প্রক্রিয়ায় গলদ, রিয়াদে নয়

প্রক্রিয়ায় ভুল, বড় ভুল। তাতে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দায় নেই। তার জন্য এটা ছিল সুযোগ। বড় সুযোগ। তিনি কাজে লাগালেন দারুণ ভাবে। তার সেরা ইনিংস হয়তো এটি নয়। তবে স্মরণীয় ইনিংস, সন্দেহ নেই। কৃতিত্ব, স্তুতি, প্রশংসা, সবই তাঁর প্রাপ্য।

সেঞ্চুরি ছোঁয়ার পর যখন সতীর্থরা ড্রেসিং রুমের সামনে তালিতে ফেটে পড়ছেন, তিনি সেদিকে তাকিয়ে আঙুলে ইশারা করলেন ওপরের দিকে। হয়তো বোঝাচ্ছিলেন, ‘এই চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে ওপরেই!’

সেটাই হওয়ার কথা। নইলে আজ তার থাকার কথা ছিল জিম্বাবুয়ে যাওয়ার উড়ানে। অথচ তিনি কিনা উড়লেন হারারের ২২ গজে!

টেস্ট স্কোয়াডে তিনি ছিলেন না। থাকার কারণও ছিল না। ওয়ানডে দলের অন্যদের হয়ে আজকে ভোরে তিনি রওনা হতেন জিম্বাবুয়ের পথে। কিন্তু দল ঘোষণার তিন দিন পর তাকে যুক্ত করা হয় টেস্ট দলে। তাতে আলোচনা-সমালোচনা-প্রশ্নের ঝড়। সেটিই স্বাভাবিক, বাদ পড়ার পর থেকে তো তেমন কিছু করেননি সাদা পোশাকে!

মনে পড়ছে, গত বছর টেস্ট দল থেকে বাদ পড়ার পরপর কোচ রাসেল ডমিঙ্গো ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহর টেস্ট ক্যারিয়ার নিয়ে। আরও সাত মাস পর, কোভিড বিরতির পর যখন ক্রিকেট ফিরছে, তখন কোচ বলেছিলেন, ‘আমি যা দেখেছি, মহামারীর এই সময়ে সে কঠোর পরিশ্রম করেছে, ৫-৬ কেজি ওজন ঝরিয়েছে। খুব ভালো ট্রেনিং করছে, খুব ভালো ব্যাটিং করছে। টেস্টে ফিরতে আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, যা সে করে চলেছে। দলে ফিরতে তাকে দারুণ কিছু পারফরম্যান্সও দেখাতে হবে।’

কোভিড ১৯ বিরতির পর মাঠে যখন তাকে দেখলাম, দেখি ওজন আরও কমিয়ে একদম কাঠি। বললাম, ‘আপনি তো দেখি কারিনার মতো জিরো ফিগার বানাইছেন।’ তিনি হেসে বলেছিলেন, অনেকেই তাকে এই কথা বলেই খেপাচ্ছে।
যাই হোক, কোচের চাওয়া মতো পরিশ্রম তিনি করেছেন, কিন্তু পারফরম্যান্স দেখানোর জায়গা ছিল না। বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচই যে আর খেলেননি কোনো!

তার পরও এবার স্কোয়াডে ফিরলেন। নির্বাচকদের যুক্তি ছিল, তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমের চোট শঙ্কার কারণে অভিজ্ঞ কাউকে সঙ্গে রাখা। এই যুক্তির বিপক্ষে হাজারটা যুক্তি আছে। কিন্তু নির্বাচক কমিটি, ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত তাতে বদলাচ্ছে না।

এরপর স্কোয়াড থেকে একাদশেও। যথারীতি, আবারও প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ প্রবলভাবে। কিন্তু শুরুতে যেটা বলেছি, তার তো দায় নেই সেখানে। তিনি নিশ্চয়ই অনশন করেননি যে তাকেই নিতে হবে! তিনি সুযোগ পেয়েছেন, টেস্ট ক্যারিয়ারের পুনজর্ন্ম ঘটনোর হয়তো শেষ সুযোগ। উইকেটে যখন যান, ১৩২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে দল। সেখান থেকে তিনি যা খেলেছেন, সেটাতে স্রেফ বলা যায় দুর্দান্ত ও নিখুঁত।

ইনিংসটা যে পথে গড়েছেন, তা দারুণ। লিটন যখন কালকে সাবলীল ব্যাটিংয়ে রান বাড়াচ্ছে। মাহমুদউল্লাহ তখন উইকেট আঁকড়ে রেখেছেন। ফিফটি করেছেন ১৩৩ বলে। আজকে সকালে তাসকিন যখন দারুণ সব শট খেলছে, মাহমুদউল্লাহ আবার নিজেকে সামলে রেখেছেন। পরে সুযোগ মতো তিনিও খেলেছেন শট। দ্বিতীয় পঞ্চাশ কেবল ৬২ বলে।

এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেঞ্চুরিতেই কাজ শেষ মনে করেননি। শেষ পর্যন্ত থেকেছেন, বড় কৃতিত্ব প্রাপ্য এখানে। আট নম্বরে নেমে দেড়শ করার কীর্তি টেস্ট ইতিহাসেই তার আগে আছে কেবল চারজনের।

বিপদ থেকে দলকে উদ্ধার করা অনেক ইনিংস তার আছে। অনেক সময় যথেষ্ট কৃতিত্ব পান না বা আড়ালে পড়ে থাকতে হয়, এসবও কম-বেশি সত্যি। তবে আজকের স্তুতির জোয়ারে একটা কথা মনে রাখা জরুরি, গত বছর টেস্ট থেকে তাকে বাদ দেওয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। রান পাচ্ছিলেন না, তার চেয়ে বড় কথা, আউট হচ্ছিলেন দৃষ্টিকটুভাবে। রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে নাসিম শাহর হ্যাটট্রিক ডেলিভারির শটটা এখনও সহজে ভোলার নয়। তার ব্রেক দরকার ছিল।

সঙ্গে এটাও মনে রাখা জরুরি, এই সেঞ্চুরি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। তাদের বোলিং আক্রমণ অনভিজ্ঞ এবং বৈচিত্রহীন। না, তার কৃতিত্ব মোটেও কমাচ্ছি না। তাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শেষ সুযোগ, এটা প্রচণ্ড চাপের। এই বোলিং আক্রমণের সামনেই দলের অন্যরা ব্যর্থ। কাজেই পরিস্থিতির চাপ ছিল। এত সব চাপ নিয়ে তার যা যা করার ছিল, সবটুকুই তিনি অসাধারণভাবে করেছেন। এখানে অবশ্যই তাকে স্যালুট।

আমি জানি না, তার টেস্ট ক্যারিয়ার সামনে আবার কোন পথে যাবে, কোচ-ম্যানেজমেন্ট ভরসা রাখতে পারবে কিনা বা তাকে লাল বলের চুক্তিতে ফেরানো হবে কিনা। কিন্তু তাঁকে যে চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়েছিল, সেখানে তিনি আপাতত জয়ী।

এবং তাসকিন  – তাসকিনের ব্যাটিংয়ে সবচেয়ে যেটা ভালো লেগেছে, টিপিক্যাল লোয়ার অর্ডার ফিফটি এটা নয়। প্রায় জেনুইন ব্যাটসম্যানের মতোই ব্যাট করেছেন। অফ সাইডে কয়েকটি ড্রাইভ খেলেছেন, যা স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানরা খেললেও তৃপ্তি পাওয়ার কথা। তার সার্বিক ক্রিকেট ও মানসিকতায় যে উন্নতি, সেটির আরেকটি ছাপ এই ইনিংস। ব্যাটিং নিয়ে তিনি খেটে চলেছেন। এই ইনিংসটায় আত্মবিশ্বাস বাড়বে তার প্রবলভাবে।

অতি জরুরি কথা – মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরিতে আট ব্যাটসম্যান খেলানোর সিদ্ধান্ত জায়েজ হয় না। বরং দলের দীনতা আরও প্রবলভাবে ফুটে ওঠে এতে। প্রথমত, ওপরের দিকের ব্যাটসম্যানদের নিয়ে দলের ম্যানেজমেন্ট (কোচ-অধিনায়ক ও অন্যরা) এতটাই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে যে, আট নম্বরেও স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান লাগে। দ্বিতীয়ত, সেই নিরাপত্তাহীনতা কেন, তা প্রমাণ করে দেন ব্যাটসম্যানরা। ১৩২ রানেই ৬ উইকেট থাকে না!

সব মিলিয়ে সামর্থ্যের দৈন্য, ভাবনার দৈন্য, ব্যবস্থাপনার দৈন্য এবং সামগ্রিকভাবে টেস্ট সংস্কৃতির দৈন্য। খেলাধুলার ব্যর্থতায় আমি কখনও লজ্জা শব্দ ব্যবহার করতে চাই না (ফিক্সিং বা এরকম করলে অন্য কথা)। কিন্তু এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও ব্যর্থতার ভয় থেকে যদি আট নম্বরে ব্যাটসম্যান রাখতে হয়, তাহলে এটা ওপরের সব ব্যাটসম্যান, ম্যানেজমেন্ট, সবার জন্য লজ্জার।

(প্রক্রিয়ার প্রসঙ্গে আরেকটু, এই টেস্টে তিন পেসার না খেলানো যেমন ভয়ঙ্কর বাজে সিদ্ধান্ত, আরও বাজে সিদ্ধান্ত আবু জায়েদ চৌধুরি রাহিকে না খেলানো)

– ফেসবুক থেকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link