লর্ডসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সৌরভ গাঙ্গুলি জার্সি খুলে হাওয়ায় ওড়াচ্ছেন।
২০০২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জেতার পর দাদার এই আইকনিক উদযাপন ক্রিকেট ইতিহাসেরই নস্টালজিক এক ছবি। একই সাথে ভারতীয় সমর্থকদের জন্য স্মৃতিতে উজ্জ্বল কিছু ঘটনার মধ্যে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফিজয়ের এ মুহূর্তটা অন্যতম।
ফাইনাল ম্যাচে ইংল্যান্ডের দেয়া ৩২৬ রানে লক্ষ্যে ১৩২ রানের মাঝেই একে একে সৌরভ গাঙ্গুলি, দীনেশ মোঙ্গিয়া, বীরেন্দ্র শেবাগ, রাহুল দ্রাবিড় যখন আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে গিয়েছেন ততক্ষণে ভারতের ফাইনাল জেতার আকাশসম স্বপ্নে মেঘ জমতে শুরু করেছে।
এর কিছুক্ষণ বাদে ব্যাটিং লাইনআপের অন্যতম ভরসা শচীন আউট হয়ে গেলে নিশ্চিত পরাজয়ের দিকেই ধাবিত হচ্ছিল টিম ইন্ডিয়া। উইকেটে তখন যুবরাজ সিং আর মোহাম্মদ কাইফ। তরুণ এ দুই ক্রিকেটার কতটু্কুই বা এগিয়ে নিতে পারবে? ভারত সমর্থকদের সে জিজ্ঞাসু মনে আশার চেয়ে বরং নিরাশায় বেশি ছিল।
কিন তারুণ্যের মন তো অদম্য সাহস আর উদ্যমে ভরা। অমন চাপের সময়ে যুবরাজ সিং আর মোহাম্মদ কাইফ পাল্টা আক্রমণ শুরু করলেন। দুজনে মিলে প্রায় ১৭.৪ ওভারে জুটি গড়লেন ১২১ রানের।
যুবরাজ ৬৯ রানে ফিরে গেলে কাইফের শুরু হয় একার লড়াই। ক্রিকেটের তীর্থভূমিতে ভারতের ঐতিহাসিক সিরিজ জেতাতে হয়তো বদ্ধ পরিকরই ছিলেন তিনি। একাই দলকে টেনে নিয়ে গেলেন কাইফ। ৭৫ বলে ৮৭ বলে রানের হার না মানা ইনিংসে ভারতকে নিয়ে গেলেন জয়ের বন্দরে। ভারতের শত কোটি জনতার উচ্ছ্বাসের এক উপলক্ষ তৈরি করলেন তিনি।
ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির সে ফাইনালের বয়স প্রায় ২০ বছর হতে চলল। দীর্ঘ দুই দশক পর সে ম্যাচজয়ের মুহূর্ত নিয়ে মোহাম্মদ কাইফ সম্প্রতি ক্রিকেট মান্থলিকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সে সাক্ষাৎকারের বেশির ভাগ অংশই জুড়ে ছিল শচীন টেন্ডুলকার। কারণ ঐ ম্যাচ জয়ের পরে শচীনের ‘রিঅ্যাকশন’ নাকি কাইফের কাছে বেশ অপ্রত্যাশিত ছিল।
শচীন টেন্ডুলকার বরাবরই চলনে নির্লিপ্ত ছিলেন। সতীর্থ কোনো ক্রিকেটার দারুণ পারফর্ম করলে হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে ‘ওয়েল প্লেইড, বাডি’ বলে প্রশংসা করেছেন, বড় জোর পিঠ চাপড়ে জানিয়েছেন অভিবাদন। এর বাইরে খুব বেশি উচ্ছ্বসিত শচীনকে দেখতে অভ্যস্ত না কেউ। কিন্তু ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জেতার পর অন্য এক শচীনকে আবিষ্কার করেন কাইফ।
তাঁর ভাষ্যমতে, ‘এটা দারুণ একটা মুহূর্ত ছিল যখন দেখলাম শচীন নিজেই দৌড়ে আমাদের দিকে আসছেন। আমি মনে করেছিলাম সাধারণত তিনি যেভাবে অভিবাদন জানান সেভাবেই করবেন। কিন্তু আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে শচীন দৌড়ে এসে আমাকে বুকে টেনে নিলেন। শচীনের এমন উচ্ছ্বাস দেখে আমি নিজেও সেদিন আপ্লুত হয়েছিলাম।’
তবে শচীনসহ দলের সবার ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জয়ের উচ্ছ্বাসে সেদিন ভেসে যাওয়ার পেছনে একটা গল্প আছে। সে সিরিজের এক বছর আগে ভারতের মাটিতে সিরিজ জয়ের পরে ইংলিশ অলরাউন্ডার অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ ঠিক একই ভাবে জার্সি খুলে উদযাপন করেছিলেন।
সেই দৃশ্য ভারতীয় ক্রিকেটারদের মনে একটা ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। একই সাথে মধুর এক প্রতিশোধ নেওয়ার উন্মত্ততা তৈরি করেছিল। এজন্য পরের বছরে ইংলিশদের মাটিতে মধুর সেই প্রতিশোধ মঞ্চস্থ হওয়ায় নিজেদের আর ধরে রাখতে পারেননি ভারতীয় ক্রিকেটাররা।
লর্ডসের ব্যালকনি থেকে নিজের জার্সি হাওয়ায় উড়িয়ে গাঙ্গুলি যেন সেদিন সতীর্থদের জানান দিচ্ছিলেন, এখনই তো সময় ওড়ার। এ ওড়ার পথে কোনো বাঁধা নয়।