১.
ফুটবলে দুটো কাজ আমি ব্যক্তিগত ভাবে সবসময় অপছন্দ করি। একটা হচ্ছে রেফারির দোষ ধরা, আরেকটা হচ্ছে কোচের সমালোচনা করা।
প্রথমটার সম্পর্কে আমার বক্তব্য হচ্ছে রেফারিরাও মানুষ। তাদের ভুল হতেই পারে। কিন্তু নিজের দল হারলেই কারণে অকারণে রেফারির দোষ ধরাটাকে কেমন যেন অযুহাত খোঁজার মতো মনে হয়। এবং এই অযুহাতটা সাধারণত হেরে যাওয়া দলই খুঁজে থাকে, যেখানে দেখা যাবে তার নিজের দলই হয়তো কয়েক ম্যাচ আগে রেফারির কারণেই আরেক ম্যাচ জিতে এসেছে। আপনি যদি আসলেই রেফারির বিষয় নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকেন তাহলে নিজের দল যখন সুবিধা পাবে তখনও বলা উচিত।
আমাদের দেশে ‘রিয়াল-বার্সা’ দুই দলেরই এই ধরণের সমর্থক আছেন। এই দুই দলের ম্যাচে যদি সামান্যতম রেফারির ভুলও থাকে তাহলেও পরের দিন নিউজফিড ভরে যায় রেফারির ভুলের কেচ্ছা কাহিনী নিয়ে। মজার ব্যাপার হচ্ছে দুই দলের সমর্থকের কাছেই অতীতের আরো ইতিহাস থাকে যেখানে ২০ বছর আগেও যে রেফারিরা ভুল ( বিপক্ষ বাদীদের মতে চুরি) করেছে তার ছবি সহ ডিটেইলস আছে।
অথচ খুব অল্প কিছু বিষয় বাদে বেশিরভাগ রেফারি সংক্রান্ত বিষয়টাকে আমার কাছে ভুল করাই মনে হয়। মাঠে একটা রেফারিকেই সবচেয়ে বেশী দৌড়াতে হয়। এর মাঝে পেনাল্টি কিংবা অফ সাইড সংক্রান্ত বিষয়গুলো এত নিখুঁতভাবে ধরা মোটেও সম্ভব নয়। তবুও তারা যেগুলো ধরে সেগুলো দেখেই আমি বিস্মিত হই।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে কোচের ভুল ধরা । ফেসবুক দেখলে মনে হয় আমাদের দেশে এত ফুটবল বোদ্ধা আছে সেটা জানতে পারলে বিদেশে সম্ভবত কোচের আর অভাব হতো না। আফসোস আমরা নিজেদের সেভাবে ফোকাস করতে পারি না। জিদান লাকী কোচ, পেপ গার্দিওলা ভালো দল পাওয়ায় সফল হয়েছে, মরিনহো ছাগল কিসিমের কোচ – ফেসবুকের বদৌলতে এই ধরণের কিছু জ্ঞান আমার মাথায় ঢুকেছে।
অথচ প্রতিটি কোচেরই নিজস্ব কিছু চিন্তা ভাবনা থাকতেই পারে। একটা কাজ করার অনেকগুলো রাস্তা থাকে। আমরা সাধারণ মানুষেরা সচরাচর প্রচলিত রাস্তাটা নিয়ে ভাবি। কোচেরা দেখা যায় প্রতিপক্ষকে চমকে দেবার জন্য একটু বিকল্প পথে ভাবে। মাঝে মাঝে সেটা ক্লিক করে, মাঝে মাঝে করে না। একটা উদাহরণ দেই।
ইউরো ২০০৪ এ স্বপ্নের একটা প্রজন্ম নিয়ে পর্তুগাল আসে। নিজ দেশে টুর্নামেন্ট হওয়াতে কাপ জেতার জন্য তারাই সবচেয়ে ফেভারিট ছিল। অথচ কোয়ার্টার ফাইনালেই বড় একটা ধাক্কার মুখোমুখি হয়। প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ডের আরেকটা সোনালি প্রজন্ম। মাত্র ৩ মিনিটেই মাইকেল ওয়েনের গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর পর্তুগাল আর ম্যাচে ফিরতে পারছিল না।
ম্যাচের ৭৫ মিনিটের সময় সেই পর্তুগাল দলের সবচেয়ে বড় তারকা এবং অধিনায়ক লুইস ফিগোকে সাবস্টিটিউট করা হয়। অবাক লুইস ফিগো ম্যাচের মাঝেই তার অসন্তোস প্রকাশ করেন। কিন্তু কোচ স্কলারি অবিচল। আমদের দর্শকের অনেকেও স্কলারির সমালোচনা করতে থাকেন, সাথে কমেন্ট্রির মানুষেরাও। মজার ব্যাপার হচ্ছে সাবস্টিটিউট করার কিছুক্ষন পরেই (৮৩ মিনিটে) পর্তুগাল গোল করে ম্যাচে ফেরত আসে। গোলদাতা পস্তিগা, যিনি ফিগোর পরিবর্তে মাঠে নেমেছিলেন। এরপরেই আবার স্কলারি স্তুতি।
স্কলারি ভুল করেছিলেন কিনা সঠিক সেটা আমার বিবেচ্য বিষয় নয়, তবে আপনি যখন কাউকে দায়িত্ব দিবেন তখন তার উপরেই আপনাকে নির্ভর করতে হবে। প্রতিটা মানুষেরই নিজস্ব একটা বিচার বুদ্ধি থাকে। এরপরেও আমরা সমালোচনা করি।
২.
সমস্যা হচ্ছে যে আমি কিনা এই দুটো কাজ অপছন্দ করি সেই আমিই আবার মাঝে মাঝে একই কাজ করে ফেলি। মানুষ হয়ে জন্মানোর সমস্যা এটাই। কিছু কিছু ম্যাচে মনে হয় আসলেই রেফারির কিছু একটা কারসাজি আছে। স্পেশালি ১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটা নিয়ে তো আমার মনে কোন সন্দেহই নেই।
তবে আমি এইসব বিষয় নিয়ে এতটা কথা বাড়াই না কারণ আমার চেয়েও ভালো বুঝে এরকম অনেক মানুষ এসব ভুল ধরার জন্য জায়গা মতো বসে আছে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ফুটবলে প্রযুক্তি ব্যাবহারের সময় এসে পড়েছে। ২০১০ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড বনাম জার্মানীর ম্যাচে সম্ভবত ল্যাম্পার্ডের একটা বল গোল হবার পরেও বাতিল হয়ে যায়। সেটাকে আমার কাছে রেফারির ভুল বলেই মনে হয়। কিন্তু রেফারির ভুলের দায়ভার একটা দল কেন নেবে? আশার কথা হচ্ছে প্রযুক্তি ব্যাবহার আস্তে আস্তে আরম্ভ হয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে কোচের সমালোচনা করা। ২০০২ বিশ্বকাপে স্কলারি তার দল থেকে রোমারিওকে বাদ দেন। ম্যারাডোনা পরবর্তী আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড় হচ্ছেন রোমারিও। এই কারণে আমি কখনোই স্কলারিকে ক্ষমা করিনি। তবে বিষয়টাকে আমার আবেগের একটা বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
পরবর্তীতে একই কারণে হয়তো ২০১৪ বিশ্বকাপে দিনহো অথবা কাকার মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড় না নেবার কারণেও স্কলারির প্রতি একটা বিরক্তি ছিল।
কিন্তু, অবাক হয়েছিলাম ২০০৬ বিশ্বকাপে প্যাকারম্যানের সিদ্ধান্তে। আর্জেন্টিনা বনাম জার্মানীর ম্যাচে এতটা ডমিনেটিং অবস্থাতে থাকার পরেও মনে হলো নিজের হাতে ম্যাচটা জার্মানীর হাতে তুলে দিল। সবচেয়ে আত্মঘাতি সিদ্ধান্তটা ছিল ৭২ মিনিটে ১-০ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় রিকুয়েলমেকে উঠিয়ে নেওয়া।
৩.
রিকুয়েলমে আসলে কেমন খেলোয়াড় ছিলেন? আপনি রিকুয়েলমে টাইপের খেলোয়াড়দের কখনোই স্ট্যাট দিয়ে বিবেচনা করতে পারবেন না। রিকুয়েলমেকে বুঝতে হলে তার খেলা নিজের চোখে দেখতে হবে। খেলাধুলায় অলস সৌন্দর্য বলে একটা টার্ম প্রচলিত আছে। রিকুয়েলমের সাথে কথাটা বেশ ভালো ভাবে যায়।
আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মেসিকে নিয়ে একটা হতাশা আছে যে তাদের কোচরা মেসিকে ঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারেনি। রিকুয়েলমেকে নিয়ে আফসোসটা হচ্ছে তাকে আর্জেন্টিনা ব্যবহারই করেনি, ঠিক কিংবা বেঠিকটা তো পরের বিষয়। অথচ ম্যারাডোনা পরবর্তী তার মতো একজন পারফেক্ট মিডফিল্ডার আর্জেন্টিনা আর পায় নি।
বোকা জুনিয়র্সের হয়েই রিকুয়েলমে তাঁর প্রতিভার পরিচয় দেন। এই ক্লাবে থাকাকালীন সাত বছরে ছয়টি শিরোপা জেতেন যার মাঝে একটি কোপা লিবার্তোরেস আর একটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের মতো মর্যাদাসম্পন্ন শিরোপা ছিল। কিন্তু বার্সালোনাতে আসার পর কোন কারণে তৎকালীন কোচ ফন গাল তাকে উপেক্ষা করতে থাকেন। ফন গাল রিকুয়েলেমের বার্সালোনায় আসাটাকে রাজনৈতিক চুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন এবং তাকে তার পছন্দ মতো পজিশনে না খেলিয়ে উইঙ্গার হিসেবে খেলান। এই সময় আস্তে আস্তে রিকুয়েলমে প্রথম একাদশে জায়গা হারাতে থাকেন।
কোচের সাথে রিকুয়েলেমের বিবাদের কারণটা আমার কাছে ঠিক স্পষ্ট না। কিন্তু দোষ যারই হোক একটা জিনিস স্পষ্ট যে ফুটবল প্রেমীরা একজন জাত খেলোয়াড়ের খেলা দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
যে কোন আর্জেন্টাইন সমর্থকেরাই হয়তো স্বীকার করবেন যে ২০০৬ বিশ্বকাপের দলটা সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে ভালো দল ছিল। টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়ার কারণ হিসেবে যদি কোচের খামখেয়ালীর বিষয়টা বলে তাহলে আমি অন্তত সেটাকে দোষ মনে করি না।
৪.
সম্ভবত পেকারম্যানের আরেকটা ভুল ছিল জার্মানীর সাথে ম্যাচটাতে মেসিকে না নামানো। সেটা মেসির প্রথম বিশ্বকাপ ছিল। প্রথম বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়ে পেলে কারিশমা দেখিয়েছিলেন। কারিশমা দেখানোর জন্য প্রথম যে জিনিসটা লাগে সেটা হচ্ছে সুযোগ। মেসি সেটা পাননি, পেলে দেখাতে পারতেন কিনা জানা নেই, আবার পারতেন না সেটা বলাটাও ভুল হতো। সেই ম্যাচে মেসির উপর কোন চাপ থাকতো না। আর চাপ না থাকলে মেসি কেমন খেলে সেটা আমরা ভালোই জানি।
মেসি আসলে খেলোয়াড় হিসেবে কেমন? মেসির ভক্ত হন কিংবা হেটার তার সম্পর্কে বেশির ভাগ বিষয়ই মানুষের জানা। আমি বরং আলাদা কিছু বিষয়ে কথা বলি। ২০০৪ সালে বার্সার সিনিয়র দলে মেসির অভিষেক, কিন্তু প্রথম দুই মৌসুমে দলে সেভাবে সুযোগ পাননি। ২০০৭ মৌসুমে প্রথম ভালোভাবে সুযোগ পান। প্রথম মৌসুমেই ফিফা বর্ষসেরায় দ্বিতীয় হন। এরপর থেকে প্রতি মৌসুমে হয় প্রথম হয়েছেন নাহলে দ্বিতীয়। ফুটবল ইতিহাসে এরকম রেকর্ড আর কারো নেই। যে মৌসুম গুলোতে দ্বিতীয় হয়েছেন তাতেও ব্যক্তিগত ভাবে যথেষ্ট উজ্জ্বল ছিলেন।
মেসি কেমন খেলোয়াড় সেটা নিয়ে আলোচনা না করে মেসিকে আমি কিভাবে দেখি সেটা নিয়েই একটু বলি।
ফুটবলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোনটা? নিঃসন্দেহে গোল করা। মেসির সৌন্দর্যটা হচ্ছে সে গোল করার সাথে সাথে অন্যান্য কাজগুলো (যেমন অ্যাসিস্ট, ড্রিবলিং) খুব ভালো ভাবেই করতে পারদর্শী। তবে ঠিক এই কারণেও আমি মেসির ভক্ত নই।
মনে করুন আমাকে অফার দেওয়া হলো যে একই সময়ে বিভিন্ন মাঠে ম্যারাডোনা, জিদান, মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো খেলবেন। নিশ্চয়তা দেওয়া হলো যে সবাই তার বেষ্ট ফর্মে থাকবে। আমি কার খেলা দেখতে চাইবো?
চোখ বন্ধ করে মেসিকে বেছে নেবো।
কারণ আমার মনে হয় বেষ্ট ফর্মের মেসির চেয়ে সুন্দর আর কেউ খেলতেই পারবে না। (যাদের খেলা দেখিনি যেমন পেলে, ক্রুয়েফ, ডি স্টেফেনো তাদের বিবেচনায় আনিনি। তুলনা করলে দিনহো বিবেচনায় আসবে তবে দিনহোর চেয়ে অনেক বেশি দিন এই কাজটা করতে পেরেছিলেন বলে মেসিকেই এগিয়ে রাখবো।)
বেষ্ট ফর্মের মেসির খেলা ৯০ মিনিটই উপভোগ্য। অন্য কেউ অন্য কাউকে সিলেক্ট করতে পারেন, সেটা হয়তো ভুলও না কিন্তু আমার পছন্দ মেসি।
৫.
শুরু করেছিলাম যে টপিকসে সেটাতে ফেরত যাই। কোচের সমালোচনা করা আমার স্বভাব নয়। তবে আর্জেন্টিনার দুর্দশার জন্য পেকারম্যানকে আমি কিছুটা হলেও দায়ী করি। সেটা ২০০৬ এ রিকুয়েলমেকে ওঠানোর জন্য, আর মেসিকে না নামানোর জন্য।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো একই ঘটনার সাথে জড়িত এই দুই খেলোয়াড়েরই একইদিনে (২৪ শে জুন) জন্মদিন।