কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়বর্ধনে, তিলকারত্নে দিলশানদের বিদায়ের পর লঙ্কান ক্রিকেট অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়ে। ক্রিকেট বিশ্ব দাপিয়ে বেড়ানো সেই সিংহ ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। একসময় বিশ্বক্রিকেটে যে দলটা ছিলো অন্যতম পরাশক্তি সেই দলই অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিলো খর্বশক্তির দলের সামনেও। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের দুর্দিনে আশার প্রদীপ হয়ে আসেন বেশ কিছু তরুণ ক্রিকেটার। তাঁদের একজন ছিলেন কুশল মেন্ডিস।
স্কুল ক্রিকেট থেকেই ছিলো নামডাক। অনূর্ধ্ব ১৯ দলে খেলাকালীন সময় থেকেই ছিলেন নির্বাচকদের সুনজরে। অল্প বয়সেই পেয়েছিলেন ভবিষ্যত তারকার তকমা। মাত্র ১৬টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেই কুশল জায়গা করে নিয়েছিলেন জাতীয় দলে।
প্রতিভা, সামর্থ্য, সম্ভাবনা – সবটাই ছিলো কুশলের মধ্যে। আর সেই ঝলকটা দেখিয়েছিলেন মাত্র ২১ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে! অ্যাডিলেডে প্রথম ইনিংসে ৩৬ রানে পিছিয়ে থেকেও কুশল মেন্ডিসের ১৭৬ রানের দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরিতে অসাধারণ এক জয় পায় শ্রীলঙ্কা।
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে যেকোনো লঙ্কান ক্রিকেটের সেটিই ছিলো সর্বোচ্চ স্কোর। একই সাথে সর্বকনিষ্ঠ লঙ্কান ক্রিকেটার হিসেবে অজিদের ডেরায় সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন কুশল। ওই ম্যাচে ১০৬ রানের জয়ে টেস্ট ইতিহাসে অজিদের মাটিতে নিজেদের দ্বিতীয় জয়ের দেখা পায় শ্রীলঙ্কা।
মাত্র ২১ বছর বয়সে ২০১৬ সালের সেই দিনে অ্যাডিলেডে মিশেল স্টার্ক, নাথান লিঁও, জশ হ্যাজেলউডদের সামনে বুক চিতিয়ে দলের পক্ষে একাই লড়াই করেছিলেন কুশল। সেদিন তিনি জানান দিয়েছিলেন নিজের সামর্থ্যের!
একই বছর ত্রিদেশীয় সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৯৪ ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৫৭ রানের ইনিংস খেলে দলকে ট্রফি জেতান কুশল। ওই সিরিজেই ক্যারিয়ারে প্রথমবার সিরিজ সেরা নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৬ সালটা যেনো স্বপ্নের মতো ছিলো কুশলের জন্য। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের ‘নেক্সট বিগ থিং’ তকমা তো আগেই ছিলো! প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে নির্বাচকদের আস্থার প্রতিদানও দিচ্ছিলেন দারুণভাবে।
কিন্তু এরপরই খেই হারিয়ে ফেললেন কুশল। টানা ব্যর্থতায় অধারাবাহিকতার সাগরে এখন তিনি নিজেকে হারিয়ে খুঁজে চলেছেন।
১৯৯৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি শ্রীলঙ্কার মরোতুয়ায় জন্ম নেন কুশল। স্কুল থেকেই ক্রিকেটের প্রতি ছিলো ঝোঁক। শুরু থেকেই ছিলেন একজন উইকেটকিপার ব্যাটার। স্কুল ক্রিকেটে তাঁর দুর্দান্ত ব্যাটিং অনেকেরই নজরকাড়ে। স্কলারশিপে ভর্তিহন প্রিন্স অব ওয়েলস কলেজে।
স্কুল ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে পরবর্তীতে বনে যান দলের অধিনায়ক। এরপর ২০১৩ সালে স্কুলবয় ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ারের পুরষ্কার জেতেন তিনি। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে তিনি ছিলেন বেশ পরিচিত মুখ। বলা হয়ে থাকে তাঁর সময়ে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ছিলেন কুশল।
পরের বছর ২০১৪ সালে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে লঙ্কান যুবাদের নেতৃত্বের দায়িত্ব পান কুশল। সেখান থেকেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পদচারণা। আর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মাত্র ১৬ ম্যাচ খেলার পরই সুযোগ পেয়ে যান জাতীয় দলে!
২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে জাতীয় দলে অভিষিক্ত হন তিনি। অভিষেক টেস্টটা অবশ্য আপন রঙে রাঙাতে পারেননি তিনি। প্রথম ইনিংসে ১৩ ও পরের ইনিংসে করেন ৩৯ রান। পরের বছর ২০১৬ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষিক্ত হন কুশল। ওই ম্যাচে অভিষেকেই করেন অসাধারণ এক ফিফটি। একই বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতেও অভিষিক্ত হন এই ব্যাটার।
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অনবদ্য সেঞ্চুরি ও ত্রিদেশীয় সিরিজে সিরিজ সেরা হওয়ায় ওই বছরই ২০১৬ সালে তিনি শ্রীলঙ্কার ফিউচার ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ারের পুরস্কার জেতেন!
ওয়ানডেতে শুরুর দুই বছর ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ডাম্বুলায় ক্যারিয়ারের মেইডেন ওয়ানডে সেঞ্চুরির দেখা পান কুশল। এরপরই শুরু হয় ছন্দপতন। ফর্মহীনতায় ভুগছিলেন বেশ খানিকটা সময়। ২০১৭ সালে ঘরের মাটিতে গলে বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৯৪ ও ভারতের বিপক্ষে ১১০ রানের ইনিংস খেললেও ওই মৌসুমে ব্যাট হাতে ছিলেন চরম অধারাবাহিক।
পরের বছর চট্রগ্রামে বাংলাদেশের বিপক্ষে আবারো সুযোগ আসে ডাবল সেঞ্চুরির। কিন্তু মাত্র ৪ রানের আক্ষেপে ১৯৬ রানের ইনিংস শেষে আউট হন তিনি। ওই বছরের ডিসেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন ১৪১ রানের অপরাজিত এক ইনিংস।
টেস্ট ও ওয়ানডের তুলনায় টি-টোয়েন্টিতে ছিলেন আরো বাজে অবস্থানে। এখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টিতে ২৯ ম্যাচে ৫ ফিফটিতে ১৮ গড়ে করেছেন ৫৩৮ রান। বাকি দুই ফরম্যাটে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ রাখতে পারলেও টি-টোয়েন্টিতে এখন পর্যন্ত একেবারেই সাদামাটা পারফরম করেছেন কুশল। ওয়ানডেতে এখন পর্যন্ত খেলেছেন ৮২ ম্যাচ। এই ৮২ ম্যাচে ২ সেঞ্চুরি আর ১৭ ফিফটিতে মাত্র ৩০ গড়ে করেছেন ২২৯৭ রান। অপরদিকে, টেস্টে ৪৭ ম্যাচে ৩৫ গড়ে ৭ সেঞ্চুরি আর ১১ ফিফটিতে করেছেন ৩০২২ রান।
টেস্ট ইতিহাসে টানা চার ইনিংসে ডাকের লজ্জার রেকর্ডেও নাম আছে কুশলের। ২০২০-২১ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টানা তিন ইনিংসে ডাকের পর পরবর্তী সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ডাকের মধ্যে দিয়ে এই লজ্জাজনক রেকর্ডে নাম লেখান কুশল।
২০২০ সালে একটি সড়ক দূর্ঘটনায় জড়িত থাকায় গ্রেফতার হন কুশল মেন্ডিস। অবশ্য পরবর্তীতে জামিনে ছাড়া পান তিনি। সবশেষ গেলো বছর ২০২১ সালের জুলাইয়ে ইংল্যান্ড সফরে বায়োবাবল ভঙ্গ করে রাস্তায় সিগারেট খাওয়ার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে বোর্ড থেকে ১ বছরের নিষেধাজ্ঞা পান কুশল। অবশ্য সেখানে আরো ছিলেন দানুশকা গুনাথিলাকা ও নিরোশান ডিকওয়েলা।
তবে পরবর্তীতে সেই সাজা কমিয়ে ৬ মাসে আনায় আবারো জাতীয় দলে ফিরতে যাচ্ছেন কুশল। আসন্ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে ডাক পেতে যাচ্ছেন এই ব্যাটার।
যে সম্ভাবনা দেখিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা দিয়েছিলেন কুশল তার পুরোটাই ভাটা পড়ে গেছে অধারাবাহিকতার সাগরে। বয়সটা সবে ২৭! ভুল শুধরে নতুন ভাবে শুরু করতে পারলে এখনো সুযোগ আছে নিজের সেরাটা প্রমাণের। নষ্ট হওয়া প্রতিভা হিসেবে ক্যারিয়ার শেষ করবেন নাকি সব পালটে নিজেকে নিয়ে যাবেন অনেক উপরে সেটা সময়ই বলে দিবে! তবে এখন পর্যন্ত তিনি এক নষ্ট হওয়া প্রতিভা!