সিস্টেম বদলান, দর্শক ফেরান

জাতীয় দলের হয়ে অতীতে তার দশ-পনেরো হাজার রান থাকতে পারে, ২০-৩০ ম্যাচে ডিফেন্ড করার যোগ্যতা থাকতে পারে কিন্তু সিস্টেমের সাথে না মিললে তাকে বাদ দিয়েই এগোতে হবে। অন্যথায়, চট্টগ্রামে যে দর্শক খরা শুরু হলো, তার সমাপ্তি ঘটবে দলের বিলুপ্তির মাধ্যমে। জয় এসেছে শেষে, দর্শক হয়তো এমনিই ফেরত আসবে মাঠে। তবে, সিস্টেমের অবক্ষয় না পাল্টালে আসলে লম্বা দৌঁড়ে এটা এটা অশনি সংকেতও বটে।

গত ৫ বছরে ক্রিকেটারদের সব থেকে বড় পরিবর্তনটি এসেছে তাঁদের মানসিকতায়। ব্যাটাররা প্রথমে তাদের চিন্তার জায়গা পরিবর্তন করেছেন। ‘উইকেটে সেট হবো, উইকেট বিলিয়ে দেয়া যাবে না, শেষ ১০-১৫ ওভারে যতটা রান তোলা যায়’ ধারণা থেকে বের হয়ে সহজ ধারণা ‘ব্যাটারদের কাজ রান করা, যতটা সম্ভব বেশি করা’ তে রূপান্তরিত হওয়া সমগ্র ক্রিকেট সংস্কৃতিকেই পরিবর্তন করে ফেলেছে।

৫ বছর পূর্বেও স্লো, টার্নিং উইকেটে ২৫০ এর কাছাকাছি রান করলে প্রতিপক্ষের শেলের মধ্যে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তারা খেলাটি শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে জয়ের চেষ্টা করতেন।

ফলে আগে ব্যাটিং করা দলগুলোর পক্ষে স্কোর ডিফেন্ড করার সুযোগ ছিল। এমন কি অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাটিং উইকেটেও কোন দল ৩০০ রান করলে রান চাপিয়ে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করতেন এবং অধিকাংশ সময় ডিফেন্ড করা সম্ভবও হত। বর্তমান ক্রিকেটে তেমন ঘটে না।

যে কোন দল জানে, কোন রানই ডিফেন্ডাবল নয়। প্রতিপক্ষ ৫০ ওভার ব্যাটিং করলে যে কোন রান চেজ করা সম্ভব। জিততে চাইলে উইকেট নিয়েই জিততে হবে। ফলে ব্যাটারদের সাথে সাথে বোলারদের মানসিকতায়ও পরিবর্তন এসেছে। তারা উইকেট আদায়ের জন্য বোলিং করছেন। প্রতিটা দলে রান সেভিং বোলাররা উইকেট টেকিং বোলার দিয়ে রিপ্লেস হয়েছেন।

অধিনায়কত্বের ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। এই মুহূর্তে একটা ইনিংসের ৩০-৩৫ ওভারের সময় স্লিপে ফিল্ডার দেখা যাবে, পয়েন্ট ফাঁকা রেখে গালিতে ফিল্ডার রাখতে দেখা যাবে, অথবা মাঠের একটা অংশ ফাঁকা রেখে ব্যাটারকে সেখানে শট খেলতে উদ্বুদ্ধ করতে দেখা যাবে।

অর্থাৎ উইকেট নেয়ার জন্য যেভাবে ফিল্ডার সাজানো সম্ভব, যেভাবে বোলিং পরিবর্তন সম্ভব কিংবা ব্যাটিং পজিশন চেঞ্জ করা সম্ভব, তার সবকিছুই একজন অধিনায়কের মধ্যে দেখা যাবে।

বর্তমান সময়ে ম্যাচ জিততে চাইলে একটা দলের ব্যাটিং ইউনিটকে যত সম্ভব বেশি রান করার জন্য খেলতে হবে, বোলিং ইউনিটকে উইকেট নেয়ার জন্য বল করতে হবে, অধিনায়ককে এভাবেই ফিল্ড এবং বোলার সেট করতে হবে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, এই কাজগুলো যে ধরনের খেলোয়াড়েরা করতে পারেন, তাদের নিয়েই দল সাজাতে হবে।

এখানে সিস্টেম সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কোন ব্যক্তি খেলোয়াড় নয়। সিস্টেমে না মিললে জো রুটও বাদ পরতে পারেন। বর্তমানে সবথেকে দীর্ঘ সংস্করণ, টেস্ট ক্রিকেটেও ব্যাটাররা যত দ্রুত যতসম্ভব রান করায় মনোযোগী হচ্ছেন। এবং ক্ষুদ্রতর সংস্করণ, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও বোলাররা উইকেট নেয়াকেই গুরুত্ব প্রদান করেন।

এত এত কথা বলার পরে যদি বাংলাদেশ জাতীয় দলের দিকে তাকাই, দলে দুইজন ব্যাটার, সাকিব এবং লিটন, আছেন যারা যত দ্রুত সম্ভব রানের জন্য ব্যাটিং করতে পারেন। বাকিদের দায়িত্ব ২০০৭ সালের ক্রিকেট খেলা। ৫ বোলারের মধ্যে কেবলমাত্র তাসকিন উইকেট আদায়ের জন্য বোলিং করেন।

ম্যাচের পর ম্যাচ উইকেট শূন্য থেকে, প্রতিপক্ষের জন্য কোন ধরনের থ্রেট তৈরি না করে বাকিরা খেলে যেতে পারেন। এবং আমাদের অধিনায়ক ইংল্যান্ডের ৮ উইকেট চলে যাওয়ার পরেও দিনের সেরা দুই উইকেট টেকার সাকিব-এবাদতকে বোলিংয়ে ফিরিয়ে ম্যাচ শেষ করার চেষ্টা করেন না।

তাইজুল-মিরাজের কোটা শেষ হবার পরেই তাদের সুযোগ মেলে। পিছন থেকে উইকেট কিপারের ভয়েস শোনা যায়, ‘সিঙ্গেল হোক, সমস্যা নাই। ওভারে একটা-দুইটা ডট বল দিতে হবে, তাহলেই হবে।’

এভাবে আর যাই হোক, ক্রিকেট হয় না। আধুনিক ক্রিকেট এভাবে কাজ করে না। আধুনিক ক্রিকেটে টিকে থাকতে চাইলে, আধুনিক ক্রিকেটের নিয়মেই টিকে থাকতে হবে। যারা এই নিয়মের সাথে যায় না, তাদের সরিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

জাতীয় দলের হয়ে অতীতে তার দশ-পনেরো হাজার রান থাকতে পারে, ২০-৩০ ম্যাচে ডিফেন্ড করার যোগ্যতা থাকতে পারে কিন্তু সিস্টেমের সাথে না মিললে তাকে বাদ দিয়েই এগোতে হবে। অন্যথায়, চট্টগ্রামে যে দর্শক খরা শুরু হলো, তার সমাপ্তি ঘটবে দলের বিলুপ্তির মাধ্যমে। জয় এসেছে শেষে, দর্শক হয়তো এমনিই ফেরত আসবে মাঠে। তবে, সিস্টেমের অবক্ষয় না পাল্টালে আসলে লম্বা দৌঁড়ে এটা একটা অশনি সংকেতও বটে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...