১৯৪৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর। অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি ভারত। বোলার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন উইকেট তুলে নিতে। নন স্ট্রাইক প্রান্তে তখন বিল ব্রাউন। বোলার বারণ করা সত্ত্বেও বারবার পপিং ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। একপর্যায়ে ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে বোলার বোলার ভেঙে দিলেন নন স্ট্রাইক প্রান্তের স্ট্যাম্প।
আউটের আবেদন করতেই আঙুল তুলে দিলেন আম্পায়ার। সবাই হতভম্ভ হলেও ক্রিকেটীয় আইন যে এটাই বলে। কিন্তু হইহই রব এলো চারদিক থেকে, ক্রিকেটীয় চেতনা লঙ্ঘন বলে কথা। কিন্তু বোলার পাশে পেলেন একজনকে, তিনি স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান।
তাঁর ভাষায়, ‘এতে ক্রিকেটীয় স্পিরিটের কোনো লঙ্ঘন হচ্ছে না। রুলবুকেই তো স্পষ্ট বলে দেয়া আছে সে কথা।’ সাহসী সেই বোলারের নাম ভিনু মানকড়, বিতর্কের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে যার অলরাউন্ডার পরিচয়।
১৯১৭ সালে ভিনু মানকড়ের জন্ম জামনগরে। এই জামনগরেই জন্মেছিলেন রণজিৎসিংজি, দিলীপসিংজির মতো ক্রিকেটার। তাদের আদর্শ মেনেই বড় হয়েছেন ভিনু মানকড়। ছোটবেলার নাম মিনু হলেও কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সে নাম, বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন ভিনু মানকড় নামেই।
শুরুতে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি মিডিয়াম পেস বোলিং করতেন ভিনু। পরের সাসেক্সের বিখ্যাত ক্রিকেট কোচ অ্যালবার্ট ওয়েন্সলি তাকে পরামর্শ দেন বাঁহাতি স্পিন করার। গুরুর পরামর্শ শিরোধার্য মেনে বনে যান পুরোদস্তুর বাঁহাতি স্পিনার। সাথে ব্যাটিংয়ে স্বভাবজাত প্রতিভা তো ছিলই।
১৯৩৭ -৩৮ মৌসুমে লর্ড টেনিসনের নেতৃত্বে ভারতে খেলতে আসেন এডরিচ, গোভার, পোপ, পার্কস, ল্যাংরিজদের মতো ক্রিকেটার। আন্তর্জাতিক ম্যাচের স্বাকৃতি না পেলেও সে দলটা যে গুণে মানে কোনো অংশে কম ছিল সে কথার প্রমাণ পাওয়া গেছে ক্রিকেট লিখিয়েদের নানা কথায়।
পাঁচ ম্যাচ সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে সুযোগ পান মানকড়। অভিষেকে আলাদা করে নিজেকে চেনাতে না পারলেও পুরো সিরিজজুড়ে হয়ে রইলেন দলের মধ্যমণি হয়ে। এক সেঞ্চুরি এবং দুই ফিফটিতে ৬২.২৩ গড়ে রান করার পাশাপাশি বল হাতে নেন ১৫ উইকেট। যদিও ভারত সিরিজ হেরে যায় ৩-২ ব্যবধানে। সিরিজ শেষে লর্ড টেনিসন বলেছিলেন বিশ্বের যেকোনো দলে সহজেই জায়গা করেন নেবেন ভিনু।
দারুণ শুরুর পর ক্যারিয়ারের আরো আগানোর ইচ্ছা ছিল ভিনুর। আরো আলো ছড়াবেন, কিংবদন্তিদের তালিকায় তার নামও উচ্চারিত হবে এমনটাই ছিল ইচ্ছে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক, শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পুরো বিশ্বের মতো স্থবির হয়ে পড়ে ভিনুর ক্রিকেটজীবনও।
অবশেষে আট বছরের বিশাল ব্যবধান শেষে ১৯৪৬ সালে ইফতেখার আলী খান পতৌদির নেতৃত্বে ইংল্যান্ডগামী ভারত দলে জায়গা করে নেন তিনি। ততদিনে বয়স হয়ে গেছে ২৯, পেছনে ফেলে এসেছেন ক্যারিয়ারের স্বর্ণালি সময়। বয়সের কারণে সেই সিরিজে ব্যাট হাতে নৈপুণ্য দেখাতে না পারলেও বল হাতে নেন ১১ উইকেট।
এরপর ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরের দলেও জায়গা করে নেন তিনি। বিজয় মার্চেন্ট, মুস্তাক আলিরা সেবার দলের সাথে না যাওয়ায় ওপেনিংয়ে লিন্ডওয়াল-ম্যাককুলদের সামলানোর দায়িত্ব নিতে হয় তাকেই। সেই সিরিজের পঞ্চম টেস্টেই ঘটে সেই বিখ্যাত মানকাডিংয়ের ঘটনা। সেই ম্যাচেও ব্যাট হাতেও আলো ছড়ান তিনি, খেলেন ১১১ রানের চোখধাঁধানো এক ইনিংস। সেই সিরিজে ৩০৬ রানের পাশাপাশি নেন ১১ উইকেট। দুর্বল ভারতীয় দল সেবার হেরেছিল সবগুলো ম্যাচেই।
তবে মানকড়ের সেরা ইনিংস ১৯৫২ সালে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডসে। প্রথম ইনিংসে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৭২ রান করার পাশাপাশি ৭৩ ওভার বল করে নেন পাঁচ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে আরো বিধ্বংসী রূপে মানকড়, খেলেন ১৮৪ রানের অনবদ্য এক ইনিংস।
মানকড় ছিলেন প্রথম ক্রিকেটার যিনি ত্রিশোর্ধ বয়সে এক ম্যাচে সেঞ্চুরি এবং পাঁচ উইকেট নেন। ১৯৫৬ সালে পঙ্কজ রায়ের সাথে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪১৩ রানের ওপেনিং জুটি গড়েন তিনি। যে রেকর্ড টিকে ছিল ৫৭ বছর। তিনি নিজে খেলেছিলেন ২৩১ রানের ইনিংস।
১৯৫৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ক্যারিয়ারের ইতি টানেন তিনি। ৪৪ টেস্টে দুই হাজারের অধিক রানের পাশাপাশি বাঁ হাতের ভেলকিতে ব্যাটসম্যানদের সাজঘরে ফেরত পাঠিয়েছেন ১৬২ বার। ইনিংসে পাঁচ উইকেট পেয়েছেন আটবার।
ভিনু মানকড়ের কথা স্মরণ করলে ক্রিকেটবোদ্ধারা খানিকটা বাঁকা চোখে তাকান। ক্রিকেটীয় চেতনা ভেঙেছেন, নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন তোলেন। অথচ তিনি যা করেছিলেন সবটাই নিয়মের মাঝে থেকেই, ভুলে যায় অলরাউন্ডার হিসেবে তার নৈপুণ্যের কথা। ভারতীয় ক্রিকেটের সেই শুরুর সময়টাতে ভারতের ব্যাটিং-বোলিং দুই বিভাগের নেতৃত্ব দিয়েছেন অসমসাহসী ভিনু মানকড়।