লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনার জন্য নি:শব্দ সংগ্রাম

আর্জেন্টিনার সাথে মেসির এই যাত্রা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে বড় বড় অর্জনের পেছনে থাকে একটি মানুষের গল্প, যা কখনোই নিখুঁত নয়, বরং হৃদয়বিদারক।

লিওনেল মেসি, যার সাফল্য ও দক্ষতা তাকে প্রায় অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। দীর্ঘদিন ধরে একজন অদ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। তবে এই সকল গৌরবের পেছনে রয়েছে ব্যথা, হতাশা এবং আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের সঙ্গে এক নিঃশব্দ সংগ্রামের গল্প। তার প্রাক্তন সতীর্থ হাভিয়ের পাস্তোরে একবার মেসির এই সংগ্রামের কথা বলেছিলেন। যেখানে ফুটে উঠেছিল তার আবেগিক ক্ষত ও সাফল্যের প্রতি অটুট প্রতিশ্রুতি।

বার্সেলোনায় মেসির প্রতিভা যেখানে সাফল্যের সোনালী অধ্যায় রচনা করছিল, আর্জেন্টিনার জার্সিতে ঠিক ততটাই কঠিন হয়ে উঠেছিল সাফল্য পাওয়া। ক্লাবের হয়ে তিনি যখন একের পর এক শিরোপা ও সম্মান জিতছিলেন, আন্তর্জাতিক সাফল্য ঠিক তখনই অধরা রয়ে যাচ্ছিল। এটি তাকে প্রচণ্ডভাবে ভারাক্রান্ত করেছিল, যা প্রকাশ পায় পাস্তোরের কথায়। তিনি বলেন, ‘খুব বেশি। আমরা ড্রেসিং রুমে দিনের পর দিন কাটাতাম—শুধু সে নয়, আমাদের কেউই জাতীয় দলে সুখী ছিলাম না।’

মেসির আর্জেন্টিনার সাথে এই যাত্রা শুধু খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি ছিল গভীরভাবে ব্যক্তিগত। প্রতিটি হার, প্রতিটি কাছাকাছি গিয়ে হারানো মুহূর্ত তাকে মনে করিয়ে দিত একটি জাতির অতৃপ্ত প্রত্যাশার কথা, যারা তাকে তাদের পরিত্রাতা মনে করত। পাস্তোরে স্মরণ করেছিলেন সেই মুহূর্ত যখন মেসি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তিনি আন্তর্জাতিক ফুটবল ছেড়ে দিচ্ছেন।

পাস্তোরে বলেন, ‘ও (মেসি) সত্যিই এটা বলেছিল কারণ সে তাই অনুভব করেছিল। সে নিজেকে জাতীয় দলের জন্য বোঝা মনে করেছিল, বিশ্বাস করেছিল তার কারণেই দলটি জিততে পারছে না। আমাদের ভেতরে সে এটাই বলেছিল।’ ট্রফি না পাওয়ার হতাশা তাকে ভেঙে দিয়েছিল, এবং মেসি আর্জেন্টিনার বারবার ব্যর্থতার জন্য নিজেকেই দায়ী করত।

এটি শুধুমাত্র হারার বিষয়ে ছিল না। প্রতিটি পরাজয় তাকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ নিরবতায় ডুবিয়ে রাখত। পাস্তোরে আরও বলেন, ‘সে হারলে সবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিত।” সে শুধু নিজের প্রত্যাশার সঙ্গেই নয়, বরং লক্ষ লক্ষ আর্জেন্টাইনের প্রত্যাশার সঙ্গেও লড়াই করত।

আর্জেন্টিনার সাথে মেসির সম্পর্ক ছিল জটিল। তাকে নিয়মিত দিয়েগো ম্যারাডোনার সাথে তুলনা করা হতো, যা তার উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করত। বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের একজন হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সাফল্য তার জন্য দূরেই রয়ে গিয়েছিল।

ভক্তরা তার কাছ থেকে ম্যারাডোনার ১৯৮৬ সালের কীর্তির পুনরাবৃত্তি আশা করত। ২০১৪ সালে জার্মানির বিপক্ষে বিশ্বকাপের ফাইনালে হার এবং ২০১২ ও ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকার ফাইনাল পরাজয় তার মানসিক বোঝাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। ২০১৬ সালের কোপা ফাইনালে চিলির বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করার পর তিনি স্বল্প সময়ের জন্য অবসরও নিয়েছিলেন, মনে করতেন যে তিনি তার দেশকে হতাশ করেছেন।

পাস্তোরে যে নীরব যন্ত্রণার কথা বর্ণনা করেছেন, তা প্রমাণ করে যে ফুটবল শুধু গোল ও জয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। রেকর্ড ও সম্মানের পেছনে থাকে একটি মানবিক গল্প—যেখানে রয়েছে আত্ম-সন্দেহ, সংগ্রাম, কষ্টের পতন ও পুনরুত্থান। আর্জেন্টিনার সাথে মেসির এই যাত্রা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে বড় বড় অর্জনের পেছনে থাকে একটি মানুষের গল্প, যা কখনোই নিখুঁত নয়, বরং হৃদয়বিদারক।

Share via
Copy link