সে বছরটা আমার কলকাতা ময়দানে শেষ বছর। মানে সেই বয়সটা হয়ে গেছে যখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে চাকরিবাকরি করে পেট চালাব না কি খেলেধুলে জ্যাক অব অল ট্রেড হয়ে বসে থাকব। সে বছর হাওড়া ইউনিয়নে। অনেক আশা নিয়ে গেছি, কিন্তু অধিনায়ক নিজে বাঁহাতি স্পিনার হলে যা হয় আর কি!
সে যাক, হাওড়া ইউনিয়ন আয়োজন করল এক ডবল উইকেট প্রতিযোগিতার। আর তখনই নামটা উঠে এল। লক্ষ্মণ শিবারামাকৃষ্ণ। ৮১ সালের সেই মেলবোর্ন টেস্টের পর ভারতের প্রথম টেস্ট জয়ের কারিগর। স্ফুলিঙ্গের মতো উঠে এসে হারিয়ে গেলেন।
সেই শিবা, লোকে বলে নাকি ড্রাগস নিয়ে অন্ধকারে চলে গিয়েছিলেন। তাঁকে নেটে বল করতে দেখছি। জুড়ি হিসাবে বোধহয় আরেক ভাগ্যহত, কিছুদিন আগেই যিনি হতাশা থেকেই হয়তো শেষ করে দিলেন নিজের জীবন, সেই ভি বি চন্দ্রশেখর। তামিলনাড়ুর ওপেনিং ব্যাট, আশির দশকের শেষ অর্ধে কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তের সঙ্গে জুড়ি বেঁধে বিপক্ষ বোলারদের ত্রাস।
সে যাক, সেই দেখলাম শিবাকে, কতোওওওওওওওদিন পরে। অ্যাকশনটা তখনও একই আছে, হাতে স্পিনটাও, কিন্তু সেই লুপ আর বাইট নেই। ওদিকে চেহারাটা একটু ভারি হয়েছে, তবে সেটা ওই পেন্সিলের উপরে আমরা ছোটবেলায় যে রবার ব্যান্ড বাঁধতাম সেটুকুই। তা সেই ডাবল উইকেটে ফাইনালে অজয় ভার্মা আর হাসমুখ প্যাটেল শিবাদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হল আর আমি ফুটবল খেলা এবরো খেবরো মাঠে মিড উইকেট বাউন্ডারিতে খোঁচা খাওয়া বাঘ (?)-এর মতো ফিল্ডিং করে সেরা ফিল্ডার হলাম সে তো আলাদা কথা। কিন্তু এটা তো আমার কথা হচ্ছে না, হচ্ছে শিবার কথা। শিবার ফিরে আসা অথবা শিবা কা ইনসাফ।
কিন্তু কোনোটাই তো হয়নি। প্রথম টেস্টে সুযোগ কপিলের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজে। তখন ভারতের কনিষ্ঠতম হিসাবে। উইকেট পাননি, কিন্তু হেইন্স বা মার্শালের সঙ্গে অটুট বন্ধুত্ব হয়েছিল সেই সতেরো বছরের ছেলেটির। স্বভাবতই বন্ধুত্ব দিয়ে তো আর ক্রিকেট মাঠে সুযোগ হয় না। সে যে যতই লবির কথা বলুক লোকে, ওটা দিয়ে ক্রিকেট খেলা হয় না।
তাই বিশ্বকাপে জায়গা হল না। কিন্তু নজর কাড়লেন অন্য ম্যাচে। রঞ্জিতে তদ্দিনে তাঁর পারফরম্যান্স চোখ টানছে। ১৯৮৪-৮৫ সিরিজে ডেভিড গাওয়ারের নেতৃত্বে ভারতে এসেছে ইংল্যন্ড। গাভাস্কার তখন আবার ক্যাপ্টেন। তাঁরই বিশ্বস্ত রবি শাস্ত্রীর অধিনায়কত্বে ভারতের শক্তিশালী অনূর্ধ্ব ২৫ দল প্রথম শ্রেনির ম্যাচ খেলতে নামল ইংল্যন্ডের সঙ্গে আহমেদাবাদে। কে নেই সে দলে!
শ্রীকান্ত, আজহারউদ্দিন, আর মাধবন (অভিনেতা নন), সদানন্দ বিশ্বনাথ, গুরশরণ সিং, রঞ্জিত খানবিলকর, চেতন শর্মা, মনোজ প্রভাকর, রাজিন্দার সিং ঘাই আর শিবা। তা শ্রীকান্তের ৯২ আর আজহারের দেড়শ ও মাধবনের সেঞ্চুরির উপর ভিত্তি করে রবির দল প্রায় চারশ রান করে। আর প্রথম ইনিংসে সোয়া দুশ করা ইংল্যন্ডের পুরো দল দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১১৭য় গুটিয়ে যায়। গাওয়ার, গ্যাটিং, ল্যাম্ব খচিত ইংল্যন্ডের মিডল অর্ডারকে সিঙ্গল ডিজিটে নামিয়ে দেন শিবাই।
স্বভাবতই প্রথম টেস্টে সুযোগ ঘটে যায় তাঁর। ওয়াংখেড়ের প্রথম টেস্টে বেলে মাটির উইকেটে জাদুবর্ষা নামান শিবা। লুপ, ডিপ, স্পিন, বাইট আর তার সঙ্গে অমোঘ গুগলি। একজন লেগস্পিনারের জন্য আর কী চাই! আর ফিল্ডিং? ভারতীয় দলে তখনও আজহারের প্রবেশ ঘটেনি। কিন্তু কপিল দেবের সঙ্গে একমাত্র বিশ্বমানের ফিল্ডার হিসাবে শিবরামকৃষ্ণণ ক্ষিপ্র হরিণের মতো বাউন্ডারি আগলান, কভার অঞ্চলে রাজত্ব করেন।
শিবা নিজেও বলেন, অধিনায়ক হিসাবে গাভাসকারের ভরসা প্রথম দিন থেকেই পেয়েছিলেন। তরুণ শিবার ক্রিকেট প্রজ্ঞার উপর প্রথম দিন থেকেই ভরসা ছিল সানির। তাই বোলার নিজের পছন্দ মতো ফিল্ড সেট করতে পারতেন। সেই অনুযায়ী আক্রমণ, আর যে উইকেটে বল গ্রিপ করছে, সেখানে তো পুরো প্যাকেজ হিসাবে ভয়ঙ্কর। মাইক গ্যাটিং দ্বিতীয় ইনিংসে একটু লড়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুই ইনিংসে ছয় উইকেট করে নিয়ে ভারতের মাটিতে প্রথম টেস্ট স্মরণীয় করে রাখেন শিবা ম্যান অব দ্য ম্যাচ পারফরম্যান্স করে।
তারপরের টেস্টের প্রথম ইনিংসেও ছয় উইকেট। কিন্তু ঠিক সময়ে ব্যাটিংএ, বিশেষত কপিল দেবের দায়িত্বজ্ঞানহীন শটে একটা ৫০:৫০ ম্যাচে আট উইকেটে পরাজয় ঘটে ভারতের। শিবার জাদুমন্ত্র বোধহয় তখন পড়ে ফেলতে পারছিলেন ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা। আসলে সেই সিরিজের দুই ওপেনার, ফাউলার এবং রবিনসন এবং মিডল অর্ডারের ল্যাম্ব, গ্যাটিংরা স্পিন খেলার সময় কমিট করা বন্ধ করলেন।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেখে তবে খেলতে শুরু করলেন। শিবাকে সমীহ করা শুরু করলেন। দ্বিতীয় স্পিনার হিসাবে রবি শাস্ত্রী তখন রান আটকানোর মেশিনে পরিণত হয়ে গেছেন। আক্রমণের ‘আ’ও বাকি নেই। ফল যা হবার হল, প্রথম দুই টেস্টে ১৯ উইকেট পাওয়া াপরের তিন টেস্টে মাত্র ৪টি আর উইকেট পেলেন। দেশের মাটিতে বহুদিন পর টেস্ট জেতার পরেও সিরিজ হারতে হল গাভাসকারের ভারতকে।
অবশ্য এখানেই শেষ নয়। অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ায় ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের সার্ধশতবর্ষে অস্ট্রেলিয়ায় ওয়র্ল্ড সিরিজ কাপ আয়োজিত হল। গাভাসকারের নেতৃত্বে সেই ভারতীয় সীমিত ওভারের দলটি বোধহয় ভারতের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা সীমিত ওভারের দল। ওপেনে শাস্ত্রী এবং শ্রীকান্ত। মিডল অর্ডারে সানি, আজহার, মহিন্দার আর বেঙ্গসরকার। সদানন্দ বিশ্বনাথের মতো প্রতিভাবান উইকেটকীপার, কপিল, মদন লাল, রজার বিনি, চেতন শর্মা, মনোজ প্রভাকরের মিডিয়াম পেস লাইন আপ আর স্পিনার হিসাবে শিবা আর শাস্ত্রী। সব কটা ম্যাচ জিতে ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়।
শুধু তাই নয়, ফাইনাল ছাড়া প্রতিটি ম্যাচে বিপক্ষকে অল আউট করে ভারত, ফাইনালে ৯ উইকেট। এবং সেমি ফাইনাল ছাড়া কেউই ভারতের বিরুদ্ধে ২০০ রানও করতে পারেনি। আর সর্বাধিক উইকেট শিকারী কে? লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণণ।
ব্যাস! সুনীল গাভাসকার ওয়র্ল্ড সিরিজ কাপের ট্রফি হাতে নিয়ে ঘোষণা করলেন যে তিনি আর ক্যাপ্টেন থাকতে চান না। অধিনায়কত্ব ফিরে গেল কপিল দেবের হাতে।
আর তার পরে পরেই শিবার মন্দ্রগতিতে পতন শুরু। না কপিল দেবের হয় তো কোনও দোষ নেই। কিন্তু অধিনায়ক হিসাবে আক্রমণত্মক ছিলেন। কিন্তু স্পিন বোলিং-এ অধিনায়কত্ব করতে গেলে বোলারের সঙ্গে টিউনিং থাকতে হয়। তাঁকে আত্মবিশ্বাস দিতে হয়। স্পিনার এবং মিডিয়াম পেসারের দৃষ্টিভঙ্গী এক হয় না।
তদ্দিনে সিনে চলে এসেছেন আরেক ক্ষণজন্মা প্রতিভা মনিন্দর সিং। তার উপর শ্রীলঙ্কায় শিবা কার্যকরী হলেন না। অস্ট্রেলিয়ায় শেষ সুযোগ ছিল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় কাঁধের চোট লাগল। আসলে তখন ফিজিওথেরাপিস্ট বলে দলের সঙ্গে কেউ থাকত না। ম্যাসিওরও নয়। চোটটা রোটেটর কাফ মাসলের ছিল, কিন্তু সামান্য গরম ঠাণ্ডা সেঁক দিয়ে কি কাঁধের মাসলের চোট সারে? ফলস্বরূপ কাঁধের জোর কমে যাওয়া, বল করার সময় ভাল করে জার্ক দিতে পারছেন না। ফলে বলের বাইট কমে যাওয়া। শিবা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে শুরু করলেন।
প্রথমে জাতীয় দল থেকে, তারপর রাজ্য দল থেকেও। মেন্টর নেই, সঠিক গাইড নেই। প্রতিভাগুলি এভাবেই হারিয়ে যেতে থাকে। তার উপর স্থানীয় দর্শকরাও নাকি ভয়ানক টন্টিং, ব্যারাজিং শুরু করলেন। সাম্প্রতিক কালে শিবা বলেছেন যে চেন্নাইয়ের মতো জায়গাতে খেলার মাঠে বর্ণবৈষম্যমূলক মন্তব্যের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। হতাশায় ডুবে যেতে বেশি সময় লাগেনি তাঁর। ফিরে আসার চেষ্টা যে করেননি তা তো নয়। ক্রিকেটার হয়ে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। ইন্ডিয়া সিমেন্টসে চাকরি করার সূত্রে কর্পোরেট ক্রিকেট খেলতে খেলতে ১৯৯৭-৯৮।
অস্ট্রেলিয়া ভারতে আসবে আর শ্যেন ওয়র্ন বনাম শচীন টেন্ডুলকারের মধ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। যে যুদ্ধ প্রথম রাতেই বিল্লি মেরে ফেলেন সচিন রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন মুম্বইয়ের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম প্রথম শ্রেনির ম্যাচে শেনের প্রথম বলটাই স্লগ সুইপ মেরে ওয়াংখেড়ের ছাদের হোর্ডিং-এ মেরে। কিন্তু বারবার সচিন একজনের নাম করেছেন। তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের ব্রাত্য লক্ষ্মণ, শিবারামাকৃষ্ণ। সিরিজের আগে নিয়মিত ভিত্তিতে লেগ স্টাম্পের উপরে বা বাইরের ক্ষততে বল ফেলে বড় স্পিন করে অফ স্টাম্পের ডগা উড়িয়ে দেবা বল করে অনুশীলনে শচীনকে আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন তিনি।
এরও বহুদিন পরে হয় তো কিছুটা শ্রীনিবাসনের বদান্যতায় আর কিছুটা নিজস্ব ক্ষমতায় শিবা আইসিসির ক্রিকেট কমিটির সদস্য হন। বস্তুত শিবার প্রথম অধিনায়ক অনূর্ধ্ব উনিশের দিনে ছিলেন রবি শাস্ত্রী। তিনিও বলেন যে আশির দশকে তাঁর দেখা সেরা ন্যাচরাল ক্রিকেটারের হিসাব করতে বসলে কপিলের পরেই নাকি শিবার নাম আসত। ওই সামান্য বয়সেই শিবার ক্রিকেট বিশ্লেষণ ক্ষমতা ছিল দারুণ। যা আমরা ধারাভাষ্যে দেখতে পাই। আর ধারাভাষ্যের জন্য শিবা তাঁর স্ত্রীর অনুপ্রেরণায় নিয়মিত উচ্চারণ অনুশীলন করে করে তৈরি হয়েছেন।
আজকের শিবা আর আশির দশকের প্রতিভাবান শিবার মধ্যে এটাই পার্থক্য। ক্রিকেট তখনও বুঝতেন তিনি, এখনও। পরিশ্রমী ছিলেন তখনও। কিন্তু পরিশ্রমকে কীভাবে চ্যানেলাইজ করে সাফল্য পেতে হয়, সেটা বুঝতে বুঝতে অনেক কটা বছর পেরিয়ে যায়।
ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য শিবারামাকৃষ্ণর মাত্র ৯টি টেস্ট খেলা অপূরণীয় ক্ষতি। ঠিক যেভাবে রাজিন্দর গোয়েল, পদ্মাকর শিভালকর বা শ্যামসুন্দর মিত্রের টেস্ট না খেলাটা। কার ভুল কেন ভুল এসব বারবার করে মনে করিয়ে দেয়, বর্তমান ক্রিকেটের ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের গুরুত্ব। শারীরিকভাবে নয়, খেলাটা মানসিকভাবেও অনেক পেশাদার হয়েছে এখন। তাই হয় তো শার্দূল ঠাকুররা একটা টেস্ট খেলে হারিয়ে যেতে যেতেও ফিরে আসতে পারেন। হনুমা বিহারীরা দেশের মাটিতে একটাও সুযোগ না পেয়েও বারবার নিজেদের প্রমাণ করে আসন্ন লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে পারেন। অথচ নব্বইয়ের দশকের আগে পর্যন্ত এই দিকগুলি নিয়ে চর্চার অভাবে কত প্রতিভা অকালে ঝরে গেছে।
শিবারামাকৃষ্ণর কবিতা অণুকবিতা হয়েই থেকে যায়। প্রথম তিন টেস্টে যাঁর উনিশ উইকেট ছিল, যেখানে প্রথম টেস্টে কোনও উইকেটই ছিল না, তাঁরই ৯ টেস্টে মাত্র ২৬ উইকেটে টেস্ট কেরিয়ার শেষ করার মধ্যে এক অদ্ভূত শূণ্যতা আছে। তিনি ফিরে আসতে পারেন ধারাভাষ্যের মাইক হাতে নিয়ে কিন্তু ক্রিকেট দেবতার সোনার সুযোগ বোধহয় আর ফিরে আসে না।
কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক