ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে প্রথম বিশ্বমানের ক্রিকেটারের নাম জর্জ হেডলি – টেস্ট ক্রিকেটের রেকর্ড এই কথা বললেও কথাটা কিন্তু ঠিক নয়। ইন ফ্যাক্ট, জর্জ স্বমহিমায় প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন আগেই আরও এক ক্রিকেটার নিজের প্রাকৃতিক প্রতিভায় ক্রিকেট বিশ্বকে মোহিত করতে শুরু করেছিলেন। এবার তার কথাই বলবো।
লিয়ারি কন্টেস্টাইনকে পরিপূর্ণ ক্রিকেটার বলা যেতে পারে। প্রথম শ্রেণী, লিগ, টেস্ট – সব ধরনের খেলাতেই বিস্ফোরক ব্যাটিং করতে ভালোবাসতেন তিনি, সে ম্যাচের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন। তখনকার দিনে বলের হিসাব রাখা হত না, রানের রেট বিচার করা হত মিনিট ধরে। লিয়ারি কন্টেস্টাইন হামেশাই এক ঘণ্টার কম সময়ে সেঞ্চুরি করে চতুর্দিকে শোরগোল ফেলে দিতেন।
আর তার ইনিংসগুলো সাজানো থাকতো এমন কিছু স্ট্রোক দিয়ে যার কোন উপমা হয় না, অন্য কোন ব্যাটসম্যানের ব্যাট থেকে দেখাও যেত না। অনেক সময় মুহূর্তের ভগ্নাংশে একটা বিশেষ বোলারের বিশেষ ধরনের বল খেলার জন্যে সেগুলি আবিষ্কৃত হত, তারপর হয়ত লিয়ারি নিজেও আর কোনদিন সেই শট খেলতেন না। হয়ত শটগুলো নিজের ইচ্ছেতে খেলতেনও না – স্বত:স্ফূর্ত ভাবে পরিস্থিতির প্রভাবে সেগুলি বেরিয়ে আসতো ওনার ব্যাট থেকে।
এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ক্রিকেট লেখক সি. এল. আর. জেমস (তাঁর ‘বিয়ন্ড আ বাউন্ডারি’কে শুধু ক্রিকেটেরই ওপর নয়, ক্রীড়া বিষয়ক সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বইয়ের স্ট্যাটাস দিয়ে থাকেন অনেক বোদ্ধাই) শুধু একটা ঘটনার উল্লেখ করেছেন।
সে সময়ে জর্জ জন ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেরা বোলার। তার বিদ্যুৎগতির বলগুলো যে কোন ব্যাটসম্যানের বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। সেই জর্জ সেদিন কন্টেস্টাইনকে আউট না করতে পারলেও, অন্তত বেঁধে রাখার উদ্দেশ্যে কোমর বেঁধে নেমেছেন। তার মধ্যেই অফ স্ট্যাম্পের বাইরে একটা ফুল লেন্থের বলকে বাঁ পা বাড়িয়ে শেষ মুহূর্তে কব্জির মোচড়ে ফাইন লেগের মধ্যে দিয়ে সীমানার বাইরে পাঠালেন লিয়ারি। ফলো থ্রুতে কিছুক্ষন কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে আবার বোলিং মার্কের দিকে ফিরে গেলেন জর্জ। কিছুক্ষন পর আবার প্রায় একই রকম বলে একই রকম শট খেলে আরও একটা বাউণ্ডারি পেলেন লেয়ারি।
ব্যাস ওই শেষ! তারপর আর কোনদিন ওরকম শট খেলতে দেখা যায়নি কন্টেস্টাইনকে।
এবারে বোলিংয়ে আসি। শুরুতে মিডিয়ম পেস বোলার ছিলেন লিয়ারি। তারপর ঠিক করলেন নিজের বোলিং কে আরও ক্ষুরধার করে তুলবেন যাতে ইংল্যান্ডে গিয়ে সাফল্য পান। অচিরেই দুর্ধর্ষ গতির বোলার হয়ে উঠলেন তিনি, এমন কি ওনার একটা স্পেল খেলার পর জ্যাক হবস পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হন যে এরকম দুর্দান্ত গতির স্পেলের মুখোমুখি উনি এর আগে হননি। প্রায় দশ বছর ধরে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে খেলেন লিয়ারি, তার মধ্যে নিজের টিমকে চ্যম্পিয়ন করেন সাতবার, দু বার রানার আপ। এই দশ বছরে উইকেট প্রতি উনি রান দেন দশেরও কম!
তবে এখনও লিয়ারির ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করি নি – ফিল্ডিং। কভারে ওনার চেয়ে উন্নতমানের ফিল্ডার বিশ্ব ক্রিকেট দেখে নি – এ কথা যারাই ওনার ফিল্ডিং দেখেছেন এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন। মাঠের মধ্যে ওনার নাড়াচড়া দেখে বোঝাই যেত না যে তাঁর শরীরে হাড় বলে কোন বস্তু আছে, মনে হত পুরোটাই স্প্রিং আর বিয়ারিঙে তৈরি। আকাশ থেকে এমন কিছু ক্যাচ উনি পেড়ে আনতেন যা অন্য কোন ফিল্ডার আঙুল পর্যন্ত ছোঁয়ানোর কথা চিন্তা করতে পারতেন না।
দক্ষিণ আফ্রিকার কলিন ব্লান্ড বা আধুনিক কালে জন্টি রোডসকে অবশ্য এরপর অত্যন্ত উঁচু মানের ফিল্ডিং করতে দেখা গেছে। কলিনের ফিল্ডিং দেখতে না পেলেও জন্টিকে দেখেছি ব্যাটসম্যানের ভালো ভালো শটগুলিকে অনায়াসে ক্যাচে পরিনত করে ফেলত। লিয়ারি, কলিন না জন্টি – সর্বকালের সেরা ফিল্ডার কে এই বিবাদের মীমাংসা হয়ত তিনিই করতে পারবেন যিনি এই তিনজনেরই শ্রেষ্ঠ ফিল্ডিং নিজের চোখে দেখেছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে সেরকম মানুষ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই কারণ এঁদের সেরা সময়ের মধ্যে প্রায় ৭০-৮০ বছরের ফারাক আর দীর্ঘায়ু জাপানী মহিলারা ক্রিকেট যে খুব পছন্দ করেন এমন কোন খবর আমার কাছে জানা নেই।
পরের দিকে যখন সুপার ফাস্ট বোলিং শুরু করেন লিয়ারি তখন নিজের শক্তি সঞ্চয়ের জন্যে স্লিপে ফিল্ডিং শুরু করেন আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে ওঠেন স্লিপেরও বিশ্বের সেরা ফিল্ডার। যেহেতু কলিন ব্লান্ড বা জন্টি রোডস স্লিপে তেমন ফিল্ডিং করেন নি, সেহেতু সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অল রাউন্ড ফিল্ডারের খেতাব লিয়ারি কন্টেস্টাইনকে দিলে মনে হয় না কেও তেমন আপত্তি করবেন।
লিয়ারির ফিল্ডিং নিয়ে নেভিল কার্ডাস একটা ঘটনার উল্লেখ করেছেন তাঁর লেখায়। লিয়ারির সামনে সেদিন ব্যাট হাতে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাস্ট বোলার হারল্ড লারওয়ুড। একটা খাটো লেন্থের বল ডিফেন্স খেলতে গিয়ে ব্যাটের ওপরের দিকে লেগে একটু ওপরে উঠে গেল। দর্শকদের মধ্যে থেকে আফসোস করে উঠলেন কয়েকজন – ইস, যদি উইকেট কিপার আরও একটু সামনে থাকতো বা পয়েন্টের ফিল্ডার অতটা ডিপে না থেকে – আর তখনই সবাইকার চোখ গেল লিয়ারির শরীরের দিকে।
দুটো বিশাল স্টেপে – বা বলা উচিৎ চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতায় দুটো বিশাল লাফে লিয়ারি পৌঁছে গেলেন লারওয়ুডের পায়ের কাছে। মাত্র ইঞ্চি দুয়েকের জন্যে শেষ পর্যন্ত বলের নাগাল পেলেন না লিয়ারি কিন্তু ওনার প্রচেষ্টা দেখে লারওয়ুড সহ পুরো মাঠ হতবাক – একমাত্র লিয়ারি ছাড়া ঐ ক্যাচ ধরার কথা অন্য কেও চিন্তা পর্যন্ত করতে পারতেন না। ক্যাচটা নিয়ে উঠতে পারলে সেটা নি:সন্দেহে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ক্যাচগুলির একটা হত।
ঘটনাটা পড়ে আমার কেন কেসির লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘One Flew Over the Cuckoo’s Nest’-এর একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যায়। সেই দৃশ্যে উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র ম্যাকমারফি (বিখ্যাত অভিনেতা জ্যাক নিকলসন এঁর ভুমিকায় অভিনয় করেন – শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অস্কার পুরস্কারও পান। সিনেমা প্রেমীদের মতে এটাই ওনার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনয়।) বাজী রেখে একটা খুব ভারী বাক্স ওঠাবার চেষ্টা করেন। বাজী জিততে পারেন নি ম্যাকমারফি – প্রানপন চেষ্টা করেও সেদিন সেই বাক্স ওঠাতে পারেন নি তিনি কিন্তু ওনার সেই অমানুষিক চেষ্টা অনুপ্রাণিত করে অন্যদের তাদের বন্দীদশা কাটিয়ে উঠতে। কখনও কখনও জীবনের ব্যর্থতাই আমাদের চরিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিক পৃথিবীর আলোকে নিয়ে আসে।
লিয়ারির অলরাউন্ড দক্ষতার কথা উঠলেই ১৯২৮ সালের মিডলসেক্সের বিরুদ্ধে ওয়েস্ট ইন্ডিজের একটা ম্যাচের কথা ঘুরেফিরে আসে। মিডলসেক্সের সাড়ে তিনশোরও বেশি রানের জবাবে তাঁর দলের ৭৯ রানের মধ্যে পাঁচ উইকেট চলে যাওয়ার পর মাঠে নাবেন লিয়ারি। তারপর শুরু হয় তাঁর ব্যাট হাতে তাণ্ডব – প্রথম ১৮ মিনিটে ৫০ পূর্ণ করে, এক ঘণ্টারও কিছু কম সময়ের ওনার ঝড় শেষ হলে দেখা গেল ওনার রান ৮৬। তারপর বল হাতে মিডলসেক্সের দ্বিতীয় ইনিংস প্রায় একার হাতেই শেষ করে দেন লিয়ারি – তাঁর বোলিং অ্যানালাইসিস ৭/৫৭।
তার মধ্যে শেষ স্পেলে মাত্র ১১ রান দিয়ে ৬ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে ২৫৯ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে ১২১ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে যখন প্রায় নিশ্চিত হারের মুখে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আবার প্রতি আক্রমন শুরু করলেন লিয়ারি। এবার ১০৩ রান বেরিয়ে এলো ৬০ মিনিটে – ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতল দুই উইকেটে। দুশোর ওপর রান, ১১টি উইকেট, গোটা কয়েক অবিশ্বাস্য ক্যাচ – একটা ম্যাচে এরকম অলরাউন্ড পারফর্মেন্স তার আগে বা পরে খুব বেশী দেখা যায় নি বিশ্ব ক্রিকেটে। আর হ্যাঁ, সেই ম্যাচে নাকি লিয়ারি চোটের কারণে সম্পূর্ণ ফিট ছিলেন না!
তবে অন্যান্য মহান অলরাউন্ডারদের সঙ্গে তুলনায় একটা জায়গায় পিছিয়ে পড়েন লিয়ারি কন্টেস্টাইন। টেস্ট ক্রিকেটে ওনার রেকর্ড ইম্প্রেসিভ নয় একেবারেই। এর মুল কারণ দুটো – এক, ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে টেস্ট খেলার চেয়ে অনেক সময়েই ল্যঙ্কাশায়ার লিগে নেলসন ক্লাবের হয়ে খেলাকে উনি বেশি গুরুত্ব দিতেন শুধুমাত্র এই কারণে যে ক্লাব ক্রিকেট ওনাকে আর্থিক স্বচ্ছলতা দেয় যা জাতীয় দল তাঁকে দিতে ব্যর্থ হয়।
দ্বিতীয়, সতীর্থদের বার বার অনুরোধ সত্বেও নিজের তিনি নিজের ব্যাটিং কে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন নি। তারই ফলস্বরূপ যতই নেভিল কার্ডাস ওনার ব্যাটিংকে ‘ব্র্যাডম্যান আর রঞ্জির সংমিশ্রণ’ বলে মনে করুন, তাঁর ব্যাটিংয়ে সেই ধারাবাহিকতা ছিল না যা একজন গ্রেট ব্যাটসম্যানের ব্যাট থেকে কাম্য।
এরকম ন্যাচারাল ক্রিকেটার বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আরও একবার ক্রিকেট বিশ্বে দেখা যায়। তিনিও উইকেটের কাছে এবং দূরে সে সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফিল্ডার, ওনারও ব্যাট থেকে এমন কিছু ইনিংস বেরোতে দেখা গেছে যা সর্বকালের সেরাদের মধ্যে পড়ে, আর বল হাতে তিনি এক সময় ছিলেন টেস্ট আর একদিনের ম্যাচে বিশ্বের সর্বাধিক উইকেট শিকারি। দুর্ভাগ্য এই যে উনিও নিজের ব্যাটিং কে উপেক্ষা করে গেছেন সারা জীবন আর সেজন্যেই ওনার ব্যাটিং রেকর্ড ওনার প্রতিভার প্রতি সুবিচার করে নি কোনদিন।
আমাদের ‘হরিয়ানা হ্যারিকেন’এর ন্যাচারাল ক্রিকেট দেখেও লিয়ারি কন্টেস্টাইনকে মনে পড়ে গেছিল পুরনো সময়ের অনেক ক্রিকেট বোদ্ধারই। তবে লিয়ারিকে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কপিলদেব বলবেন না কপিলদেবকে ভারতের লিয়ারি বলবেন সেটার ডিসিজন পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।