ওরা চায় না, রবসন

১৪ বছরের মার্তা, দারিদ্রের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করা মার্থা, সামাজিক বৈষম্যের শিকার মার্থা রিওর বাসে উঠতে দু’বার ভাবেননি। সাড়ে তিন দিনের বাস জার্নির শেষে যখন তিনি নামলেন তখন দু’চোখ ভরা স্বপ্ন, সঙ্গে বুক ভরা প্রত্যয়। হেলেনা তাঁকে নিয়ে গেলেন ১৯৯৬-এর ব্রাজিলের বিশ্বকাপের গোলরক্ষক মেগের কাছে। সব দেখেশুনে, ট্রায়ালে নামার অনুমতি দিলেন মেগ।

সব কিছু কি এক জীবনে পাওয়া হয়ে ওঠে পাঠক। মাথার উপর যখন খোলা আকাশ তখন ওড়ার সাধন নেই। যখন ডানা পাওয়া গেল তখন উঁচু কংক্রিটে আকাশ গেছে ঢেকে। ডয়েস রিয়াওসের মার্থার কথাই ধরুন। ছেলেদের কাটিয়ে গোল করতে ভালোবাসে সে, মূলত বাঁ পায়ে ড্রিবল, কিন্তু দু পায়েই সমান জোর। কিন্তু ভালবাসলেই বা কী? ছেলে তো নয় সে! তাই লুকিয়ে চুরিয়ে খেলতে হয়।

দাদারা মারত, পাড়ার ছেলেরা হেরে গিয়ে দুয়ো দিত তবু খেলা থামেনি মার্তার। শেষে ১৪ বছর বয়সে যেন শিকে ছিঁড়ল।

রিওর ভাস্কো দ্য গামা ক্লাব বেশ পুরনো। তারা মেয়েদের ফুটবল টিম বানাবে। দায়িত্ব দিয়েছে ব্রাজিলের পরিচিত নারী কোচ হেলেনা পাচেকোকে। হেলেনা সুদূর রিও দি জেনেরো থেকে পূব প্রান্তের ডয়েস রিয়াওসে এসে মার্থাকে স্বচক্ষে দেখলেন। তারপর প্রস্তাব দিলেন, রিওতে আসার।

১৪ বছরের মার্তা, দারিদ্রের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করা মার্তা, সামাজিক বৈষম্যের শিকার মার্তা রিওর বাসে উঠতে দু’বার ভাবেননি। সাড়ে তিন দিনের বাস জার্নির শেষে যখন তিনি নামলেন তখন দু’চোখ ভরা স্বপ্ন, সঙ্গে বুক ভরা প্রত্যয়। হেলেনা তাঁকে নিয়ে গেলেন ১৯৯৬-এর ব্রাজিলের বিশ্বকাপার গোলরক্ষক মেগের কাছে। সব দেখেশুনে, ট্রায়ালে নামার অনুমতি দিলেন মেগ।

ডয়েস রিয়াওসের এক নাম না জানা, দূর ছাই খাওয়া মেয়ে এক ট্রায়ালেই নিজের বিজয়গাথা লিখতে বসল। মার্থা মার্থার মতোই খেলতে শুরু করলেন। অর্থাৎ মেয়েদের পেলে। বাঁ-পাটা দারুণ চলে, ঐটুকু ছোট্ট কিন্তু কষভর্তি চেহারায় ডানপাটা তো একেবারেই অকেজো নয়। আর শরীরের দোলায় যেন ছিটকে বেরোয় বিদ্যুৎ। আপন খেয়ালে মার্তা ড্রিবল করে গোলের রাস্তা খুলে ফেলেন। রাস্তা খুলে ফেলেন দেশের হয়ে খেলারও। দু’বছর ভাস্কো আর দু’বছর বেলো হরাইজন্তের সান্তাক্রুজে নিজেকে আরও ক্ষুরধার করে তোলার পর মার্থা চললেন সুইডেনের উম্যেয়া আইকের হয়ে খেলতে। উম্যেয়া তার আগের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছে।

২০০৪-এ মার্থার জন্য আবার পেল তারা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। ফ্র্যাঙ্কফুট এফসিকে হারিয়ে। ফাইনালে মার্তার ৩ গোল। ওই একবারই, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ আর জেতা হল না তাঁর। ২০০৮-এ যখন উম্যেয়া ছাড়ছেন তখন দুবার আরও রানার্স হয়েছেন।

কিন্তু মার্তা তো শুধুমাত্র চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলবেন বলে জন্মাননি! ২০০৮এর বিশ্বকাপ ফাইনালে পেনাল্টি মিস করলেন বটে, ব্রাজিলও হারল জার্মানির কাছে। কিন্তু অমরত্বের ঠিকানা লেখা হয়ে গেছে ইউএসের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে। বলটা রিসিভ করেছিলেন পেনাল্টি বক্সের ডান কোণের বাইরে। ডানপায়ে, কিন্তু বাঁ-পায়ের একটা ফ্লিকে বলটা বাঁ-দিকে ঠেলে ডান দিক দিয়ে ডিফেন্ডারকে টপকে গেলেন, তারপর আরও দুই ডিফেন্ডারকে ড্রিবল করে আগুয়ান লেফট ব্যাক ও গোলরক্ষকের নাগাল এড়িয়ে ডান পায়ে ঠেলে দিলেন প্রথম পোস্টের কোণে।

সুইডিশ টিভিতে তদ্দিনে একটা তথ্যচিত্র হয়ে গেছে, ‘মার্তা- পেলে’স কুসিন’ (পেলের কাজিন) বলে। শুরু হয়ে গেছে ফিফা ওয়র্ল্ড ফুটবলার অব দ্য ইয়ার হবার ধারাবাহিক সিলসিলা। পরপর পাঁচবার। ২০০৬ থেকে ২০১০। পরেও একবার পেলেন। তখন পুরস্কারের নাম পাল্টে বেস্ট ফিফা হয়ে গেছে। ২০১৮য় বত্রিশ বছরের মার্থা আবার পেলেন সেরার পুরস্কার।

মার্তা সুইডেন ছেড়ে গেছিলেন লস এঞ্জেলসে, ডব্লিউপিএস খেলার জন্য উইমেন’স প্রফেশনাল সকার লিগ। ইউএসে। সাফল্যের সঙ্গে বছর দুই তিন খেলার পর আবার ফিরে আসেন সুইডেনের ক্লাব ফুটবলে, ডামেল্ভেন্সকান খেলতে। সেখানেও সাফল্য। পরে ফিরেও যান অর্লান্ডো প্রাইডের হয়ে বছর তিনেক খেলতে।

দেওয়াল ভরা মেডেল, দেরাজ ভরা পুরস্কারের পরেও ছ’বারের বিশ্বের সেরা মহিলা ফুটবলার হওয়ার পরেও মার্থার বিশ্বকাপ ট্রফি নেই, সে তো লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানও রোনালদো, জর্জ বেস্ট, রবার্তো বাজ্জিও, পাওলো মালদিনিদেরও নেই, নেই জোহান ক্রুয়েফ, ফেরেঙ্ক পুস্কাস, আলফ্রেডো ডি স্টেফানো, জিকো, মিশেল প্লাতিনিদেরও। তাতে কী?

পাঁচটা বিশ্বকাপ খেলে ১৭টা গোল তো কারুর নেই, না ছেলেদের না মেয়েদের। ২০০৭এ রানার্স হবার স্বপ্নভঙ্গ তো বারবার হয়েছে। ব্রাজিল ফুটবল পাগল দেশ, কিন্তু সে তো ছেলেদের জন্য। ছেলেরা খেলবে, মেয়েরা বিশ্বসুন্দরী হবে অথবা সুপার মডেল। এভাবেই দেখে এসেছে ব্রাজিল মেয়েদের।

ভোগ্যপণ্য, সেখানে মার্তা, ক্রিশ্চিয়ানে, সিসি, ফরমিগার মতো মেয়েরা, যাঁরা ট্র্যাডিশনালি সুন্দরী নন, কিন্তু ফুটবলের মতো মনমাতানো এক খেলায় সৌন্দর্যের ধ্বজাধারী, তাদের জন্য একটা জাতীয় লিগ নেই। একটা মারিয়া বুয়েনো (টেনিস), একটা মায়া গ্যাবেইরা (সার্ফিং), একটা পামেলা রোহা (স্কেটবোর্ড) আর সফল ভলিবলারদের দিয়ে কিছু হয় না। ব্রাজিলের ফুটবলে লিঙ্গবৈষম্য ভয়ানক। মেয়ে ফুটবলারদের সেখানে ‘লেসবিকাস’ (সমলৈঙ্গিক) বলে ডাকা হয়।

কেটলিন ফিশারের কথায়, ‘মেয়েরা যাতে ফুটবল না খেলে, তার জন্য রীতিমত চাপ দেওয়া হয় ব্রাজিলীয় সমাজে।’

কেটলিন ফিশার হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট এবং প্রাক্তন পেশাদার ফুটবলার। অদ্ভুত গল্প জানান তিনি, ২০১২য় ব্রাজিলের যে দলের হয়ে তিনি খেলতেন সেই স্যান্টোস মেয়েদের ফুটবল দল বন্ধ করে দেয়, কারণ তদানীন্তন বিস্ময় বালক নেইমারকে দলে ধরে রাখতে হবে আরও বেশি টাকার বিনিময়ে, ২০১৪ এমনিতেই স্যান্টোস ছেড়ে নেইমার বার্সায় চলে যান, কিন্তু স্যান্টোসের মেয়েদের দল আর ফিরে আসেনি।

এই আবহে দাঁড়িয়ে মার্থার বিশ্বকাপ না থাকলেও ছ’ছটা বিশ্বের সেরা নারী ফুটবলার। পাঁচটা বিশ্বকাপ, সতেরোটা গোলের পরেও পাঁচবার স্বপ্নভঙ্গ। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ইউএস, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপানরা ব্রাজিলের থেকে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। ঠিক যেভাবে ছেলেদের ক্ষেত্রেও এক মরা সময়ে নেইমার খেলতে এসেছে, সেভাবেই। কিন্তু ব্রাজিল মেয়েদের ফুটবলে কখনই বিশ্বসেরা ছিল না। মার্তা ছিলেন। তাই ২০১৯এ অতিরিক্ত সময়ে ফ্রান্সের কাছে হারার পরে এক আবেগঘন বক্তব্যে মার্তা শেষ করলেন তাঁর বিশ্বকাপ যাত্রা, ১৭ বছরের জাতীয় দলের হয়ে ১০৮টা গোল করে ফেলেছেন তিনি।

যাবার আগে বলে গেলেন তাঁর নবীন সতীর্থদের, ‘আরও বেশি করে চাইতে হবে সাফল্যকে, আরও বেশি করে খেলতে হবে, আরও বেশি করে নিজের যত্ন নিতে হবে। ৯০ + ৩০ মিনিট একই গতিতে খেলতে হবে, শুধু এটুকুই চাওয়ার। ব্রাজিলের ফুটবল তোমাদের উপর নির্ভর করছে। একটা মার্থা থাকবে না, একটা ফরমিগা থাকবে না। তবু ভরসা থাকবে। তাই ভালো করে মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে নিও, আরও আরও বেশি করে ব্রাজিলের হয়ে খেলাকে গুরুত্ব দাও। কষ্ট কর, শুরুতে কান্না আসুক, তবেই তো শেষ হাসি হাসতে পারবে বিজয়ের হাসি!’

মার্থা ভিয়েরা দ্য সিলভা, এখনও বোধহয় প্রচণ্ড গতিতে একের পর এক ডিফেন্ডারদের কাটিয়ে, বাঁ-পায়ের টোকায় বিপক্ষের  খেলোয়াড়দের মাটি নিতে বাধ্য করিয়ে গোলের কোণের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে পাঠান সাদা কালো ষড়ভুজ বুনে গঠিত গোলাকৃতি বলটাকে।

যদিও ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলবেন না ধরেই নিয়েছেন তিনি। তবুও মনের কোণে কোথাও যেন একটা আশার রেশ থেকে যায়। তাঁর সতীর্থ ফরমিগা কী করে ৪১ বছর বয়সেও খেলে ফেললেন সেই প্রশ্ন করায়, তাহলে ২০২৩ এর ব্রাজিলে যখন বিশ্বকাপ হবে তখন কি ক্যানারি জার্সিতে আবার দেখা যাবে ফিনিক্স মার্তাকে, শেষ বারের জন্য অন্ততঃ একবার ঐ দলগত শ্রেষ্ঠ হওয়ার পুরস্কার হাতে নেওয়ার জন্য?

২০১৯-এ তেত্রিশ বছর বয়সে বিশ্বকাপ খেলার ঠিক আগেই যখন অর্লান্ডো প্রাইডের হয়ে একটা খেলায় একটা ৫০-৫০ বলের জন্য ঝাঁপান, সামান্য চোট পান, কিন্তু সামলে নেন। খেলার শেষে সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, সামনেই বিশ্বকাপ, ওই ৫০-৫০ বলটার জন্য না ঝাঁপালেই হত না? মার্থা বলেন, কোনও কিছু ১০০%-এর নিচে করা মার্তার ধাতে নেই, তারপর বাকিটা ভাগ্যের হাতে!

ফুটবল দেবতা বোধহয় যা পরীক্ষা নেবার নিয়ে নিয়েছেন। আর তো মাঝে তিনটে বছর সুপার ফিট মার্থা তদ্দিন চালিয়ে যাবেন, আর ব্রাজিলের বাকিরা? দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলারটির জন্য একবার প্রাণপাত পরিশ্রম করতে পারবেন না? শচীনের হাতে বিশ্বকাপ দেওয়ার জন্য যুবরাজও তো অসুস্থতা নিয়ে খেলে দেন।

মার্তার জন্য একটা যুবরাণী খুঁজতে হবে! তদ্দিন কাঁটার মুকুট নিয়েই রাজত্ব সামলান তিনি। আমাদের প্রার্থনা তাইই, নারীদের সর্বকালের সেরা ফুটবলারের জন্য। ছেলেদের খেলা ধরলেও তো রেকর্ডে পেলে রোনালদো কবেই ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। মার্থা ভিয়েরা দ্য সিলভা, ফুটবল পাগল দেশের সমস্ত বঞ্চনার জবাব দেবার জন্য আরেকবার যেন মাঠে নামেন। এই আশাতেই।

কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...