শান্ত উঠুক শিখরে

কোচ আসেন, কোচ ফিরে যান। ঐ আবির্ভাব-প্রস্থানের মাঝেও বাংলাদেশ ক্রিকেটে বেশ ক’বছর ধরে তাদের পছন্দের তালিকায় একজন ‘ধ্রুব’ হয়েই থাকেন। তিনি ওপেনার নাজমুল হোসেন শান্ত। যুব ক্রিকেটে দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন। হয়েছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ব্যাটার। সে রেকর্ডটা অবশ্য এখনো তাঁর দখলেই রয়েছে।

যুব ক্রিকেটে সেই ঝলকানিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট পাড়ায় হয়েছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তবে যতটা সম্ভাবনা নিয়ে দলে এসেছিলেন তার কানাকড়িও দেখা মেলেনি তাঁর ব্যাটে। সমর্থকদের হতাশায় ভাসিয়েছেন। তাকে নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা করা নীতি নির্ধারকদের ভাবনাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে বাধ্য করেছেন। তবে সেই শান্তই অবশেষে ফিরলেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হাসলো তাঁর ব্যাট। ব্যাটিংয়ে শুরুর অস্বস্তি কাটিয়ে খেললেন ৫৫ বলে ৭১ রানের ইনিংস। 

বেশ কঠিন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন শান্ত। টুকটাক রান করছিলেন। তবে দলের প্রভাবক হয়ে উঠতে পারছিলেন না। সমর্থকদের তোপের মুখে আগে থেকেই ছিলেন। সেটা দিনের পর দিন বরং ঘণীভূতই হচ্ছিল। বাইরের এতসব চাপের মাঝেও একটি ইনিংস শান্ত’র জন্য খুব জরুরিই হয়ে পড়েছিল। অবশেষে গ্যাবার ঐতিহাসিক মাঠে শান্তর ব্যাট হয়ে উঠল অশান্ত। দুর্দান্ত এক ইনিংসের মাধ্যমে নিজের মাঝেও কিছুটা আত্মবিশ্বাসের জোগান দিলেন। 

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নিজের প্রথম ফিফটি। অবশ্যই স্পেশাল কিছু। এ নিয়ে প্রেস কনফারেন্সে নিজেও জানিয়েছেন অনুভূতির কথা। তিনি বলেছেন, ‘শেষ কিছু ম্যাচে শুরুটা ভালই পাচ্ছিলাম। কিন্তু সেটাকে বড় ইনিংসে রূপান্তর করতে পারছিলাম না। আজ সেটা পেয়েছি। আর এটা আমার প্রথম ফিফটি। অবশ্যই ভাল লাগছে। আলহামদুলিল্লাহ।’

ইনিংসের প্রথম ৩০ বলে ৩০ রান। পরের ২৫ বলে ৪১ রান। তবে কি ব্যাটিংয়ের শুরুতে একটু চাপের মাঝে ছিলেন শান্ত। সেটি অবশ্য স্বীকার করেননি তিনি। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর মনযোগ শুধু ব্যাটিংয়েই ছিল। স্ট্রাইকরেট নিয়ে তেমন একটা চিন্তা করেননি। আর শুরুতে এমন ধীর গতির ব্যাটিংটা কি টিম ম্যানেজমেন্টের পরিকল্পনার অংশ, এমন প্রশ্নে অবশ্য মুখই খুলতে চাননি শান্ত। জানিয়েছেন, টিম প্ল্যানটা গোপন থাকাই শ্রেয়। 

বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাওয়ার পর গণমাধ্যম থেকে সমর্থক- প্রায় সবার কাছেই বেশ তোপের মুখেই ছিলেন শান্ত। তবে শান্তকে নিয়ে বড্ড আশাবাদীই ছিলেন টেকনিক্যান কনসালটেন্ট শ্রীধরণ শ্রীরাম। গণমাধ্যমের কাছেও শুনিয়ে ছিলেন শান্তকে নিয়ে উচ্চাশার কথা। আপাতত শ্রীধরণ শ্রীরাম সেই পর্যবেক্ষণে বেশ ভালভাবেই উতরে গেছেন বলা যায়। এ বারের বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের একমাত্র ফিফটিটা এসেছে শান্তর ব্যাট থেকে। একই সাথে, সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ রানের দিক দিয়েও রয়েছেন দলের শীর্ষে। 

নাজমুল হোসেন শান্তের ক্যারিয়ারের সালতামামি করলে একটি বিশেষণই যুক্ত করা যায়। বড্ড অধারাবাহিক। অন্তত বছরের পরিক্রমায় ম্যাচের পর ম্যাচে তাঁর সাথে যুক্ত হওয়া সংখ্যাগুলো সেটাই নির্দেশ করে। তবে শান্ত লম্বা ইনিংস খেলা ব্যাটার। গত বছরেই পাল্লেকেল্লেতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলেছিলেন ১৬৩ রানের লম্বা একটি ইনিংস। মাস দুয়েক পরেই, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আরো একটি সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। হারারেতে সে ইনিংসে খেলেছিলেন অপরাজিত ১১৭ রানের ইনিংস।

দুটোই টেস্টের ইনিংস। তাহলে সেই ইনিংসের এই সময়ে টেনে আনার কারণ? কারণটা অতি সাধারণ। শান্তকে নিয়ে যেমন ক্রিকেট সমর্থকরা অতি অশান্ত হয়ে ওঠেন সেই শান্ত ততটাও বাজে পারফর্মার নন। তাঁর ব্যাটিংয়ের অফফর্ম নিয়ে কথা হতেই পারে। তাঁর টেকনিক নিয়ে দু চার কলম ক্রিকেট শাস্ত্র রচনা করা যেতে পারে। কিন্তু তাঁর মধ্যে যে সম্ভাবনা, সক্ষমতা, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা বড্ড বেমানান। 

ক্রিকেটে শূণ্য থেকে শিখরে যাওয়ার গল্প অনেক। লঙ্কান কিংবদন্তি মারভান আতাপাত্তুর ক্যারিয়ারের প্রথম দিকটার চিত্র ছিল একদম হতশ্রী। অথচ সেই আতাপাত্তুই পরবর্তীতে লঙ্কান ক্রিকেট আকাশে নক্ষত্ররূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের লিটন দাসের কথাই ধরা যাক। গত বছরের এমন একটা সময়েও তিনি সমালোচনা বিদ্ধ হতেন প্রতি নিয়ত। অথচ সেই লিটনই এক বছরের মাঝে নিজেকে বদলে ফেললেন। গত ১ বছরে বাবর আজমের পর তিনিই তো রানের দিক দিয়ে রয়েছেন শীর্ষে। 

টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডে ফরম্যাট মিলিয়ে রঙিন পোশাকে শান্ত ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ২৮ টি। টি-টোয়েন্টিতে নিজের ১৫ তম ইনিংসে এসে পেয়েছেন ফিফটি। আর এই ইনিংসটা তিনি পেয়েছেন টানা ম্যাচ খেলার সুযোগের কারণে। তবে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ওয়ানডে ক্যারিয়ারে তাঁর অভিষেকটা ২০১৮ সালে হলেও এর পরে তিনি ম্যাচ খেলেছেন দলে আসা যাওয়ার মধ্য দিয়ে।

১৩ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ার। সেখানেও বিরতি। যখনই দলে ফিরেছেন, রান করতেই হবে এমন একটা পাহাড়সম চাপ নিয়ে খেলতে নেমেছেন। এমনিতে ছোট্ট ক্যারিয়ার, তাঁর উপর মাঝে মধ্যেই দল থেকে বাদ। এমন একটা ক্যারিয়ার নিয়ে তাই আর যাই হোক, একটি সিদ্ধান্তে পৌছানো যায় না। ভাল, কিংবা খারাপ, সেই মন্তব্যও সাময়িক সময় বিবেচনা করে করা যায় না। 

৭১ রানের ইনিংসের পর শান্ত সহসাই নিজেকে আমূল বদলে ফেললেন ব্যাপারটা এমন নয়। তবে তাঁকে নিয়ে কোনো চূড়ান্ত মন্তব্য করার সময়টা এখনই নয়। শান্তর শুরুর অধ্যায়টা হয়তো বেমানান। তবে সেটাকে চিত্তাকর্ষক করার সব পথই তাঁর জন্য উন্মুক্ত। চাইলে তিনি বিশ্ব ক্রিকেটের আরো ক্রিকেটার থেকে অনুপ্রেরণাও নিতে পারেন। তবে এমন একটি ইনিংসের পর তৃপ্তি জেঁকে বসলেই সমস্যা। প্রত্যেক ম্যাচে তাঁকে সেই শূণ্য থেকেই শুরু করতে হবে। শান্ত নিশ্চয়ই শূণ্যতেই থামতে চান না, যেতে চান শিখরে।        

 

 

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link