সাধারণত ক্রিকেটার হওয়ার তাগিদে বা মাঠে নিজেদের সেরাটা দেয়ার জন্য ক্রিকেটারদের বেশিরভাগ অভ্যাস পরিবর্তন করতে দেখা যায়। ইতোমধ্যে এমন অনেক ক্রিকেটারের পরিচয় মিলেছে যারা শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে এবং মাঠে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে নিয়মিত খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন। তবে এমন কয়েকজন ক্রিকেটারকেও দেখা গেছে, যারা নিজেদের নাম পরিবর্তন করেছেন।
তাদের মধ্যে কেউ ক্রিকেট শুরু করার আগে এবং কেউ খেলোয়াড়ি জীবনের মাঝপথে এসে নামে পরিবর্তন এনেছেন। মূলত ধর্মীয় কারণে এ তালিকায় এশিয়ান ক্রিকেটারদের আধিক্য বেশি দেখা যায়। আজকের লেখার সেরকম কয়েকজন ক্রিকেটারের কথাই তুলে ধরা হচ্ছে।
- তিলকারত্নে দিলশান (শ্রীলঙ্কা)
‘দিলস্কুপ’ শটের জনক তিনি। পুরোদস্তর অলরাউন্ডার। তাঁর বাবা একজন মুসলিম এবং মা বৌদ্ধ ধর্মানুসারী। বাবার ধর্মানুযায়ী জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় তুয়ান মোহাম্মদ দিলশান। যদিও মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদের পর ষোল বছর বয়সী দিলশান তাঁর মায়ের ধর্মে ফিরে আসেন এবং নাম পরিবর্তন করে তিলাকরত্নে মুদিয়ানসেলাগে দিলশান রাখেন।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে দীর্ঘদিন মিডল অর্ডারে ব্যাট করলেও এক সময় ওপেনার হিসেবে সুযোগ পেয়ে সেখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন দিলশান। আক্রমণাত্মক এই ব্যাটসম্যানের সংগৃহীত ১০২৯০ রানের মধ্যে ৭৩৬৭ রান আসে ওপেনিংয়ে ব্যাট করে। ওয়ানডেতে করা ২২টি শতকের ২১টিই আসে একই অবস্থানে খেলে। তাছাড়া ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে তিন সংস্করণে শতক হাকানোর কীর্তিও রয়েছে তাঁর দখলে।
- বব উইলিস (ইংল্যান্ড)
বিখ্যাত ইংরেজ ক্রিকেটার বব উইলিসের আসল নাম ছিল রবার্ট জর্জ উইলিস। কিন্তু কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী বব ডিলানের বড় ভক্ত হওয়ায় নিজের নাম বদলে ‘বব উইলিস’ রাখার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এজন্য অবশ্য সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে হয় তাকে। শেষ পর্যন্ত নিজের নতুন নামেই খ্যাতিমান হন উইলিস।
খেলোয়াড়ি জীবনে বেশ উজ্জ্বল ছিলেন এই ডানহাতি ফাস্ট বোলার। টেস্টে ৩২৫ ও ওয়ানডেতে ৮০ উইকেটের মালিক তিনি। এমন কি উইলিসের নামের পাশে রয়েছে ষোলবার পাঁচ উইকেট নেয়ার কীর্তি যা মূলত তাঁর সফল ক্যারিয়ারের চিত্রই তুলে ধরে।
- মনসুর আলী খান পতৌদি (ভারত)
পতৌদির নবম নবাব ছিলেন এই মনসুর আলী খান পতৌদি। তাঁর বাবা ইফতিখার আলী খান পতৌদি ছিলেন ভারতের সাবেক অধিনায়ক। ১৯৬১ সালে লাল বলের ক্রিকেটে অভিষেক হয় মনসুরের। এক বছরের মাথায় মাত্র ২১ বছর বয়সে ভারতের সর্ব কনিষ্ঠ টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি।
১৯৭১ সাল পর্যন্ত নওয়াব পতৌদি জুনিয়র নামে ক্রিকেট খেলে যান মনসুর। কিন্তু ১৯৭১ সালে সাংবিধানিক কারণে নিজের নাম পালটাতে বাধ্য হন তিনি। নাম পরিবর্তনের পর মাত্র ৭টি টেস্ট খেলেন এই ডানহাতি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান।
ক্যারিয়ারে ৪৬ টেস্টে ৩৪.৯১ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ২৭৯৩ রান। এর মধ্যে রয়েছে ৬টি শতক ও ১৬টি অর্ধশতক। ১৯৬৪ সালে দিল্লিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ার সেরা অপরাজিত ২০৩ রানের ইনিংসটি খেলেন তিনি।
- মোহাম্মদ ইউসুফ (পাকিস্তান)
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানি ক্রিকেটার ইউসুফ ইউহানা খ্রিস্টান ধর্ম থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হন। তারপর লাহোরের এই ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ ইউসুফ নামে পরিচিতি লাভ করেন। এর আগে একমাত্র খ্রিস্টান এবং পঞ্চম অমুসলিম ক্রিকেটার হিসেবে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি।
সতীর্থ সাঈদ আনোয়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়েই মূলত ইসলাম গ্রহণ করেন ইউসুফ। কেবল পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তিনি ধর্ম পরিবর্তন করেছিলেন বলে বিশ্বাস অনেকের। যদিও ধর্মান্তরিত হবার আগেই ২০০৪ সালে জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেন তিনি।
২০০৬ সালে ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা পার করেন ইউসুফ। সে বছর ব্র্যাডম্যানসুলভ ৯৯.৩৩ গড়ে ১৭৮৮ রান তুলে একজন সাধারণ ব্যাটসম্যান থেকে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করেন তিনি। সেই সাথে এক বছরে সর্বোচ্চ রানের মালিকও বনে যান মোহাম্মদ ইউসুফ।
- আসগর আফগান (আফগানিস্তান)
২০১৮ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানের প্রাক্তন অধিনায়ক আসগর আফগান তাঁর নাম পরিবর্তন করেন। কাবুলে জন্ম নেয়া এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান পূর্বে পরিচিত ছিলেন আসগর স্টানিকজাই নামে। পরবর্তীতে নিজের নামের পাশে ‘আফগান’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে বেশ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন তিনি।
আফগানিস্তানের জার্সি গায়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা ক্রিকেটারদের মধ্যে আসগর আফগান অন্যতম। ২০০৯ সালে আফগানিস্তানের ওয়ানডে মর্যাদা পাওয়ার সময় থেকেই নির্ভরযোগ্য ক্রিকেটের হিসেবে দলে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে নেন এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান।
- মাহমুদুল হাসান রানা (বাংলাদেশ)
২০০০ সালের নভেম্বরে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টটিই ছিল মাহমুদুর রহমান রানার ক্যারিয়ারে খেলা প্রথম ও একমাত্র আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ধর্মান্তরের আগে তিনি বিকাশ রঞ্জন দাস নামে পরিচিত ছিলেন এবং খেলোয়াড়ি জীবনে এ নামেই সবাই চিনত তাঁকে।
অভিষেক ম্যাচে এই বাঁ-হাতি মিডিয়াম ফাস্ট বোলারের একমাত্র শিকার ছিলেন সদাগোপন রমেশ ৷ সাধারণত মোটামুটি গতির সাথে বলকে বাঁক খাওয়াতে দক্ষ ছিলেন ‘এক টেস্টের বিস্ময়’ রানা। কিন্তু ইনজুরির পাশাপাশি ঘরোয়া ক্রিকেটে অধারাবাহিক পারফরম্যান্স কিশোরগঞ্জের এই ফাস্ট বোলারের সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ারকে অকালে শেষ করে দেয়।
২০০৪-০৫ সাল পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট এবং ক্লাব ক্রিকেটে খেলা চালিয়ে যান রানা। তখন সময়ের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে ফাস্ট বোলিং ছেড়ে বাঁ-হাতি স্পিনার হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন। যদিও তাঁর এই নতুন রূপ খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি এবং সময়ের স্রোতে বিস্মৃতির অতল গর্ভে তলিয়ে যান তিনি।