দানিশ কানেরিয়ার উত্তরসূরী হিসেবে পাকিস্তান ক্রিকেটে আবির্ভাব তাঁর। ধীরে ধীরে ব্যাট হাতে উন্নতি করেছেন, নিজেকে পরিণত করেছেন পাকিস্তানের অন্যতম সেরা মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানে। ফিল্ডার হিসেবেও তিনি দুর্দান্ত, মাঝে মাঝেই দারুণ সব রান আউটে মনে করিয়ে দেন জন্টি রোডসের স্মৃতি। লাল বলের ক্রিকেটের তুলনায় সাদা বলের ক্রিকেটেই তিনি বেশি ভালো। ম্যাচের দৈর্ঘ্য যত কমে আসে, তাঁর কার্যকারীতা যেন ততই বাড়ে। তিনি শাদাব খান, পাকিস্তানের মিস্টার টোয়েন্টি।
বেশ চড়াই-উতরাই পেরিয়েই আজকের অবস্থানে আসা শাদাবের। কিন্তু নিজের একাগ্রতা আর পরিশ্রম দিয়ে তিনি জয় করেছেন সবকিছু। তাঁর অধীনে পিএসএলে ইসলামাবাদ ইউনাইটেড হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁর বেড়ে উঠা ফ্যাঞ্চাইজির হয়ে খেলতে খেলতেই। পরিসংখ্যান কথা বলে ২৪ বছর বয়সী এই অলরাউন্ডারের পক্ষেই। যদিও এসব পরিসংখ্যান তাঁকে খুব একটা ভাবায় না। তিনি বলেন, ‘ফ্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট অনেকটাই পরিসংখ্যান নির্ভর হলেও, জাতীয় দলের ব্যাপারটা সেরকম না। তাছাড়া ফ্যাঞ্চাইজি দলে আপনি বিদেশি খেলোয়াড় দিয়ে দলের দুর্বলতা ঢাকতে পারলেও, জাতীয় দলের খেলায় সে সুবিধা নেই।’
ইসলামাবাদ ইউনাইটেডের হয়ে চার নম্বরে ব্যাট করেছেন শাদাব। এই পজিশনে তাঁর সাফল্য ঈর্ষণীয়, ব্যাট করেছেন প্রায় ১৪৭ স্ট্রাইকরেটে। তাছাড়া স্পিনের বিপক্ষে তিনি মারাত্নক সাবলীল, দুর্দান্ত সুইপ খেলার পাশাপাশি বড় শট খেলতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। পাকিস্তানের মিডল অর্ডারের এই সংকটের সময়ে মিডল অর্ডারে শাদাব হতে পারেন এক ভরসার নাম।
শাদাব নিজেও জানেন সেটা, তবুও চিন্তাটা তিনি ছেড়ে দেন টিম ম্যানেজমেন্টের উপরই। ‘অলরাউন্ডার হিসেবে আপনি স্পেশালিস্ট ব্যাটারদের চাইতে খানিকটা বেশি আগ্রাসী হবেন এটাই স্বাভাবিক। কারণ আপনি জানেন ব্যাট হাতে ভালো করতে না পারলেও বল হাতে আপনার সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেবার সুযোগ আছে। মোহাম্মদ নওয়াজ এবং আমি দুজনেই ফ্যাঞ্চাইজির হয়ে উপরে ব্যাট করেছি এবং সফলও হয়েছি। তবে দিনশেষে আমরা বোলিং অলরাউন্ডার’, বলেন শাদাব।
আরও বলেন, ‘নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটাতে চার নম্বরে আমাকে একটু বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিল সবাই এবং সৌভাগ্যভাবে আমি তাতে সফল হয়েছি।’ সেদিনের ম্যাচটাতে পাকিস্তান রান তাড়া করতে নেমে ধুঁকছিল কিউই বোলারদের সামনে। শাদাব নেমেই খেলার চিত্রনাট্য বদলে দেন, প্রথম বলেই চার মারেন। তবে তাঁর বিধ্বংসী রূপটা দেখা যায় পরের ওভারে, ইশ সোধির এক ওভারে দুই চার আর এক ছক্কায় তুলে নেন ১৯ রান। তাঁর ইনিংসের সুবাদেই সেদিন ম্যাচ জিতেছিল পাকিস্তান।
এত দারুণ খেলার পরও পাকিস্তান কেন শাদাবকে উপরে ব্যাট করাচ্ছে না? এই প্রশ্নের জবাবও শাদাব দেন দুর্দান্তভাবে। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের মিডল অর্ডার ব্যাটারদেরকে তাঁদের পছন্দমতো পজিশনে ব্যাট করাচ্ছিলাম যাতে তাঁরা আরো আত্নবিশ্বাসী হতে পারে। গত ১২-১৮ মাস ধরে আমরা মিডল অর্ডারের দুর্বলতায় ভুগছি, চেষ্টা করছিলাম যাতে বিশ্বকাপের আগে সবাই ফর্মে ফেরে। তাছাড়া ঘরোয়া ক্রিকেটেও মিডল অর্ডারে পারফরমারের অভাব রয়েছে। যারা জাতীয় দলে মিডল অর্ডারে খেলছেন, তাঁরা সবাই ঘরোয়াতে টপ অর্ডারে ব্যাট করেন।’
ব্যাটিং এর পাশাপাশি শাদাবের যেটা মূল দায়িত্ব লেগস্পিন, সেখানেও দারুণ সফল তিনি। মাত্র ২৪ বছর বয়সেই ৮৭ উইকেট নিয়ে টি টোয়েন্টিতে পাকিস্তানের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি তিনি। হয়তো এবারের টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ৯৭ উইকেট নিয়ে উইকেটশিকারের তালিকায় চূড়ায় থাকা আফ্রিদিকে ছাড়িয়ে যাবেন তিনি।
এছাড়া পূর্বে অস্ট্রেলিয়াতে বিগব্যাশে খেলার অভিজ্ঞতাও কাজে দেবে শাদাবের। তিনি বলেন, ‘একেক মাঠের কন্ডিশন একেকরকম। ব্রিসবেনে সাধারণত এক্সট্রা বাউন্স থাকে, ফলে গতির উপর জোর দিতে হয়। তাছাড়া স্কয়ার বাউন্ডারি বেশ বড় হওয়াতে গতির উপরই ভরসা রাখতে হয়। এশিয়াতে আপনি এ ধরনের পেস কিংবা বাউন্স পাবেন না, কিন্তু এখানের কন্ডিশন পুরোপুরি ভিন্ন।’
এছাড়া বোলিং এ শাদাব পুরোপুরি ভার্সেটাইল একজন বোলার। বিগব্যাশ কিংবা পিএসএলে যেমন বোলিং শুরু করেছেন, আবার জাতীয় দলে বল করেছেন ইনিংসের মাঝামাঝি সময়ে। দুই ভূমিকাতেই তিনি দারুণ সফল। গত বছর থেকেই যেন বোলিংয়ের ধার আরো বেড়েছে তাঁর, ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন মাত্র ৬.৮১ হারে। তিনি জানান, ‘বোলিং এ আমি কোনো পরিবর্তন আনিনি। অতিরিক্ত কিছু করার চেষ্টা না করে, কেবল বেসিক ঠিক রেখে বল করার চেষ্টা করি। সবসময় চেয়েছি উইকেট টু উইকেট বল করতে। এক বলে চার হজম করলেও চেয়েছি প্ল্যান ঠিক রেখে পরের বলটা করতে।’
তবে শাদাব জানেন জাতীয় দলে তিনি শুরুতে বল করার সুযোগ পাবেন না। নতুন বলটা অধিনায়ক বাবর আজম তুলে দেবেন শাহীন আফ্রিদি, হারিস রউফ কিংবা নাসিম শাহের হাতেই। ডেথ ওভারটাও লেগস্পিনারদের জন্য নয় যদি না আপনার নাম রশিদ খান কিংবা ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা হয়। সে কারণেই মিডল ওভারগুলোতেই মূলত ব্যবহার করা হবে শাদাবকে। গত বিশ্বকাপেই ভারতকে প্রথমবারের মতো হারানোর স্বাদ পেয়েছে পাকিস্তান।
আর সেই জয়ের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল তাঁর। এবারের বিশ্বকাপের আগেও দারুণ ফর্মে আছেন শাদাব। তাঁর সামনে আবারো সুযোগ বিশ্ববাসীকে তাঁর প্রতিভার জানান দেবার। এই মূহুর্তে তিনি রয়েছেন তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে। দারুণ লেগস্পিনার, কার্যকরী ব্যাটার এবং অসাধারণ ফিল্ডার। এছাড়া পাকিস্তান জাতীয় দলের সহ অধিনায়কও তিনি।
তিনি বলেন, ‘খ্যাতি মাঝেমাঝে বিড়ম্বনা ডেকে আনে, ব্যক্তিগত জীবনে নানা সমস্যার উদ্রেক ঘটায়। তরুণ বয়সে আমি অনেক সমালোচনার শিকার হয়েছি। অন্যান্য দেশে খেলোয়াড়রা তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সমালোচনার শিকার হন না, কিন্তু আমাদের দেশের পরিস্থিতিটা পুরো আলাদা। আপনি ব্যক্তিগত জীবনে আনন্দে থাকলে, তাঁরা ভিন্ন দৃষ্টিতে এটাকে দেখবে। আর যদি কোনো কারনে পারফর্ম করতে না পারেন, সবাই বলবে আপনার ফোকাস সরে গেছে। তবে আমি এখন লোকের কথায় কান দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতি রাতে আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি, আমি কি আজকে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েছি। যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে আমি কোনো দ্বিতীয় চিন্তা মাথায় আনি না।’
এবারের বিশ্বকাপকে ঘিরে শাদাবের কাঁধে পুরো পাকিস্তানকে বইবার ভার। তবে তিনি চাপটা নিতে জানেন, চাপকে জয় করেই তো এসেছেন এতদূর পর্যন্ত।