গানের ভূবনে তাঁরা

এদিকে আমাদের ক্রিকেটারদের মধ্যে কয়েকজন তো আবার গানকে ঠাঁই দিয়েছেন হৃদয়ের গভীরে। গানকে তাঁরা মনে-প্রাণে ধারণ করেন। 

গান ভালোবাসে না এমন কজন আছে এ পৃথিবীতে? পুরো বিশ্বে চিরুনি তল্লাশি চালিয়েও খুব বেশি সংখ্যক এই ধরনের লোকজন পাওয়া যাওয়ার কথা না। একেকজন গানকে ভালোবাসেন একেকভাবে। কেউ গান শুনতে ভালোবাসেন, কেউ-বা গাইতে। কেউ গানের প্রতি ভালোবাসা থেকে এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন, কেউ-বা খালি গলায় গান গেয়েই আত্মতুষ্টি লাভ করেন।

আসলে আমরা যে পেশারই হই না কেন, সবাই কিন্তু গানকে ভালোবাসি এবং সে ভালোবাসা থেকে প্রায় সময় খালি গলায় গান গেয়েও থাকি। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। খেলার পাশাপাশি অবসর সময়ে তাঁরাও গলা ছেড়ে গান গেয়ে থাকেন। এই যেমন, ম্যাচ জয়ের পর সাজঘরে ‘আমরা করব জয়’ গানটি গেয়ে সবসময় উদযাপন করেন আমাদের জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। এটা রীতিমত তাঁদের সাজঘরের সংস্কৃতি হয়ে গেছে যা বহু বছর ধরে চলে আসছে।

এদিকে আমাদের ক্রিকেটারদের মধ্যে কয়েকজন তো আবার গানকে ঠাঁই দিয়েছেন হৃদয়ের গভীরে। গানকে তাঁরা মনে-প্রাণে ধারণ করেন।

  • মেহরাব হোসেন জুনিয়র

২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হওয়া মেহরাব হোসেন জুনিয়র খেলোয়াড়ের পাশাপাশি একজন ধারাভাষ্যকার হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি লাভ করেছেন। তবে অনেকের হয়তো জানা নেই যে তিনি একাধারে একজন গায়ক, সুরকার ও গীতিকার। ২০০৬ সালে নিজের কথা, সুর-সংগীতে ‘কখনো কি তুমি’ শিরোনামে একটি গান রেকর্ড করেন তিনি।

ক্রিকেটের পাশাপাশি গানের প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মে ক্লোজ আপ ওয়ান তারকা মেহরাবকে দেখে। সেই আগ্রহে তিনি গান শেখেন তারেক তুগরিলের কাছে। গান গাওয়ার পাশাপাশি গিটারও বাজাতে পারেন মেহরাব।

জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার খালেদ মাহমুদ সুজন তাঁর গানের খুব ভক্ত। মেহরাবকে কাছে পেলেই গান শোনবার সুযোগটি তাই কখনোই হারান না সুজন। তাছাড়া মাশরাফি, মুশফিক, রাজ্জাকসহ অনেক ক্রিকেটারই গায়ক মেহরাবের গুণমুগ্ধ ভক্ত।

সাধারণত বাংলা ও ইংরেজি গান শুনতে পছন্দ করেন মেহরাব হোসেন জুনিয়র। বাংলা গানের মধ্যে শায়ান চৌধুরী অর্ণবের ‘সে যে বসে আছে’, ‘তোমার জন্য নীলচে তারা’ গানগুলো রয়েছে মেহরাবের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। ইংরেজি গানের মধ্যে রোনান কেটিংয়ের ‘হোয়েন ইউ সে নাথিং অ্যাট অল’ গানটি খুব পছন্দ তাঁর।

জাতীয় দলে খেলার সময় নিজের সুরের মূর্ছনায় সাজঘর, হোটেলকক্ষ সর্বদা মাতিয়ে রাখতেন মেহরাব। ম্যাচ জয়ের পরপরই সাজঘরে গান ধরতেন তিনি আর সতীর্থরা সুর মিলাতেন তাঁর সাথে। ক্রিকেটের পাশাপাশি গান নিয়ে মেহরাব জুনিয়রের আলাদা কিছু পরিকল্পনাও রয়েছে। যদিও ২০০৬ সালের পর আর কোনো গান রেকর্ড করেননি তিনি।

  • রুবেল হোসেন

রুবেল হোসেনকে সাধারণত একজন গতিতারকা হিসেবে আমরা চিনি। বাইশ গজে বল হাতে গতির ঝলকে ব্যাটসম্যানদের পরাস্ত করাই তাঁর কাজ। মাঠে বল হাতে একজন নায়ক হলেও মাঠের বাইরে কিন্তু তিনি একজন গায়ক। সতীর্থদের মাঝে ভালো বোলারের পাশাপাশি ভালো গায়ক হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে তাঁর।

এখন পর্যন্ত কোনো গান রেকর্ড করা বা গানের অ্যালবাম বের করা হয়নি রুবেলের। তবে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে একদিন গাইতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে কোনো এক ইদের অনুষ্ঠানে সেদিন গান গেয়েছিলেন তিনি।

রুবেল হোসেন একজন গানপাগল ছেলে। গান শেখার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই তাঁর। ছোটবেলা থেকেই গান গাওয়াটা তাঁর শখ। জাতীয় দলের সাজঘর থেকে দলের পরিবহন হয়ে হোটেলকক্ষেও চলে রুবেলের গান। একবার খুলনা ক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে সতীর্থ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অনুরোধে স্টেইজ পারফর্মও করে ফেলেন তিনি। সেদিন উপস্থিত সবাই খুব উপভোগ করেছিল তাঁর গায়কি।

রুবেল হোসেনের প্রিয় শিল্পী প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চু। সবসময় শুনে থাকেন আইয়ুব বাচ্চুর গান। এমনকি আইয়ুব বাচ্চুর বেশিরভাগ গানই তাঁর মুখস্থ। গাইতে পছন্দ করেন ‘এখন অনেক রাত’ ও ‘চলো বদলে যাই’ গান দুটি। তাছাড়া আধুনিক বাংলা গানও রয়েছে রুবেলের আয়ত্তে। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম, নাসির হোসেন, শফিউল ইসলামসহ জাতীয় দলের প্রায় সবাই গায়ক রুবেলের ভক্ত।

বাগেরহাটের গ্রামের বাড়িতে এবং বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডায় প্রায়ই রুবেলের কণ্ঠে বেজে ওঠে গান। গানের মধ্যেই তিনি খুঁজে পান অনাবিল এক তৃপ্তি।

  • আবুল হাসান রাজু

২০১২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চৌহদ্দিতে প্রবেশ করেন আবুল হাসান রাজু। অভিষেক ম্যাচে খেলতে নেমেই সবাইকে চমকে দিয়ে ব্যাট হাতে শতক হাঁকান তিনি। এর ফলে বিশ্বের দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক টেস্টে ১০ নম্বরে নেমে শতক হাঁকানোর গৌরব অর্জন করেন সিলেটের এই ক্রিকেটার।

একজন ক্রিকেটার হিসেবে ক্রিকেট নিয়ে বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকলেও রাজু গানকে লালন করেন তাঁর হৃদয়ে। গান গাওয়াটা তাঁর শখের মধ্যে পড়ে যা ছোটবেলা থেকেই পুষে আসছেন তিনি। খেলায় ব্যস্ত থাকার পরেও যখনই অবসর সময় পান তখনই তিনি গান গেয়ে সেই সময়টা উপভোগ করেন।

গান গাওয়ার পাশাপাশি পাতার বাঁশিও বাজাতে পারেন রাজু। হাবিব ওয়াহিদ ও অরিজিৎ সিং রয়েছেন তাঁর প্রিয় শিল্পীর তালিকায়। প্রায় সব ধরনের গানই গাইতে পারেন তিনি। শুনতে পছন্দ করেন রবীন্দ্রসংগীত, হিন্দি ও আধুনিক বাংলা গান। তবে কোনো একটা গান পছন্দ হলেই সেটি নিয়ে গুনগুন শুরু হয়ে যায় তাঁর।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের মাশরাফি বিন মুর্তজা ও সাকিব আল হাসান রাজুর গানের খুব ভক্ত। সুযোগ পেলেই তাঁরা গান শুনানোর আবদার করে বসেন রাজুর কাছে। রাজুও এই বিষয়গুলো খুব উপভোগ করেন। মাঠের আড্ডা থেকে শুরু করে সাজঘর, হোটেলকক্ষে গান গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করার বিষয়টি একদম তাঁর নখদর্পণে বলে চলে।

  • হামিন আহমেদ

মেহরাব হোসেন জুনিয়র, রুবেল হোসেন ও আবুল হাসান রাজু থেকে হামিন আহমেদ কিছুটা ব্যতিক্রম। মেহরাব, রুবেল ও রাজু পেশাগতভাবে সংগীতশিল্পী না হলেও হামিন আহমেদ একজন পেশাদার সংগীতশিল্পী ও সুরকার। তবে তিনিও একসময় পেশাদার ক্রিকেটার ছিলেন এবং দেশের শীর্ষ পর্যায়ের লিগগুলোর পাশাপাশি জাতীয় দলে খেলেছেন। কিন্তু গায়ক ও গিটার বাদক হিসেবেই সাধারণ মানুষের নিকট অতি সমাদৃত তিনি।

হামিন আহমেদের জন্ম এক সংগীত পরিবারে। তাঁর বাবা কমল দাশগুপ্ত ছিলেন একজন সংগীত পরিচালক এবং মা ফিরোজা বেগম ছিলেন একজন নজরুল সংগীতশিল্পী। তাঁদের দুই সন্তান হামিন আহমেদ এবং শাফিন আহমেদও সংগীতশিল্পী। হামিন ও তাঁর ভাই শাফিন বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘মাইলস’ এর সদস্য। তাঁরা দুই ভাই সমান তালে গান গেয়ে থাকেন মাইলসের হয়ে। সাধারণত মাইলসের ভোকাল এবং গিটারে কাজ করে থাকেন হামিন। তাঁর গাওয়া গানগুলোর মধ্যে ‘নি:সঙ্গতা’, ‘নীলা’, ‘অচেনা জীবন’, ‘হৃদয়হীনা’ দর্শক পরিমণ্ডলে বেশ জনপ্রিয়।

হামিন আহমেদ সংগীত জগতে প্রবেশ করার পূর্বে একজন পেশাদার ক্রিকেটার ছিলেন। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে একসময় সূর্যতরুণ, আজাদ বয়েজ, ন্যাশনাল স্পোর্টিং, আবাহনী ও মোহামেডানের মতো ক্লাবগুলোর হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন তিনি। তাছাড়া ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৯৮৬ আইসিসি ট্রফিতে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার পর সংগীতে পূর্ণ মনোনিবেশ করতে ১৯৮৭ সালে ক্রিকেটকে বিদায় জানান হামিন।

  • ওমর খালিদ রুমী

বাংলাদেশ ক্রিকেটের গোড়াপত্তনের সময় অন্যতম সদস্য হিসেবে দলের সাথে ছিলেন ওমর খালেদ রুমি। একজন পুরোদস্তুর অলরাউন্ডার হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন তিনি। খেলেছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বপ্রথম ম্যাচ। ১৯৭৭ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের বিপক্ষে ৩ দিনের সেই ম্যাচে ব্যাট হাতে প্রথম ইনিংসে ২৮ ও দ্বিতীয় ইনিংসে দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৩২ রানের ইনিংস খেলেন রুমি। সেইসাথে বল হাতে তুলে নিয়েছিলেন ৩টি উইকেট।

ওমর খালেদ রুমি ছিলেন একজন মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান এবং লেগ স্পিনার। তখনকার সময় দেশসেরা লেগস্পিনার হিসেবে বিবেচিত ছিলেন তিনি। নিজের উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে বল হাতে অতিরিক্ত বাউন্স আদায় করে নেওয়ার পাশাপাশি গুগলি ছাড়তেও বেশ পারদর্শী ছিলেন রুমি। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে ক্যারিয়ারের সিংহভাগ সময়ই তিনি কাটিয়েছেন আবাহনীর হয়ে খেলে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত নিয়মিত খেলেছেন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে।

সত্তরের দশকে ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি সংগীত জগতে প্রবেশ করেন ওমর খালেদ রুমি। ক্রিকেটারের পাশাপাশি একজন সংগীতশিল্পী হিসেবেও বেশ নামডাক রয়েছে তাঁর। বাংলাদেশে পপ সংগীতের জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি। সত্তরের দশকে বাংলাদেশে যখন পপ সংগীত আসতে শুরু করে তখন থেকেই তিনি পপ গান গাওয়া শুরু করেন।

১৯৭২ সালে তিনি এবং কয়েকজন মিলে একটি ব্যান্ড গঠন করেন যার নাম ছিলো ‘আন্ডারগ্রাউন্ড পিস লাভার্স’। ব্যান্ডের প্রধান গায়ক ছিলেন ওমর খালেদ রুমি। পাশাপাশি লিড গিটারেও কাজ করতেন তিনি। ১৯৭২ সালে ব্যান্ড গঠনের কিছুদিন পর তিনি প্রথম স্টেইজ প্রোগ্রাম করেন হোটেল পূর্বানীতে। তার পর ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় শো করতে থাকেন রুমি ও তাঁর ব্যান্ড ‘আন্ডারগ্রাউন্ড পিস লাভার্স’। সেসময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সাথে ১ বছরের চুক্তিতে যান তাঁরা।

বিভিন্ন ব্যান্ডের পাশাপাশি দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দুটি ব্যান্ড ‘রেনেসাঁ’ ও ‘ফিডব্যাক’ এর হয়ে কাজ করেছেন রুমি। ১৯৯৭ সালে নিজের আরেকটি ব্যান্ড গঠন করেন তিনি। ব্যান্ডটির নাম ‘বাংলাদেশ’ যেখানে দীর্ঘ ১২ বছর কাজ করেছেন রুমি। এখনও এই ব্যান্ডটির কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে যার হয়ে মাঝেমাঝে গান করে থাকেন তিনি। কিন্তু ব্যান্ডে আগের মতো সময় দেওয়া আর হয় না তাঁর।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ওমর খালেদ রুমি  একইসাথে ক্রিকেটার, সংগীতশিল্পী, লেখক ও চিত্রশিল্পী। ক্রিকেটের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংগীত মহলে বেশ পরিচিত তিনি। গানের সাথে যুক্ত থাকায় দেশের খ্যাতনামা সংগীত শিল্পীদের সাথে রয়েছে তাঁর পরিচয়। প্রয়াত কিংবদন্তি  সংগীতশিল্পী লাখী আখান্দ ছিলেন তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

ওমর খালেদ রুমি সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানান ১৯৮৪ সালে। ক্রিকেট থেকে অবসরে যাবার পর একসময় জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সাবেক এই কৃতি অলরাউন্ডার।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...