ তেরঙাবাহক!

ক্রিকেটীয় পরিধির এসমস্ত অঙ্ক থেকে বেরিয়ে যখন আজও কেউ তার আচরণ কিম্বা স্পোর্টসম্যান স্পিরিট নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, ক্রিকেটসম্রাট রচিত সেই রঙচঙে বই থেকে তুলে আনা কয়েকখানা অধ্যায় একটা লম্বা জবাব হয়ে দাঁড়ায় সেই প্রশ্নের সামনে, মাঠেই স্টিভন স্মিথের উদ্দেশ্যে ছুটে আসা কটুক্তির সামনে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ানো কিম্বা ব্যাক্তিগত ট্রিপল সেঞ্চুরির হাতছানি সত্ত্বেও নির্দ্বিধায় ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেওয়াসহ আরো কত দৃষ্টান্ত পড়ে রয়েছে সেইসকল সওয়ালের জবাবস্বরুপ।

উইকেটের দু’প্রান্তের মাঝে আজ কোহলির প্রতিটি পদাঙ্ক পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে কারো না কারোর অনুপ্রেরণা। বছর পনেরো আগের কোটলার সেই কোহলি থেকে আজকের এই জ্বলন্ত প্রেরণা হয়ে ওঠা সবটা একদিনে হয়ে যায়নি, শুধু প্রতীভার অজুহাতের সৌজন্যেও আজ কোহলি ভারতের সেনানায়ক নয়।

একশো পঁয়ত্রিশ কোটি মানুষের প্রতিনিধি হয়ে আজ তার কাঁধে তেরঙা চাপিয়ে নেবার পেছনে মিশে রয়েছে ধুলো, রক্ত, ঘামেদের নির্দয় অবদান, ঘন্টার পর ঘন্টা ক্রিজে পড়ে থাকা আর অজস্র স্বত্বত্যাগ। এখানে ট্রফির মুল্য নেই, নেই নাম-যশের মাহাত্ম্য। শুধু একটা শক্ত মেরুদণ্ড আছে।

তাই যদ্দিন ক্রিকেট থাকবে, বিরাটের মায়াবী ব্যাটটার লীলা ছাপা থাকবে; যদ্দিন ক্রিকেট থাকবে ব্র‍্যাডম্যান-শচীন-ভিভ-সাঙ্গাদের সাথে সবার সামনে তেরঙা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে একজন বিরাট কোহলি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link