`আমি ব্রাডম্যান, হার্ভে, হাটন, ডেনিস কম্পটন, কেইথ মিলার, উইকস, ওরেল, ওয়ালকটের বিপক্ষে বল করেছি । কিন্তু যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন কাকে বল করা সবচাইতে কঠিন ছিল, আমি এমন একটা নাম বলব যেটা আপনি জানেন না।’
কথাগুলো বলছিলেন গুলাম আহমেদ, ভারতের সাবেক অধিনায়ক আর সাদা পোশাকে সে দেশেরই ইতিহাস সেরা দুর্দান্ত স্পিনারদের একজন। তা কারো না জানা সেই ব্যাটসম্যানটি কে? তিনি মাহাদেভান সাথাসিভাম।
গুলাম আহমেদের মতে, চেন্নাইয়ে মহাদেবনের সেই আঘাত নাকি তিনি কোনদিনও ভুলবেন না। তা চেন্নাইয়ের কোন ম্যাচ? গল্পটা বলে ফেলা যাক!
- চিপকের সেই ম্যাচ
১৯৪৭ সালের কথা, মাসের হিসেবে ছিল ফেব্রুয়ারি। চিপকে মাঠে নেমেছিল সাউদার্ন ইন্ডিয়া আর সিলন ক্রিকেট অ্যাকাডেমি। প্রথমে ব্যাট করা সিলন সে ম্যাচে গড়ে প্রতি ওভারে ৩.৮৭ রান তুলে ৭ উইকেট হারিয়ে স্কোরবোর্ডে তুলেছিল ৫২১ রান। আর এই সিলনের দলটাতেই খেলতেন আজকে যাকে নিয়ে গল্প হচ্ছে, সেই মহাদেবন সাথাসিভম। সিলনের রানের পাহাড়ের ম্যাচে কিন্তু ব্যাক্তিগত রানেও একটা টিলা বানিয়ে ফেলেছিলেন সিভম, ২৪৮ মিনিট ক্রিজে থেকে করেছিলেন ২১৫ রান।
আর গুলাম আহমেদ? তিনি খেলতেন সাউদার্ন ইন্ডিয়ার হয়ে, ভারতের এই কিংবদন্তি স্পিনার সে ম্যাচে ৩৪ ওভার হাত ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন ১০৫ রান। আর উইকেট? সেটার ভাঁড়ে মা ভবানী!
- মাহাদেভান সাথাসিভাম
মাহাদেভান সাথাসিভাম, ক্রীড়ানুরাগীদের কাছে পরিচিত ‘সাথা’ নামেই। জন্ম ১৮ অক্টোবর, ১৯১৫ সালে। উপরের অংশটাতে যেখানকার হয়ে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন সেই সিলনেই! ব্যাটিংয়ে তিনি ছিলেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান, নিজের দিনে দুর্দান্ত খেললেও এই ‘দিন’ ব্যাপারটা খুব বেশিদূর টেনে নিয়ে যেতে পারেননি। ১৯৪৪-৪৫ থেকে ১৯৪৯-৫০ এই সময়েই মাত্র ১১ ম্যাচেই শেষ হয়ে গেছিল সাথাসিভমের প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার। এই ১১ ম্যাচের ছোট্ট ক্যারিয়ারেই তিনি ৩ সেঞ্চুরি আর ৩ হাফ-সেঞ্চুরিতে ৪১.৮৩ গড়ে করেছিলেন ৭৫৩ রান!
ছোট হতে পারে, কিন্তু সাথাসিভমের প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল বেশ দ্রুতই – বয়স যখন মাত্র পনেরো বছর। সেন্ট জোসেফ কলেজের পর ওয়েসলি কলেজ, ক্রিকেটের পথচলার হাতেখড়ি এখানেই। এখান থেকেই সেন্ট থমাস কলেজের বিপক্ষে ১৪২ রানের ইনিংস খেলে প্রথমবারের মত পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন সাথা!
- প্রথম শ্রেণির অভিষেক
সাথাসিভমের প্রথম শ্রেণিতে অভিষেক হওয়ার গল্পটা যেকোন রূপকথার গল্পকেও হার মানাবে। ‘বোম্বে পেনট্যাংগুলার টুর্নামেন্ট’ এর সেমি-ফাইনাল ম্যাচ, সময়কাল ১৯৪৪-৪৫। টুর্নামেন্টের সেমি ফাইনালের দুটি দল ছিল মুসলিমস আর ‘রেস্ট’। এই ‘রেস্ট’ দলটা শুধুমাত্র নামেই ছিল ‘রেস্ট’, আদতে এই দলটাতে বেশিরভাগ খেলত সে সময়কার খ্রিষ্টান খেলোয়াড়েরা। আর এই টুর্নামেন্টটিতেও ধর্মের ভিত্তিতে দল সাজানো হত, হিন্দু ধর্মেরও আলাদা একটা দল ছিল। খুব স্বাভাবিকভাবেই দলের নাম ছিল – হিন্দু!
যা হোক, সেমিফাইনাল ম্যাচে ফিরে আসা যাক। ‘রেস্ট’ দলটার নেতৃত্বে ছিলেন বিজয় হাজারে। অনুমিতভাবেই তিনি ছিলেন একজন খ্রিষ্টান। আর সে দলেই সে ম্যাচে অভিষেক হয় সাথাসিভমের। আপনি হয়তো ভাবছেন সাথাসিভম তাহলে হয়ত খ্রিষ্টান ছিলেন? আজ্ঞে না!
এই যে ‘রেস্ট’ দলটার কথা বললাম, এই দলটা তৈরির মূলকেন্দ্রে ছিল বোম্বের ক্যাথলিক জিমখানা। আর সে সময়ে হিন্দু নামে অনেক খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী লোকেরা বাস করত, যেমনটা খাটে বিজয় হাজারের বেলাতে। সিলনের সাথাসিভমকেও ক্যাথলিকেরা ঠিক এমনটাই ভেবেছিল। হিন্দু মাহাদেভান সাথাসিভামকে খ্রিষ্টান মনে করে অভিষেক করিয়ে দিয়েছিল প্রথম শ্রেণির ম্যাচে! তবে ক্যাথলিকেরা তাঁদের এই ভুল বুঝতেও পেরেছিল, তবে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে!
- ম্যাচের গল্প
টসে জিতে অধিনায়ক হাজারে নিয়েছিলেন ব্যাটিং, তবে স্কোরকার্ডে নিজের রান ৬৯ পেরোবার আগেই ফিরে যান প্যাভিলিয়নে। অধিনায়ক প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেও অভিষিক্ত সাথাসিভম ১৬৯ মিনিট ক্রিজে থেকে নিজের প্রথম ম্যাচেই করে ফেলেন সেঞ্চুরি- ১০১! সাত চারের মারে সেই ইনিংসে তিনি ঢুকে যান রেকর্ড বুকের সেই পাতাটাতে যেখানে প্রথম শ্রেণির অভিষেকেই সেঞ্চুরিয়নদের তালিকা আছে। সে যাক, ‘রেস্ট’ কে কাবু করতে মুসলিমরাও এদিকে ব্যবহার করেছিল একাদশের নয়জন বোলারকেই। তবে তাদের মধ্যে খাজা সাঈদ আহমেদ ছাড়া আর কেউ খুব বেশি সুবিধা করতে পারেননি। সাইদ সে ইনিংসে ৬০ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট! ‘রেস্ট’ এর স্কোর ছিল ৩৭৮।
জবাব দিতে নেমে মুসলিমরাও অবশ্য কম যায়নি, সাত উইকেট হারিয়ে ৩৭৮ রান করেই দলটা ইনিংস ডিকলেয়ার করে দিয়েছিল। মুসলিমদের হয়ে সেঞ্চুরি করেছিলেন গুল মোহাম্মদ আর ইবু গাজ্জালি। মুসলিমেরা ইনিংস ডিকলেয়ার করে দিলে আবারও ব্যাটিংয়ে নামে ‘রেস্ট’ তবে এবার মুদ্রার উল্টোপিঠ দেখে ফেলেন সাথাসিভম। অভিষিক্ত এই ব্যাটসম্যান দ্বিতীয় ইনিংসে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান শূন্য রানেই!
ভুল-চমক-হাসি-কান্নাতে মেশানো এক ম্যাচ দিয়ে এভাবেই প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার শুরু হয় মহাদেবন সাথাসিভমের!
- সিলন-যাত্রা
১৯৪৪-৪৫ এর দিকেই ভারতের বিপক্ষে সিলনের হয়ে কলম্বোতে খেলতে নামেন সাথাসিভম। ম্যাচের প্রথম দিন অবশ্য একটা বলও মাঠে গড়ায়নি, কিন্তু দ্বিতীয় দিনের শুরু থেকেই বিজয় মার্চেন্টের নেতৃত্বে থাকা ভারতীয় দলের বিপক্ষে সুবিধা করে উঠতে পারেনি সিলন। আর এরপর ভিনু মানকড়ের দুর্দান্ত বোলিং তোপে (৮-৩৫) মাত্র ১০৭ রানেই গুটিয়ে যায় স্বাগতিকেরা, যেখানে সাথাসিভমের অবদান ছিল মাত্র ১০!
তবে ব্যাটিংয়ে নেমে ভারতও রানের পসরা সাজাতে পারেনি, মাত্র ১৭৯ রানেই অল-আউট হয়ে যায়। ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ ৪৯ রান করেন মুশতাক আলী।
প্রথম ইনিংসে সুবিধা করতে না পারলেও দ্বিতীয় ইনিংসেই কিন্তু নিজের জাত চেনান সাথাসিভম। লালা অমরনাথ, ব্যানার্জি আর ভিনু মানকড়কে নিয়ে সাজানো ভারতীয় বোলিং লাইন আপের বিপক্ষে করেন ১১১। টানা দুই প্রথম শ্রেণির ম্যাচে এমন কীর্তি সাথাসিভামের জন্য বেশ আশার বাণীই শোনাচ্ছিল!
- সিলন যাত্রা ২.০
সাথাসিভমকে মনে করা হয় যে তিনটি বিশেষ ইনিংসের জন্য, সেই তিনের দুটি বলে ফেলা গেছে। আইকনিক তিন ইনিংসের তৃতীয়টাও এসেছিল সিলনের হয়ে। ১৯৫০ সালের সে ম্যাচটা ছিল লিভিংস্টোনের নেতৃত্বে গড়া কমনওয়েলথ একাদশের বিপক্ষে। তারকায় সাজানো কমনওয়েলথ একাদশ প্রথমে ব্যাট করতে নামলে স্কোরকার্ডে তোলে ৩৫৫ রানের বিশাল পাহাড়। চাইলে এ রান অবশ্য আরো বড় হতে পারত, কিন্তু ৫ উইকেটে ৩৫৫ তে থাকাকালীনই লিভিংস্টোন ইনিংস ঘোষণা করে দিলে সে সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়।
জবাব দিতে নেমে সিলনের আবারও তথৈবচ অবস্থা, মাত্র ১৫৩ রানেই পুরো ইনিংসের লেজ মুড়িয়ে যায় দলটির। তবে এই ১৫৩ রানের মাঝেই সিলনের হয়ে খেলতে নামা সাথাসিভম নজর কেড়ে ফেলেছেন, খেলেছেন ৯৬ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। এরপর ফলোঅনে পড়ে আবারও ব্যাট করতে নেমে সিলন দ্বিতীয় ইনিংসেও ১৫১ রানে অলআউট হয়ে গেলে ইনিংস ও ৫১ রানের ব্যাবধানে হার নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় সাথাসিভামকে। কিন্তু সিলনের লোকাল বয় ততক্ষণে সবারই আলাপের বিষয়। সে ম্যাচে থাকা ফ্রাংক ওরেলের মতে, তো আরেকবার বিশ্ব একাদশ গঠন করতে দিলে সেখানে নাকি সিলনের সাথাসিভম নিশ্চিত থাকবেন!
- শেষ
সিলনের হয়ে সাথাসিভম তাঁর শেষ ম্যাচ খেলেছিলেন ১৯৫০ সালেই, লাহোরে পাকিস্তানের বিপক্ষে। সে ম্যাচে অবশ্য তিনি খুব বেশি ভাল করতে পারেননি, প্যাভিলিয়নে ফিরে গেছিলেন মাত্র ছয় রানে। সাথাসিভমের ম্যাচটাও সে ম্যাচটা হারে বড় ব্যাবধানেই। সেসব আলাপের বিষয় নয়। আলাপের বিষয় হল সাথাসিভাম।
সাথাসিভম চারিত্রিকভাবে কেমন ছিলেন সেটাতে খানিকটা ধোঁয়াশা আছে। তবে ধোঁয়াশার মাঝের আলোক হিসেবে যেটুকু জানা যায়, তিনি ছিলেন খেয়ালি প্রবৃত্তির মানুষ। পার্টি, নাচ, গান এসবই নাকি খুব বেশি পছন্দ করতেন সাথাসিভম। কিছু কিছু খেলোয়াড়ের মতে, তিনি এতটাই আয়েশি ছিলেন যে বল বাউন্ডারির দিকে গেলে তিনি নাকি তা ধরতে দৌড়ানোর প্রয়োজন অবধি বোধ করতেন না।
নিজের এই খেয়ালি বশের জন্যই হোক, অথবা অজানা যে কারণেই হোক নিজের স্ত্রী আনন্দন সাথাসিভমের সাথে সম্পর্কটা একদমই ভাল ছিল না মহাদেবন সাথাসিভমের। তাদের দুজনের সম্পর্কের তিক্ততা এতটাই বিষাক্ত ছিল যে মহাদেবনের স্ত্রী তাঁর উদ্দেশ্যে ডিভোর্স ও ফাইল করেছিলেন। তবে এটুকু অব্দি ঠিক ছিল, বিপত্তি বাধল যখন আনন্দন সাথাসিভম খুন হয়ে গেলেন আর এই খুনের দায়ে অভিযুক্ত করা হল মাহাদেভান সাথাসিভামকে।
এই একটা ঘটনাই সাথাসিভমের জীবনকে তোলপাড় করে দিল। রিমান্ডে নেওয়ার পর সাথাসিভামকে জুডিশিয়াল কাস্টডিতে পাঠানো হল ৬২৫ দিনের জন্য। তবে সেখানে অবশ্য সাথাসিভামকে ৫৭ দিনের বেশি থাকতে হয়নি, অচিরেই তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে ছাড়া পেয়ে যান।
সাথাসিভম তাঁর দোষ থেকে তো নিষ্কৃতি পেয়ে গেলেন, কিন্তু এই ঘটনার খারাপ পাবলিসিটি তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে ধ্বংস করে দিল। সিলনে তিনি আর থাকতে পারলেন না।
তল্পিতল্পা গুটিয়ে বহু স্মৃতির জায়গা ছেড়ে গেলেন। নাহ, ক্রিকেট তিনি ছাড়েননি। পরে তিনি মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরেও ক্রিকেট খেলেন। আর সেসব দেশের অধিনায়কত্বও করেছেন নিজ যোগ্যতায়। ইতিহাস বলে তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার যিনি একই সাথে ভিন্ন তিনটি দেশকে ক্রিকেট মাঠে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
১৯৭৭ এর ৯ জুলাই হার্ট অ্যাটাকে তিনি ছেড়ে গেলেন গোটা দুনিয়াটাই, তবে তাঁর স্মৃতি আজও লঙ্কার বাতাসে উড়ে!