বিশ্বকাপ শুরুর আগে যদি বলা হত, টুর্নামেন্টের সেরা চারটি দলের একটি হবে মরক্কো তাহলে হয়ত হেসে ওঠার লোকের সংখ্যাই হত বেশি। ক্রোয়েশিয়া, বেলজিয়ামের সঙ্গে একই গ্রুপে থাকায় দলটির শেষ ষোলোর টিকিট নিয়েই সংশয় ছিল দর্শকদের মাঝে। অথচ সেই দলটিই এখন জায়গা করে নিয়েছে সেমিফাইনালে। অসম্ভবকে সম্ভব করেছে এক দল মরক্কান অভিযাত্রী।
রাইটব্যাক আশরাফ হাকিমি, রাইট উইঙ্গার হাকিম জিয়েচ, মিডফিল্ডার সোফিয়ান আমরাবাট এবং দুর্ভেদ্য প্রাচীয় হয়ে ওঠা গোলরক্ষক ইয়াসিন বোনো, অকুতোভয় মরক্কোর প্রথম সারির নায়ক। তবে এরা ছাড়াও আছেন কয়েকজন আনসাং হিরো যারা লড়াই করেছেন মরক্কোর সাফল্যের জন্য। এমনই একজন বায়ার্ন মিউনিখের লেফটব্যাক নৌসের মাজরাউই, যার ট্যাকনিক্যাল এবং ভার্সেটাইল স্কিল তাকে মরক্কোর স্কোয়াডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় করে তুলেছিল।
যদিও তরুণ এই ফুটবলারের সেবা পুরোপুরি পায়নি মরক্কো। অনাকাঙ্ক্ষিত ইনজুরি পেছনে ঠেলে দিয়েছে মাজরাউইকে; শেষ ষোলোতে স্পেনের বিপক্ষে খেলার সময় কোমরে আঘাত পান তিনি। ৮২ মিনিটের মাথায় ছাড়তে হয় মাঠে; বিশ্বকাপে আর খেলতে পারবেন কি না সেটি এখনও নিশ্চিত হওয়া যায় নি। তবে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের প্রতিভার সবটুকু দেখিয়েছেন এই মরক্কান তারকা; তাই মরক্কোর অবিশ্বাস্য সাফল্যে মাজরাউইয়ের অবদান কোন অংশে কম নয়।
নৌসের মাজরাউইয়ের বাবা-মা মরক্কোর নাগরিক হলেও তাঁর জন্ম হয়েছে নেদারল্যান্ডসের লেইডারড্রপ শহরে। ফুটবলের দেশ নেদারল্যান্ডসে বড় হওয়া মাজরাউইয়ের হৃদয়ে ফুটবল প্রেম জন্ম নিতেও সময় লাগেনি; তবে ইয়োহান ক্রুইফ কিংবা ক্লুইভার্ট নয়, শৈশবে জিনেদিন জিদানকে আদর্শ মেনেই ফুটবলের বিদ্যা আহরণ শুরু করেছিলেন তিনি।
দুই তিনটি স্থানীয় একাডেমিতে খেলার পরেই বিখ্যাত ডাচ ক্লাব আয়াক্সের বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ পান নৌসের মাজরাউই। তবে অন্য অনেক খেলোয়াড়ের মত পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যাননি তিনি, মাঠের মত বিদ্যালয়েও ছিলেন সেরাদের একজন। ইংরেজি এবং জার্মান ভাষায় দক্ষ ছিলেন মাজরাউই, স্বপ্ন দেখেছিলেন বড় আইনজীবী হওয়ার। সতেরো বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তিও হয়েছিলেন এই উদীয়মান ফুটবলার।
অধিকাংশ উদীয়মান ফুটবলারের মতই নৌসের মাজরাউইয়ের জীবনেও এসেছিল মাঠের বাইরে থাকার বিরক্তিকর সময়। ম্যাচের পর ম্যাচ কোন সুযোগ পাওয়া ছাড়াই বেঞ্চে বসে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। একটা সময় হতাশা গ্রাস করে মরক্কান তরুণকে, সিদ্ধান্ত নেন ফুটবল ছেড়ে পড়াশোনায় পুরোপুরি মনোযোগী হওয়ার। তবে আয়াক্স যুব দলের কোচ মাইকেল কাইজারের অনুপ্রেরণায় ফুটবলের সাথেই থাকেন তিনি।
প্রত্যাশিত শুরু না হলেও আয়াক্সের সাবেক কোচ এরিক টেন হ্যাগের অধীনে মূল দলে সুযোগ পান নৌসের মাজরাউই। ২০১৮ সালে ফুটবল ক্যারিয়ারের সূচনা ঘটে তাঁর। অভিষেক মৌসুমে আটটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তিনি। ২০২২ সালে ডাচ ক্লাবটি ছাড়ার আগ পর্যন্ত ১৩৭টি ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন এই ফুলব্যাক; এসময় ১০টি গোলও করেছিলেন তিনি।
এরপরই জার্মান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাভারিয়ানদের শিবিরে যোগ দেন নৌসের মাজরাউই। দলটির সিইও অলিভার কান এর মনে করেন মাজরাউই তাদের ক্লাবের নেক্সট বিগ থিঙ।
সময়ের অন্যতম প্রতিভাবান প্লে মেকার হাকিম জিয়েচের সঙ্গে নৌসের মাজরাউইয়ের বন্ধুত্ব চমৎকার। আয়াক্সে থাকাকালীন নানাভাবে জিয়েচ তাঁকে সাহায্য করেছিলেন বলে জানান মাজরাউই নিজেই।মরক্কো এখন অপেক্ষায় ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে নামার, আর নৌসের মাজরুইয়ের অপেক্ষা মাঠে ফেরার। অবশ্য মাঠে থাকেন কিংবা নাই থাকেন অ্যাটলাস লায়ন্সদের হয়ে আরও অনেক দূর যেতে নিশ্চয়ই উদগ্রীব হয়ে আছেন এই তরুণ তুর্কি।