কৃষ্ণা‘মারকাটারি’ শ্রীকান্ত

শ্রীকান্তের ভেতরে একটা ‘এক্স ফ্যাক্টর’ ছিল যা তাঁকে সমর্থকদের প্রিয় পাত্রে পরিণত করে। কী সেই এক্স ফ্যাক্টর? ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রিধারী শ্রীকান্ত ছিলেন ভীষণ ভয়ডরহীন এক ওপেনার। সামনে ক্যারিবিয়ান পেস কিংবা অজি গতি – যাই থাকুক না কেন তিনি ছিলেন অবিচল। তবে, অবিচল থাকতে গিয়ে উইকেট ‘উপহার’ দিয়ে আসার ঘটনাও ঘটেছে বিস্তর।

আশির দশকের চেন্নাই। জায়গাটা তখন পরিচিত ছিল মাদ্রাজ নামে। ‘সুপার স্টার’ বলতে তথন একজন মানুষকেই চিনতো মাদ্রাজ। তিনি হলেন রজনীকান্ত, ফিল্ম স্টার। তবে, এর মধ্যেও আরেক জন মানুষের জন্য হৃদয়ের কোণে জায়গা গড়ে উঠেছিল তাঁদের। তিনি হলেন কৃষ্ণামাচারি শ্রীকান্ত।

তবে, মাদ্রাজ থেকে বের হওয়া প্রথম ‘টপ ক্লাস’ ক্রিকেটার তিনি নন। প্রথম যিনি আসেন তিনি হলেন শ্রীনিবাস ভেঙ্কেটরাঘবন, যিনি টেস্টে ১৫০-এর ওপর উইকেটের মালিক। কেবল ১৯৭১ সালেই তিনি পেয়েছিলেন ৩৫ উইকেট, যা ছিল সে বছরের সর্বোচ্চ। তবে, শ্রীকান্তের ভেতরে একটা ‘এক্স ফ্যাক্টর’ ছিল যা তাঁকে সমর্থকদের প্রিয় পাত্রে পরিণত করে।

কী সেই এক্স ফ্যাক্টর? ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রিধারী শ্রীকান্ত ছিলেন ভীষণ ভয়ডরহীন এক ওপেনার। সামনে ক্যারিবিয়ান পেস কিংবা অজি গতি – যাই থাকুক না কেন তিনি ছিলেন অবিচল। তবে, অবিচল থাকতে গিয়ে উইকেট ‘উপহার’ দিয়ে আসার ঘটনাও ঘটেছে বিস্তর।

১৯৮৩’র ফাইনালের সর্বোচ্চ স্কোর, ১৯৮৫ সালে এমসিজিতে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ অব ক্রিকেটের ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ সেরার পুরস্কার – ইত্যাদি ছিল তাঁর সুপার স্টারডমের মুকুটের একেকটি পালক। ভারতে তখন, ওপেনার হিসেবে কৃষ্ণামাচারির কোনো বিকল্প ছিল না। বিশেষ করে, মেক শিফট ওপেনার রবি শাস্ত্রীর সাথে তাঁর জুটি বেশ জমে গিয়েছিল।

ড্রেসিং রুমেও তিনি ছিলেন সকলের প্রিয়। হাসিখুশি মানুষটি বিখ্যাত ছিলেন তাঁর ‘সেন্স অব হিউমার’—এর জন্যও। একাধারে তিনি খানিকটা খামখেয়ালিও ছিলেন। নয়তো, ক্যারিয়ারে রান আরও বেশি হতে পারতো। এই ব্যাপারে তাঁর অভিষেক টেস্টের কথা না বললেই নয়।

১৯৮১ সালে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে সেই ম্যাচটা ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তিনি প্রথম টেস্টেই ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় লজ্জার শিকার হন। বলটা অফ সাইডে ঠেলে দিয়ে ক্রিজে একটু এগিয়ে গিয়ে ক্যাজুয়ালি হাঁটছিলেন, এমন সময় জন এম্বুরি তাকে রান আউট করে ফেলেন!

বোলিংটা ছিল তাঁর সুপ্ত প্রতিভা। ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অফস্পিনে মাত্র ২৭ রান দিয়ে নিয়েছিলেন পাঁচ উইকেট। সেই ম্যাচটা এক হাতেই ভারতকে জেতান শ্রীকান্ত। ব্যাটিংয়ে করেন ৭০ বলে ৮৭ রান। ভারত জেতে ৮৭ রানে।

যদিও, ওয়ানডেতে তাঁর উইকেট সংখ্যা মাত্র ২৫। এর মধ্যে ১৭ টি তিনি নিয়েছেন মাত্র ছয় ওয়ানডেতে। বাকি ১৪০ ম্যাচে আট উইকেট! বোঝাই যায়, বোলিংয়ে কতটা অনিয়মিত ছিলেন তিনি। অধিকাংশ ম্যাচে তিনি বলই হাতে নিতেন না। এমনকি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচের আগে খেলা ১০৩ টি ওয়ানডেতে তিনি বল হাতে নিয়েছেন মোটে ১৩ টি ম্যাচে।

শ্রীকান্ত আসলে সীমিত ওভারের প্রথম দুই দশকে ভারতের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান ছিলেন। তিনি হলেন প্রথম ভারতীয় ব্যাটসম্যান যিনি ওয়ানডেতে চার হাজার রানের মাইল ফলক ছুঁয়েছিলেন। ওই সময় ম্যাচ সেরার পুরস্কারে তাঁর চেয়ে আর কোনো ভারতীয়ই এগিয়ে ছিল না। ওয়ানডে সেঞ্চুরিতেও তিনি এগিয়ে ছিলেন সবার চেয়ে। সেটা ভাঙে ১৯৯৪ সালে এসে, যখন তাঁকে ছাড়িয়ে যান নভজোৎ সিং সিধু।

বীরেন্দ্র শেবাগ যখন প্রথম ক্রিকেটে আসেন, তখন একই রকম ভয়ডরহীন মানসিকতার জন্য তাঁকে ‘একালের শ্রীকান্ত’ বলা হত। যদিও, পরবর্তীতে শেবাগ মহীরূহ হয়ে যান। মারকাটারি ব্যাটিংয়ের জন্য বিশ্বজোড়া এতটাই খ্যাতি পান যে, তাঁর সাথে তুলনা হত স্বয়ং ভিভ রিচার্ডসনের।

তবে, শ্রীকান্তের মাদ্রাজের ভক্তকুল তাতে থোড়াই কেয়ার করতো। তাঁদের চোখে আজো লেগে আছে অ্যান্ডি রবার্টসের বিপক্ষে খেলা সেই স্কয়ার ড্রাইভ, কিংবা ম্যালকম মার্শালকে হুক করে হাঁকানো সেই ছক্কা। রজনীকান্তের আলোচনায় সব সময় গুরুগম্ভীর আলোচনা হয় না চেন্নাইয়ে, অনেক সময়ই সেটা কৌতুকেও পরিণত হয়। কিন্তু, শ্রীকান্তের ব্যাপারে কোনো হাসি তামাশা তাঁদের পছন্দ নয়।

একালে সিনেমার নায়ক বা ক্রিকেট তারকারা বাড়ি থেকে বের হবেন, কিন্তু সমর্থকরা তাঁকে ঘিরে দাঁড়াবে না – এই দৃশ্য কল্পনা করা কঠিন। মাদ্রাজে শ্রীকান্তের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা প্রযোজ্য।

শ্রীকান্ত ছিলেন শচীন টেন্ডুলকারের প্রথম অধিনায়ক। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তান সফরে যায় শ্রীকান্তের নেতৃত্বাধীন ভারত। সেই সিরিজেই প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক ময়দানে আসেন ১৬ বছর বয়সী শচীন!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...