‘মাশরাফি’ – নামটাই একটা বিস্ময়!

পরিসংখ্যানের মানদন্ডে তিনি একজন গড়পড়তা ক্রিকেটার। ২২০ টা ওয়ানডে ম্যাচে ২৭০ টা উইকেট। এই যা। টেস্ট আর টি-টোয়েন্টিতে বলার মতো কিছু নেই। কিন্তু তারপরেও কোথায় গিয়ে যেন তাঁকে সেরা বলতেই হয়। গড়পড়তা এক বোলারকে সেরার স্বীকৃতি? 

পরিসংখ্যানের মানদণ্ডে তিনি একজন গড়পড়তা বোলার। ২২০ টা ওয়ানডে ম্যাচে ২৭০ টা উইকেট। এই যা। টেস্ট আর টি-টোয়েন্টিতে বলার মতো কিছু নেই। কিন্তু তারপরেও কোথায় গিয়ে যেন তাঁকে সেরা বলতেই হয়। গড়পড়তা এক বোলারকে সেরার স্বীকৃতি?

না। আক্ষরিক অর্থে সেরার স্বীকৃতি নয়। শোয়েব আখতার তাঁর ওয়ানডে ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ২৪৭ টা উইকেট পেয়েছেন। কিন্তু তাঁকে কি ক্রিকেট ঐ ক্যারিয়ার দিয়ে বিবেচনা করে? তো, উপরের পরিসংখ্যান যার নামের পাশে, সেই মাশরাফির ক্ষেত্রেও পরিসংখ্যানের ঊর্ধ্বে কিছু একটা আছে।

বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে দারুণ একটা অধ্যায়ের সহযোদ্ধা তিনি। অধিনায়ক হিসেবে যার নামের পাশে বিজয়ের অনুপাত বেশি তাকেই তো সফল বলা হয়। মাশরাফি তাই সফল একজন অধিনায়ক। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সফলতা টেনে এনেছেন ঘরোয়া ক্রিকেটেও। অধিনায়ক হিসেবে চার চারবার বিপিএল শিরোপা জিতেছেন। যা আর কেউ পারেননি। মাশরাফি পেরেছেন।

তাই ঐ পরিসংখ্যানের আলোতেই অধিনায়ক মাশরাফি নিশ্চিতভাবেই সমুজ্জল। যেমনটি করে বোলার মাশরাফিকে ‘গড়পড়তা’ রায় প্রথমেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্নটা হচ্ছে, মাশরাফির অধিনায়কত্বে বিশেষত্ব কিইবা থাকে যার কারণে তিনি এত সফল হন। ট্যাক্টিক্যালি মাশরাফি আসলেই দুর্দান্ত একজন অধিনায়ক? বিতর্কের খোরাক যোগাতে পারে এই ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্ন। একটা মতাভেদও তৈরি হতে পারে। সে সব কিছুতে আপাতত না যাওয়া যাক।

কিন্তু অধিনায়ক মাশরাফির আলাদা একটা রসদ রয়েছে। তিনি রিকি পন্টিং, ধোনিদের মতো ভাবনায় হয়তো ঢের পিছিয়ে। কিন্তু তাঁর নিজস্ব একটা ধরন আছে। সেই ধরনটা বলতে মাশরাফি একাই তৈরি করেছেন। কী সেই ভিন্নধর্মী রসদ?

তেমন কিছু না। যখনই মাঠে আর্মব্যান্ড পরে নেমেছেন নিজেকে একদম নিংড়ে দিয়েছেন। জানেন, শত সীমাবদ্ধতায় জর্জরিত। কিন্তু সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে দল নিয়ে চিন্তা করেছেন। আর তাতেই মিলেছে সফলতা।

এখন অধিনায়কত্বের মানদন্ড আসলে কেমন? অধিনায়কে সিদ্ধান্ত ফলপ্রসু হওয়ার অনুপাতটাই তো তাঁর সফলতা, ব্যর্থতা নির্ধারণ করে। এর বাইরে সূক্ষ্ম চোখে বিশ্লেষকরা দেখে বিশ্লেষণ করতে পারেন। কিন্তু সেটারও আবার মতভেদ রয়েছে। তাই দিনশেষে একজন অধিনায়কের সফলতার হারই তাঁকে নির্ণয় করে।

একবার সৌরভ গাঙ্গুলি বলেছিলেন,’শচীন তাঁর অধিনায়কত্বের সময় নিবেদিত প্রাণ ছিল। মাঠেও বেশ তৎপর থাকত। কিন্তু আসলে সাফল্যটাই শুধু আসেনি।’আর এ কারণেই দিনশেষে সর্বকালের সেরা ব্যাটারকে থাকতে হয়েছে ব্যর্থ অধিনায়কদের কাতারেই।

মাশরাফি এ ক্ষেত্রে বেশ সফল। তবে অধিনায়ক মাশরাফিকে নির্ণয় করা এ লেখার মূল বিষয় না। মূলত তাঁর নেতৃত্বের মিশেলে থাকা এক্সপেরিমেন্টাল সিদ্ধান্তই এ লেখার উপজীব্য বিষয়।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের বিপক্ষে সিলেট স্ট্রাইকার্সের কোয়ালিফায়ার ম্যাচের খেলা। জিতলেই ফাইনাল, এমন সমীকরণে শুরুতেই উইকেট হারিয়ে ব্যাকফুটে চলে যায় সিলেট। ১৬ রানেই নেই তিন উইকেট। এমন সময় সবাইকে চমকে দিয়ে উইকেটে আসলেন মাশরাফি।

মাশরাফি টুকটাক ব্যাটিং করেন। স্পিনারদের বিপক্ষে চড়াও হতে পারেন সহজেই। কিন্তু ব্যাটিং বিপর্যয়ে তাঁর উইকেটে আসার কারণ কি? খুবই সাধারণ বিষয়। দলের জন্য নিজে ঝুঁকি নিয়েছেন। পাওয়ার হিটিংয়ে কোনোভাবে রানের গতিটা যদি এগিয়ে দেওয়া যায়। মাশরাফি এমনটা ভেবেই মাঠে নেমেছিলেন।

যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। শুরু থেকেই চালিয়ে খেললেন। ২ চার আর ২ ছক্কায় খেললেন ২৬ রানের ইনিংস। বড় কোনো ইনিংস নয়। তবে ১৬ রানে ৩ উইকেট থেকে সিলেট পৌছে যায় ৯ ওভারে ৭২ রান। নাজমুল হোসেন শান্ত’র সাথে তাঁর ৫৬ রানের জুটিই সিলেটকে একটা গতি এনে দেয়।

মাশরাফি এখানেই তাই অনন্য। জানেন, সীমাবদ্ধতা, প্রতিকূলতা আছে। কিন্তু বাইশ গজের ক্রিকেটে যেন নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে ভাবেন এবং মাঠের সেটার প্রতিফলনও দেখান। এমন চিত্র কিন্তু এটিই প্রথম নয়। ২০১৭ সালে ফিরে যাওয়া যাক।

সেবার ইংল্যান্ডের সাথে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের খেলা চলছে। প্রথম ম্যাচ হেরে যাওয়ার দ্বিতীয় ম্যাচ জেতাই লাগতো বাংলাদেশকে। কিন্তু সেই পথে আবারো ধাক্কা। ব্যাটিং ব্যর্থতায় দলের রান ২০০ ও হচ্ছিল না। এমন সময়ে ত্রাতা হয়ে আসেন মাশরাফি।

দলকে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। বাংলাদেশের রান দুইশো পার হলো। মাশরাফি ৪৪ রান করে রইলেন অপরাজিত। কিন্তু ইংল্যান্ডকে আঁটকে দেওয়ার জন্য ২৩৮ রান তো আর যথেষ্ট নয়। দায়িত্বটা তাই এবার নিলেন বল হাতে। একে একে তুলে নিলেন জেসন রয়, বেন স্টোকসদের উইকেট। মাশরাফির ৪ উইকেটে বাংলাদেশ সেদিন ম্যাচ জিতলো ৩৪ রানে।

মাশরাফির নামে বরাবরই বিশেষ একটা বদনাম, অধিনায়ক বলে তিনি দলে টিকে থাকেন। কিন্তু ইতিহাস বলে বাংলাদেশের অধিনায়ক হওয়ার পর নিজের খেলা শেষ ম্যাচ পর্যন্ত সাকিবের পর সবচেয়ে বেশি উইকেট তিনিই নিয়েছেন। আর এবারের বিপিএলে যিনি খুড়িয়ে খেলছেন সেই তিনি একটা সময় পর্যন্ত শীর্ষ উইকেট শিকারী ছিলেন।

দিনশেষে, মাশরাফির এই সংখ্যাগুলো চোখের আড়ালে চলে যায়। সেটা হয়তো গণমানুষের আলোচনায় মাশরাফি নাম আসতেই ‘আবেগ’ শব্দ প্রথম উচ্চারিত হওয়ার কারণে।

কিন্তু মাশরাফি নিজে থেকে একটা সংজ্ঞা তৈরি করেছেন। তাতে তিনি জোর করে সেরা বলতে বাধ্য করছেন না। কিন্তু প্রতিনিয়ত নিবেদন, নিংড়ে দেওয়ার মুহূর্তে তিনি বাধ্য করছেন আমাদের আলাদাভাবে ভাবতে। সেই ভাবনায়, মাশরাফি সত্যিকার অর্থেই একজন নায়ক, নায়কের চেয়েও একজন যোদ্ধা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...