উইকেটের পেছনে এক কিংবদন্তি

উইকেটের পেছনে সাপের মত নড়াচড়া এবং বিদ্যুতের মত স্ট্যাম্পিং তো ছিলই। হিলির মূল দক্ষতাটা ছিল ক্যাচ নেওয়ার ক্ষেত্রে। টেস্টে যখন অবসর নিলেন, তখন তাঁর নামের পাশে বিশ্ব রেকর্ড ৩৯৫ ডিসমিসাল। মার্শের ৩৫৫ ডিসমিসাল টপকে এই রেকর্ড করেছিলেন হিলি।

ছেলেটা বড়ই দূরন্ত ছিল।

বাবার ব্যাংকের চাকরি। ব্রিসবেন থেকে বদলী হয়ে এসেছেন ৬০০ কিলোমিটার দূরের বিলোয়েলা শহরে। এখানে আর দশটা ছেলের সাথে মিশে সবকিছু খেলা শুরু করলো ছেলেটা। কখনো স্কোয়াশ, কখনো বাস্কেটবল, কখনো রাগবি, কখনো ফুটবল। আবার ক্রিকেটও খেলে ছেলেটা। কখনো বোলিং করে, কখনো ব্যাটিং এবং কখনো কিপিং।

এই ছেলেটিকে একবার খেলার মাঠে দেখলেন রড মার্শ; সর্বকালের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক রডনি মার্শ।

ছেলেটির কিপিং দেখে অভিভূত হয়ে বললেন, ‘তুমি ক্রিকেটটাই মন দিয়ে খেলো এবং উইকেটকিপিং করো।’

ছেলেটা অবাক হয়ে জানতে চায়, ‘আমি ভালো কিপার হতে পারবো?’

রড মার্শ বলেন, একদিন ছেলেটি সেরা হবে।

রড মার্শ এই বলার জন্য কোনো পুরস্কার পেয়েছেন কি না, জানা নেই। কেউ তাঁকে ‘ধন্যবাদ’ বলেছে, কি না, তাও জানা নেই। তবে তিনি সেদিন একটা কাজের কাজ করেছিলেন। নিজের উত্তরসুরী তৈরী করেছিলেন। বলা ভালো, সর্বকালের সেরা এক উইকেটরক্ষকের জন্ম দিয়েছিলেন। কারণ, সেই ছেলেটি কালক্রমে একদিন মার্শের ছেড়ে যাওয়া দস্তানা জোড়া হাতে গলিয়েছিল এবং হয়ে উঠেছিল কিংবদন্তি উইকেটরক্ষক।

হ্যাঁ, সেই ছেলেটি ছিল ইয়ান অ্যান্ড্রু হিলি; অস্ট্রেলিয় গল্পগাঁথার নায়ক ইয়ান হিলি। অস্ট্রেলিয়ার স্বর্ণযুগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এই হিলি। আধুনিক উইকেট কিপিংয়ের ম্যানুয়াল ইয়ান হিলি।

ব্রিসবেনের শহরতলী স্প্রিং হিলে জন্ম ইয়ান হিলির। আগেই বলেছি, বাবার ছিল বদলীর চাকরি। সে সুবাকে ঘুরে ফিরে ১৭ বছর বয়সে আবার ব্রিসবেনে থিতু হয় হিলির পরিবার। ব্রিসবেন স্টেট স্কুলের হয়ে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট শুরু করেন। এরপর বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলেছেন কুইন্সল্যান্ডের হয়ে।

কুইন্সল্যান্ড কোল্টের হয়ে স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেক হয়েছিল। তিন ম্যাচ খেলার পরই প্রথম শ্রেনীর দলে ডাক এল তার। কারণ, কুইন্সল্যান্ডের নিয়মিত উইকেটরক্ষক পিটার অ্যান্ডরসন ইনজুরিতে ছিলেন। পিটার ফেরার পর গ্লাভসটা তাকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ফলে পুরো মৌসুমে হিলি মাত্র ৬টা ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন।

আর এই ছয়টি প্রথম শ্রেনীর ম্যাচের অভিজ্ঞতা নিয়েই ১৯৮৮ সালে পাকিস্তান সফরে যাওয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলে ডাক পেয়ে গেলেন হিলি।

সেই সময়টা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। ১৯৮৪ সালে রড মার্শ অবসর নেন। এরপর চার বছর ধরে অস্ট্রেলিয়া হন্যে হয়ে উইকেটের পেছনে এক জোড়া নির্ভরযোগ্য হাত খোঁজ করছিল। এই সময়ে কমসে কম চার জন উইকেটরক্ষককে সুযোগ দিয়ে দেখেছে অস্ট্রেলিয়া; তাঁরা কেউ নিজেদের প্রমাণ করতে পারেননি।

কুইন্সল্যান্ডের হয়ে হিলির কিপিং এই সময়ে মনে ধরেছিল তখনকার নির্বাচক গ্রেগ চ্যাপেলের। তিনিই জোর করলেন হিলিকে মাঠে নামানোর জন্য। সেই সুবাদে পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক হয়ে গেল হিলির। প্রথম সিরিজে অন্তত চোখ ধাঁধানো কিছু করতে পারেননি। তারপরও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হোম সিরিজেও তার ওপর ভরসা রাখা হলো।

দুটি সিরিজই অস্ট্রেলিয়া হারলেও মার্ক টেলরের দল ততোদিনে বুঝে ফেলতে পেরেছে যে, তারা রডনি মার্শের উত্তরসূরি পেয়ে গেছে। পরের এক দশক অস্ট্রেলিয়াকে আর উইকেটের পেছনের ব্যাপার স্যাপার নিয়ে ভাবতে হয়নি। হিলি হয়ে উঠেছেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের ব্র্যান্ড।

উইকেটের পেছন থেকে কিছুটা নাকি সুরে তার ‘বোলিং ওয়ার্নি’ চিৎকার অনেক ব্যাটসম্যানের ঘুম কেড়ে নিয়েছে এই দশকে।

দস্তানা দিয়েও কম কীর্তি করেননি। উইকেটের পেছনে সাপের মত নড়াচড়া এবং বিদ্যুতের মত স্ট্যাম্পিং তো ছিলই। হিলির মূল দক্ষতাটা ছিল ক্যাচ নেওয়ার ক্ষেত্রে। টেস্টে যখন অবসর নিলেন, তখন তার নামের পাশে বিশ্ব রেকর্ড ৩৯৫ ডিসমিসাল। মার্শের ৩৫৫ ডিসমিসাল টপকে এই রেকর্ড করেছিলেন হিলি। পরে বাউচার ও গিলক্রিস্ট এই রেকর্ড টপকে যান।

ওয়ানডেতেও হিলি একসময় বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী ছিলেন। ২৩৩ শিকার নিয়ে অবসরে গেছেন। পরে গিলক্রিস্ট, বাউচার, মঈন, সাঙ্গাকারা ও ধোনি এই শিকার টপকে গেছেন।

দুটো তালিকাতেই গিলক্রিস্টের নাম দেখলেন তো? আর এই নামটিই হিলির অবসরকে অন্তত দুই-তিন মৌসুম এগিয়ে এনেছিল।

বলা ভালো, হিলির দুর্বল ব্যাটিং তাঁকে বিপাকে ফেলেছিল।

হিলি ১৬৮ ওয়ানডেতে ১৭৬৪ রান করেছিলেন। গড় ছিল ২১.০০। অন্যদিকে, ১১৯ টেস্টে ৪৩৫৬ রান করেছিলেন। গড় ছিল ২৭.৩৯।

একটা সময় উইকেটরক্ষকদের বিবেচনায় এই রানটা বেশ ভালো ছিল। কিন্তু সেই সময়, মানে নব্বইয়ের দশকে দুনিয়া জুড়ে কিপাররা ব্যাটসম্যান হয়ে উঠছিলেন। ফলে কালুভিতারানা, মঈন খান, বাউচারদের একটা জবাব অস্ট্রেলিয়ার দরকার ছিল।

১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপ ফাইনালের হারটা মেনে নিতে পারছিলো না অস্ট্রেলিয়া। তারা পর্যবেক্ষণ করেছিল মূলত উইকেটরক্ষকের জন্য একটা ব্যাটিং পজিশন নষ্ট করছে তারা। আর তাঁদের এই ভাবনায় আগুন জ্বালিয়ে দিলো অ্যাডাম গিলক্রিস্ট নামে এক তরুণ।

১৯৯৭ সালে অস্ট্রেলিয়া আলাদা ওয়ানডে দল করলো। সেখান থেকে মার্ক টেলর ও হিলি বাদ পড়লেন। হিলির বদলে এলেন এই গিলক্রিস্ট। প্রচুর সমালোচনা হলো। বলা হলো, মারকাটারি ব্যাটিংয়ের মোহে পড়ে অস্ট্রেলিয়া ভালো কিপিংয়ের সাথে আপোষ করছে। কিন্তু গিলক্রিস্ট কালক্রমে নিজেকে ‘হিলির চেয়েও ভালো’ বলে প্রমাণ করেন এবং ব্যাটিংয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন।

১৯৯৯ সালে যাচ্ছেতাই একটা শ্রীলঙ্কা সফরের পর তাঁর টেস্টেও ভাগ্যটা লেখা হয়ে গেলো। হিলি যদিও আরেকটা মৌসুম, শেষ পর্যন্ত একটা বিদায়ী টেস্ট চেয়েছিলেন। পাননি। গিলক্রিস্ট দুটো জায়গাই দ্রুত দখল করে নেন। ফলে হিলিকে এক রকম নীরবেই বিদায় নিতে হলো।

ক্রিকেট ছাড়ার পর ধারাভাষ্য ও উপস্থাপনায় ভালোই করছেন হিলি। ভাইয়ের মেয়ে এলিসা হিলি মেয়েদের ক্রিকেটে তার নাম রেখেছেন। এলিসার জামাতা মিশেল স্টার্কও পরিবারের সুনাম ধরে রেখেছেন। এর মধ্যেও হিলির গোপন ব্যাথাটা ঠিকই আছে – আরেকটু সময় যদি পেতাম!

কিন্তু দুনিয়াটা এমনই। এখানে একজন হিলির জন্য কেউ আটকে থাকে না। একজন গিলক্রিস্ট এসে আরেক স্তরে নিয়ে যায় খেলাটাকে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...