একটি তারার জন্ম

খেলা শুরু থেকেই আক্রমণ প্রতি-আক্রমণে জমে উঠেছিল। জার্মান অধিনায়ক ক্লিন্সমানের নেতৃত্বে কুন্টজ, হাসলার রা যেমন বারবার আক্রমণ হানতে থাকলো চেক গোলমুখে, তেমনি চেক রাইট উইং দিয়ে পোবোরস্কি একাই ফালা ফালা করে দিতে লাগলো জার্মান রক্ষণ।

১৯৯৬ ইউরোর ফাইনাল ম্যাচ। লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে জার্মানির মুখোমুখি চেক প্রজাতন্ত্র। ধারে ভারে তারকাখচিত জার্মানি অনেকটাই এগিয়ে হলেও, চেকদেরও অবহেলা করা যায় না। একের পর এক অঘটন ঘটিয়ে তারাও উঠে এসেছে ইউরো ফাইনালে।

গ্রুপ লিগের প্রথম ম্যাচেই এই জার্মানির কাছে ২-০ গোলে হারার পর থেকে যেন ঘুরে দাঁড়িয়েছে চেক ফুটবলাররা। মালদিনি , ডেল পিয়েরোদের হারিয়ে শক্তিশালী ইতালিকে বাড়ি ফেরার টিকিট ধরিয়েছে গ্রূপ পর্যায় থেকেই। এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে ফিগো , রুই কোস্তাদের পর্তুগালকে আর সেমী ফাইনালে জিদান , থুঁর দের ফ্রান্সকে হারিয়ে যারা ফাইনালে উঠে আসে, তাদের সমীহ না করার উপায় নেই।

নেদভেদ , পোবোরস্কিদের মতো তরুণ প্রতিভাও নিজেদের জাত চেনাচ্ছে প্রতি ম্যাচেই। অন্যদিকে জার্মানিও সেমী ফাইনালে আয়োজক ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে হারিয়ে ছিল মনোবলের শিখরে। তাই এক ইঞ্চি জমিও যে কোনো দল কাউকে ছাড়বে না সেটা ছিল পরিষ্কার।

খেলা শুরু থেকেই আক্রমণ প্রতি-আক্রমণে জমে উঠেছিল। জার্মান অধিনায়ক ক্লিন্সমানের নেতৃত্বে কুন্টজ, হাসলার রা যেমন বারবার আক্রমণ হানতে থাকলো চেক গোলমুখে, তেমনি চেক রাইট উইং দিয়ে পোবোরস্কি একাই ফালা ফালা করে দিতে লাগলো জার্মান রক্ষণ।

প্রথমার্ধে গোলের মুখ খুলতে পারলোনা কোনো দলই।কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই প্রবল গতিতে জার্মান পেনাল্টি বক্সে ঢুকে আসেন আবারো সেই পোবোরস্কি। গতিতে পরাস্ত হয়ে অবৈধ ট্যাকেল করে ফেলে দিতে বাধ্য হন জার্মান ডিফেন্ডার ম্যাথিয়াস সামার। পেনাল্টি থেকে গোল করতে ভুল করেন নি চেক মিডিও প্যাট্রিক বার্গার।খেলার ৫৯ তম মিনিটেই এক গোলে এগিয়ে যায় চেক।

এরপর রক্ষণের ঝাঁপ ফেলে দেয় তাঁরা। মরিয়া জার্মানরাও একের পর এক আক্রমণের ঢেউ তোলে কিন্তু সবই প্রতিহত হতে থাকে চেক রক্ষণে গিয়ে। ৬৯ তম মিনিটে গোল পেতে মরিয়া জার্মান কোচ বার্তি ভোটস মিডফিল্ডার মারমিট শোলের পরিবর্তে অতিরিক্ত স্ট্রাইকার হিসাবে মাঠে নামান তাকে। এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাকে নামানোয় অনেকেরই ভ্রু কুঁচকে দিয়েছিলো তখন।

অভিজ্ঞ স্ট্রাইকার দিয়েতার এলিটস বা তরুণ প্রতিভা ফ্রেডি বোবিকের পরিবর্তে কোচ যাকে নামালেন , সেই ২৮ বছর বয়স্ক স্ট্রাইকারটি তো দেশের হয়ে খেলেছেন মাত্র ৫ টি ম্যাচ। প্রদর্শনী ম্যাচে গোল করলেও , প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে তেমন সাফল্য কোথায় ? দেশের প্রথম সারির ক্লাবে মানাতে না পেরে পারি দিয়েছিলেন ইতালির মাঝারি মানের ক্লাব দল উদিনেসিতে। এই ইউরোরি গ্রূপ পর্যায়ে এই চেকের বিরুদ্ধেই মিনিট দশেক আর রাশিয়ার বিরুদ্ধে মিনিট আশি মাঠে থেকেও কোনো ছাপ ফেলতে ব্যর্থ। অনেকেই কোচের এই সিদ্ধান্তের মুণ্ডপাত করতে লাগলেন।

খেলার বয়স যখন ৭৩ মিনিট, জার্মানি ফ্রি কিক পায় চেক পেনাল্টি বক্সের কিছুটা বাইরে। ক্রিশ্চিন জিঘের ভাসানো ফ্রি কিক , সবার অলক্ষ্যে ছুটে এসে নিখুঁত হেডে গোলে জড়িয়ে দেন আর কেউ নয়, সেই বদলি স্ট্রাইকার ,মাত্র চার মিনিট আগে যিনি মাঠে পা রেখেছিলেন। সমতা ফেরায় জার্মানি। এরপর নির্ধারিত সময়ে আর কোনো গোল না হলে , খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।

অতিরিক্ত সময়ের পাঁচ মিনিটেই , চেক পেনাল্টি বক্সে ক্লিন্সমানের থেকে আবার বল পান তিনি। চেক ডিফেন্ডার ক্যাডলেককে রীতিমতো ঘাড়ে নিয়েই চকিতে ব্যাক টার্ন করে জোরালো শট রাখেন গোলে।চেক গোলকিপার কৌবাকে হতচকিত করে , তার হাত ফস্কে বল ঢুকে যায় গোলে। সোনালী গোলের নিয়মে ১৯৯৬ ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় জার্মানি আর রাতারাতি তারকা হয়ে ওঠেন সেই অনামী স্ট্রাইকার।

এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। দেশের হয়ে খেলেছেন ৭০ টি ম্যাচ। গোল করেছেন ৩৭ টি। যে কোনো জার্মান ফুটবলারদের মধ্যে দ্রুততম হ্যাট্রিকের মালিকও তিনি। ১৯৯৭ সালে উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জনের ম্যাচে মাত্র ৭ মিনিটের মধ্যে তিনটি গোল করে এই কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে জার্মানির আক্রমণভাগের প্রধান অস্ত্রও ছিলেন তিনিই।

সেই বিশ্বকাপে তিনটি গোলও করেন তিনি। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের পর অধিনায়ক ক্লিন্সম্যান অবসর নিলে, অভিষেকের মাত্র ২ বছরের মধ্যেই জার্মান জাতীয় দলের অধিনায়কের আর্মব্যান্ড ওঠে তার হাতে। ক্লাব স্তরেও দীর্ঘ্যদিন খেলেন এ সি মিলানের মতো প্রথম সারির ক্লাবে। ছিলেন তাদের প্রধান গোলমেশিন।২০০২ বিশ্বকাপেও ৩৪ বছর বয়সে মাঠে নেমে গোল করেছেন সৌদি আরবের বিরুদ্ধে।

সেই ইউরো ফাইনালে যদি তিনি আর বাকি সব ইউরো ম্যাচের মতোই রিসার্ভ বেঞ্চে বসেই কাটিয়ে দিতেন , হয়তো ২৮ বছর বয়সে আর ফিরে আসতে পারতেন না আন্তর্জাতিক আঙিনায়। একটি ম্যাচেই বদলে গেলো প্রায় শেষ হতে চলা সেই ফুটবলারের ভাগ্য।জন্ম হল এক নতুন তারকার। আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছিলেন জার্মানির গোলমেশিন। তাই অনেক দেরিতে আন্তর্জাতিক অভিষেক করেও, জার্মানির সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতাদের মধ্যে দশম স্থানে এখনো উজ্জ্বল তার নাম – অলিভার বিয়েরহফ।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...