সিনিয়র ক্রিকেটারদের ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব, দলগত পারফরম্যান্সের অধারাবাহিকতা- সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট কখনোই যেন নির্ঝঞ্ঝাটে সময় পার করতে পারে না। তবে এত সব আলোচনা, বিতর্ক, অস্বস্তির মাঝেও নিজের কাজটা নীরবে করে যান মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। বাউন্ডারির ওপারের আলোচনা যেন কখনোই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। আর তাই তো বাংলাদেশ ক্রিকেটে তাঁর নামের পাশে ‘সাইল্যান্ট কিলার’ তকমাটাই সঠিক সার্থকতা প্রমাণ করে।
তাঁর ফর্ম নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা কম আলোচনা হয়নি। দল থেকে বাদ পড়েছেন। দলের অন্যতম সিনিয়র ক্রিকেটার হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের ঐতিহাসিক শততম টেস্টে তাঁর ঠাই মেলেনি। এই গত বছরের ওয়ানডে বিশ্বকাপেই স্কোয়াডে তাঁর জায়গা পাওয়া নিয়ে না কত অনিশ্চয়তার জাল ছড়িয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ রিয়াদেই আস্থা খুঁজে পায় বাংলাদেশ।
এরপরের গল্পটা তো সবার জানা। ২০২৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভরাডুবির মাঝেও আলো ছড়িয়েছিলেন রিয়াদ। বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে লড়াই করা অভিজ্ঞ এ ক্রিকেটারই হন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ব্যাটার। দলের হয়ে সে আসরের একমাত্র সেঞ্চুরিও আসে রিয়াদের কল্যাণে। বিশ্বকাপের কথাই যখন আসলো, তখন রিয়াদের বিশালতা টের পাওয়া যায় আরেকটি জায়গায়।
ক্যারিয়ারে মোট ৪ টি বিশ্বকাপ খেলেছেন। আর ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মঞ্চে ২২ ইনিংসে ৩ সেঞ্চুরি আর ৩ ফিফটিতে ৫২.৪৪ গড়ে ৯৪৪ রান করেছেন এ ব্যাটার। যা সাকিব, মুশফিকের পর তৃতীয় সর্বোচ। আর সেঞ্চুরির দিক দিয়ে বাংলাদেশি ব্যাটার হিসেবে শীর্ষ আসনটা তাঁর। এ ছাড়া ২০১৫ ও ২০২৩, বিশ্বকাপের এ দুই আসরে দলের হয়ে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড তাঁর। বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে যে কীর্তি রয়েছে শুধু রিয়াদেরই।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত ১০৩৮৪ রান নামের পাশে রয়েছে রিয়াদের। বোলিংয়ে শেষ কয়েক বছরে অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন যদিও। তবে বল হাতে ১৬৩ টি উইকেট শিকার করেছেন তিনি। আর ফিল্ডিংয়ে ক্যাচ নিয়েছেন ১৬৫ টি। সংখ্যাগুলো নিশ্চয়ই বড় নয়। তবে সম্মিলিত সংখ্যায় তিনি আবার ছাপিয়ে যান সবাইকে। রিয়াদের অভিষেকের পর থেকে এখন পর্যন্ত যতজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, এ সময়কালে তাঁর চেয়ে ‘রান, উইকেট এবং ফিল্ডার হিসেবে ক্যাচ’ তিন ক্ষেত্রেই বেশি অবদান নেই একজন ক্রিকেটারেরও। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এখানেই অনন্য।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে তারকাখ্যাতি পেয়েছেন অনেকেই। তবে সিংহভাগ তারকার বিলুপ্তও ঘটে গিয়েছে এ সময়কালে। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে রিয়াদ এসেছিলেন নির্ভরতার প্রতীক হয়ে। এমনকি বয়স ৩৮ পেরিয়ে গেলেও, সেই রিয়াদ এখনও বাংলাদেশের ক্রাইসিস ম্যানই থেকে গিয়েছেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে জায়গা হারিয়েছেন বছর দুয়েক আগে। খেলতে পারেননি শেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই।
অথচ সেই রিয়াদই যেন ক্যারিয়ার সায়াহ্নে এসেও ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের অটোমেটিক চয়েস হতে চলেছেন। অবশ্য এমনটা তো হয়েছে বাকি দুই ফরম্যাটেও। গত বছরে এশিয়া কাপ সহ গুরুত্বপূর্ণ সিরিজে দলের বাইরে ছিলেন। দীর্ঘ বিরতির পর আবার যখন ফিরলেন, তখন শঙ্কা বেঁধেছিল, রিয়াদ প্রত্যাশা ছুঁতে পারবেন তো বিশ্বমঞ্চে? রিয়াদ সেবার শুধু প্রত্যাশাই স্পর্শ করেননি, সবার ভাবনাকে ছাপিয়ে হয়ে উঠেছিলেন দলের সেরা পারফর্মার।
টেস্ট ফরম্যাটের কথাই টেনে আনা যাক। ২০১৭ সালে গল টেস্টে ব্যাটিং ব্যর্থতার কারণে তাঁকে পরের টেস্টে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। পরের টেস্ট আবার ছিল বাংলাদেশের ১০০তম টেস্ট। এমন ঐতিহাসিক মুহূর্তের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন রিয়াদ। তবুও নীরবে সেটা মেনে নিয়ে তিনি চোখ রেখেছিলেন সামনের পথে।
এরপর বাংলাদেশের হয়ে যখন টেস্টে ফিরলেন, তখন প্রত্যাবর্তনটাই রাঙালেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৬৬ রানের ইনিংস খেলে। এরপর ২০১৮ সালে ঘরের মাটিতে ৪ টেস্টের ব্যবধানে ৩ বার সেঞ্চুরি পূরণ করলেন তিনি। রিয়াদ এরপর আরও একবার দল থেকে বাদ পড়েছিলেন। কিন্তু প্রায় দেড় বছর বাদে ফেরার মঞ্চটা রাঙিয়েছিলেন ১৫০ রানের ইনিংসে।
তবে বারবার বাদ পড়াই হয়তো কিছুটা অভিমানীই হয়ে পড়েছিলেন রিয়াদ। ১৫০ রানের ওই ইনিংস খেলার পর আচমকা অবসরের ঘোষণা দিয়ে দেন তিনি। সে সময় টেস্ট চলাকালীন অবসরের ঘটনায় তাঁকে সমালোচনার শিকার হতে হয়েছিল অনেক। তবে রিয়াদ যেন বরাবরই আলোচনা, সমালোচনার উত্তর দিতে নির্লিপ্ত। তাঁর জবাবটা যেন শুধুই মাঠের ক্রিকেটে ব্যাট হাতে। রিয়াদ ক্যারিয়ার জুড়ে যে সেটাই দিয়ে এসেছেন।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে সিনিয়র ক্রিকেটার তিনি। বয়স ৩৯-এ পা দিয়েছে। ক্যারিয়ার সায়াহ্নে আছেন নিশ্চিতভাবেই। অনেকে হয়তো তাঁর শেষও ভেবে ফেলেছেন। কিন্তু ক্যারিয়ার জুড়ে লড়াই করার মানসিকতাই তাঁকে অন্য একটা পর্যায়ে ঠাই দিয়েছে।
লড়াই করে দলে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছেন। আর সেই সংগ্রামের পথে তিনি ছাপিয়ে যান উঠতি ক্রিকেটারদের পারফর্ম্যান্সকেও। তাই তো, বাংলাদেশ ক্রিকেটে এখনও আস্থার প্রতীক হয়ে আছেন রিয়াদ। সাইল্যান্ট কিলারের তকমাটাও যেন এখন তাঁর নামের পাশে ধ্রুব হওয়ার পথে।