তারপরও স্বপ্ন, তারপরও লড়াই

আমি এমন একটা জায়গায় ব্যাটিং করি, যেখানে আসলে ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টিতে গিয়েই স্লগ করতে হয়। ফলে পাওয়ার হিটিং এবিলিটিটা আমার বাড়াতে গত। গত লক ডাউনের সময় থেকে, মানে প্রায় দু বছর ধরে আমি এগুলো নিয়ে বাবুল স্যারের (মিজানুর রহমান বাবুল) সাথে কাজ করছি।

এগারো বছর ধরে স্বীকৃত ক্রিকেট খেলছেন। কিন্তু এমন আউট কখনো হননি বা কাউকে চোখের সামনে হতেও দেখেননি।

সেই আউটই আজ হলেন নুরুল হাসান সোহান।

রান নিতে গিয়ে বোলার-ফিল্ডার ও বলের মাঝে চলে এসেছিলেন; তার পায়ে বলও লেগে গিয়েছিলো। ফলে আম্পায়াররা আলোচনা করে ‘অবস্ট্রাক্টিং দ্য ফিল্ড’ আউট দিলেন তাকে। এ নিয়ে সোহানের কোনো আফসোস নেই। খাটি স্পোর্টসম্যানের মত একটু হেসে বললেন, ‘আগে কখনো এরকম আউট হইনি। তবে আজ আমারই দোষ ছিলো। আসলে দৌড়াতে গিয়ে বলের দিকে চোখ রাখতে পারিনি। বলে যে পা লেগে যাচ্ছে, সেটা খেয়াল করিনি। এটা আসলে পার্ট অব গেম।’

এই কথাটা দিয়ে আপনি নুরুল হাসান সোহানকে চিনে নিতে পারেন। তার জীবনের প্রতি অবিচার, বঞ্চনা কম আসেনি। তার ভক্তদের দাবি, তিনি এখনও দারুন অবিচারের শিকার। কিন্তু সোহান এসব কথা বলতে একদম রাজী নন। তার কাছে এই জাতীয় দলে সুযোগ না পাওয়া, ঠিক মত মূল্যায়িত না হওয়া; এসবই পার্ট অব গেম। তিনি এসব নিয়েই চলতে চান।

এতো কিছুর পরও সোহান শুধু স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখেন, একদিন লাল সবুজ জার্সিটা শরীরে চাপিয়ে বড় কিছু করবেন। আর সে জন্য একটা মুহুর্তের জন্যও লড়াই ছাড়তে রাজী নন।

কোনোরকম তর্ক ছাড়াই তিনি দেশের সেরা উইকেটরক্ষক।

লোয়ার-মিডল অর্ডারে তিনি যে দারুন কার্যকর ব্যাটসম্যান, সে প্রমাণ আগেও অনেকবার দিয়েছেন; আবার দিচ্ছেন। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ টি-টোয়েন্টির সুপার লিগে শেষ দুই ম্যাচে তার রান ১৭ বলে অপরাজিত ৪৪ এবং ২৪ বলে ৪২।

আপনি খেলা দেখেছেন?

না দেখলে এই পরিসংখ্যান দেখে আসলে ঠিক বুঝতে পারবেন না, কী ভয়ানক মারকুটে ব্যাটিং করেছেন সোহান। সবসময়ই নিচের দিকে ব্যাট করতে গিয়ে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে এই উইকেটরক্ষক মারকুটে। কিন্তু এই লিগে একটু অন্যরকম মনে হলো।

সোহান এই অন্যরকমের ব্যাখ্যাটা দিলেন, ‘আসলে আমার কিছু সমস্যা ছিলো লিমিটেড ওভারে। আমি এমন একটা জায়গায় ব্যাটিং করি, যেখানে আসলে ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টিতে গিয়েই স্লগ করতে হয়। ফলে পাওয়ার হিটিং এবিলিটিটা আমার বাড়াতে গত। গত লক ডাউনের সময় থেকে, মানে প্রায় দু বছর ধরে আমি এগুলো নিয়ে বাবুল স্যারের (মিজানুর রহমান বাবুল) সাথে কাজ করছি। অনেক কিছু চেঞ্জ হয়েছে। তার হয়তো ফল পাচ্ছি।’

সোহানকে নিয়ে একটা অভিযোগ হলো, অফ সাইডে তার হাতে শট কম। সে জন্য সোহান স্ট্যান্স নিয়েও কিছু কাজ করছেন। যার প্রভাব তার ব্যাটিংয়ে এই লিগেই দেখা যাচ্ছে। তিনি বলছিলেন, ‘আমি শট বাড়ানো নিয়ে কাজ করছি। আপনি ঠিক দেখেছেন, স্ট্যান্স একটু চেঞ্জ হয়েছে। আমার আসলে স্ট্যান্সে একটু সমস্যা ছিলো। আমি আগে একটু ঝুকে যেতাম। এখন অনেক ওপেন চেস্ট পজিশনে এসেছি। সেটা কাজেও দিচ্ছে। স্যারের সাথে আরও কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করছি।’

কিন্তু কেনো? এই কাজ করে, রান করেও জাতীয় দলে প্রাপ্যটা তো পাচ্ছেন না। ব্রাত্য হয়ে বসে আছেন। সোহানের এ নিয়ে নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে। তা শোনার আগে অবিচারের গল্পটা শুনুন।

সোহান ক্যারিয়ারে টেস্ট খেলেছেন প্রথম টেস্টে ক্রাইস্টচার্চের ভয়াবহ বাস্তবতায় ৪৭ রানের ইনিংস। পরের টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজে ৮ নম্বরে নেমে ৬৭ রানের ইনিংস। এর এক টেস্ট পর আর সোহান টেস্ট দলে নেই।

আমরা প্রশ্ন করি, কেন নেই?

সোহান টেস্ট খেলবেন কিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে। কিপার হিসেবে তিনি দেশের বেশ বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকা সেরা। মুশফিকুর রহিম টেস্টে কিপিং করছেন না। করছেন লিটন দাস। দলে আরও একজন কিপার ঠাই পাচ্ছেন-মোহাম্মদ মিঠুন। তাহলে ৬-৭ নম্বরে ব্যাট করতে পারা এবং ভালোভাবে সেটা পারা সোহান নয় কেনো? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।

এবার আসুন লিমিটেড ওভার ক্রিকেটে।

দুটি ওয়ানডে খেলা সোহানের একটা ৪৪ রানের ইনিংস আছে। ৯টি টি-টোয়েন্টি খেলা সোহানের স্ট্রাইকরেট ১২৩.৮০। ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি প্রমানিত খেলোয়াড়। এই ঢাকা লিগে দুই শতাধিক রান করা খেলোয়াড়দের মধ্যে এবারও সর্বোচ্চ স্ট্রাইকরেট তার। তারপরও কেনো সোহান সুযোগ পাবেন না?

সোহানকে দলে নেওয়া মানে আপনি উইকেটের পেছনে একটা অবিচল আস্থা পাচ্ছেন। সেই সাথে নিচের দিকে কিছু নিয়মিত রান। এই পাওয়াটা কেনো আমরা অবহেলা করবো?

সোহান এসব প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না। তার কাছে খেলাধুলায় একটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, ‘দ্যাখেন, এটা তো আমার হাতে নেই। আমার আসলে কোনো অভিযোগও নেই। কারণ, আমি হয়তো টিম কম্বিনেশনের কারণে সুযোগ পাচ্ছি না। সেটাও আমাদের বুঝতে হবে। ইচ্ছে করে তো আমাকে কেউ বাইরে রাখছে না। বিভিন্নরকম টিম কম্বিনেশন হয়। সেই কারণে আমি চান্স পাচ্ছি না। তাই আমি কাউকে দোষ দেই না।’

কাউকে দোষ দেন না; তাই বলে হালটাও ছেড়ে দেন না। সোহান বলছিলেন, তার চূড়ান্ত স্বপ্ন জাতীয় দলের হয়ে বড় কিছু অর্জন করা। আর সেটা করার জন্য যতটা লড়াই দরকার, তিনি করে যাবেন, ‘আপনি আমাকে পাঁচ বছর পরও জিজ্ঞেস করলে আমি উত্তর দেবো যে, আমার স্বপ্ন ইন্টারন্যাশনালে কিছু করা। আমার স্বপ্ন লাল-সবুজ জার্সিতে বড় কিছু এচিভ করা। আসলে স্বপ্ন দেখতে না পারলে তো আমি লড়াই করতে পারবো না। তাই আমি লড়াই করে যেতে চাই, স্বপ্ন দেখতে চাই।’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...