১৯৯২। ইডেনে প্রথম টেস্টের আগে দুটো ঘটনা ঘটে গেছে। দুটোই আমার তদানীন্তন প্রিয়তম ব্যাটসম্যানের সঙ্গে। এক, অস্ট্রেলিয়া, বিশ্বকাপ, দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে একজনের অধিনায়কত্ব যেতে যেতে বেঁচে গেছে। তিনি মহম্মদ আজহারউদ্দিন।
আর, দ্বিতীয় লোকটাকে নিয়েই এই গল্পটা। ইডেনের টেস্ট শুরুর জাস্ট আগের দিন। প্রাক্তন টেস্ট আম্পায়ার সমর রায় আমার বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। ইনফ্যাক্ট, আমি কলকাতা ময়দানে প্রথম খেলি ওঁরই ক্লাব ফ্রেন্ডস এসিতে। ওঁর সঙ্গে ইডেনের সিএবি ক্লাবহাউসে গিয়ে দোতলায় বসে আছি। তখন ক্লাবহাউসের ভিতরের নির্মাণটা অন্যরকম ছিল। এখন যেখানে কোশাধ্যক্ষের অফিস, সেখানটা খালি লাউঞ্জ ছিল।
তার ডানদিকে বেশ কিছুটা দূরে জগমোহন ডালমিয়ার অফিস। এখন অভিষেক বসেন সেখানে। সে আলাদা প্রসঙ্গ। আমি সেই লাউঞ্জে সোফায় বসে আছি। দু-পকেটে দুই অটোগ্রাফ বুক। একটা আমার আর একটা আমারই এক বোনের। এসেছিলাম ইংল্যান্ড-ইন্ডিয়ার প্র্যাকটিসে। যদি অটোগ্রাফ পাওয়া যায়। তা এসে শুনি প্র্যাকটিস শেষ করে দু-দলই চলে গেছে।
বসে আছি মনমরা হয়ে, এমন সময় উঠে এলেন দ্বিতীয় মানুষটি। আমার স্বপ্নের রাখাল। প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, সজ্ঞানে দু-তিনটে কথা বলছি। হাফপ্যান্ট পরা বয়সেই আমি ইমরান, আকরাম, মিয়াঁদাদ, লিলি, মার্শাল, লয়েড, গাভাসকার, কপিলদেব, বেঙ্গসরকার, আজহারউদ্দিনকে দেখেছি। এমআরএফ ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাপের ফাইনালে হারার পর ক্রিকেটপ্রেমী অ্যাডভেঞ্চারারদের আইডল ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে করমর্দন করেছি।
ক্রিকেট মাঠের তন্ত্রসাধকের পরনে তখন কেবলমাত্র তোয়ালে। তা-ও ততটা বিস্ময়াবিষ্ট হইনি, যতটা এখন হলাম। জাস্ট কেঁপে গেলাম। সোনালি চুল, হালকা হয়ে এসেছে, নীল চোখ, অলিভ সবুজ টিশার্ট আর একটা খাকি প্যান্ট পরে সিএবি ক্লাবহাউসের দোতলায় আমার সামনে উঠে এলেন আমার স্বপ্নের ব্যাটসম্যান ডেভিড আইভন গাওয়ার।
বান্ধবীকে ‘আই লাভ ইউ’ বলতে, চার বছর বয়সে কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে ‘বীরপুরুষ’ আবৃত্তি করতে গিয়ে, পার্শ্ববর্তিনীকে ‘উইল ইউ ওয়ক দ্য রেস্ট অব দ্য রোড উইথ মি?’ জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে কাঁপিনি। কিন্তু সেদিন সত্যিই কেঁপে গিয়েছিলাম। কেন কে জানে! অটোগ্রাফটা হয়েছিল। প্যান্টের পকেটে পেন ঢুকিয়েছিলাম ঢাকা ছাড়া, বাড়ি এসেছিলাম দাগ নিয়ে। বোনের দেওয়া খাতাটা পকেটেই থেকে গিয়েছিল। খালি বুক ভরে ছিল এক অনাবিল আনন্দে।
কেন? এই কথাটা আমাকে এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করেছিল। সে কবিতা বুঝত না। শার্লক হোমস যখন মরিয়র্টির সঙ্গে দুহাত বুঝে নিচ্ছে, তাতে তার রোমাঞ্চ জাগত; কিন্তু একা রাতে যখন ঘর অন্ধকার করে ২২১বি বেকার স্ট্রিটে বেহালার করুণ সুরে আগুন নেভাচ্ছে, সেটাতে বুকের মধ্যে আগুন ধরত না তার। সে জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন গাওয়ার! কেন বর্ডার নয়! বর্ডার তো দশ হাজার পেরিয়ে এগারো। আর গাওয়ার তো আটেই আটকে গেল। জীবন বাজি রাখতে গেলে তো বর্ডার। গাওয়ার সেখানে হেলায় উইকেট ছুড়ে দিয়ে চলে আসবেন। তাহলে কেন গাওয়ার, বর্ডার নয় কেন?
আহা! অপাপবিদ্ধ বন্ধু আমার! সমুদ্রের জল আর পুকুরের জলের ফারাক জানত না সে। দু-ফোঁটা বার্গেন্ডি আর দু-ফোঁটা ম্যাজেন্টা দিয়ে পাঁজর রাঙায়নি সে। কেন ডেভিড গাওয়ার?
ছ-ফুটের মানুষটা হালকা ঠোঁট বেঁকিয়ে ব্যাটটা বগলে নিয়ে একটু ঝুঁকে দুলে দুলে ক্রিজে এসে দাঁড়াল। ব্যাটটা মাটিতে ঠুকে আলগোছে তুলে নিল, যেন উস্তাদ আমজাদ খানের হাতে সরোদের ‘পিক’। ডানহাতটা হ্যান্ডেলের উপরের দিকে, বাঁ-হাতটা বড়োই অবহেলায় তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের বেড়ে ছুঁয়ে আছে ব্যাটের হ্যান্ডেলের আর-একটু নিচে। মাটি থেকে দেড় ফিট উপরে ব্যাটটা দুলছে যেন গ্রীষ্মের দুপুরে খেজুরের পাতা।
শব্দ শোনা যায় না, তবু অস্তিত্ব টের পাইয়ে দেয়। ডান পা-টা বাঁ পায়ের থেকে ঈষৎ বেশি সোজা। ডান হাতের বাহুবন্ধ থেকে কনুই আলগোছে পাঁজর ছাড়া। বোলার অফস্টাম্পের এক ফুট বাইরে ফেলল গুডলেন্থ, পা গেল অফ স্টাম্পের লাইনে। মাথা গেল বলের উপর, তারপর খুকু ঘুমোলে যেমন বাবা এসে আলগোছে স্নেহের সঙ্গে মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দেন, ব্যাটটাও বলের গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। আর বলটাও মহানন্দে মাটি কামড়ে বাউন্ডারির দড়ি ছুঁয়ে টুক করে লাফিয়ে নিল আপন মনে।
অথবা পাঁজর লক্ষ্য করে ধেয়ে আসা শর্ট অব লেন্থ বল। ব্যাটটা আর-একটু তুলে বাঁ পায়ের উপর সারা শরীরটা ঘুরে গেল। ডান পা-টা তখনও ছুঁয়ে আছে পপিং ক্রিজ। বল নিজেই চলে গেছে বিলবোর্ডসে ধাক্কা খেতে।
এর কাছে কোথায় দাঁড়ায় শক্ত করে ধরে থাকা ব্যাট, ব্যাট বলে ঠোকাঠুকি, যেন কামারের ঘা, মজুরের মেহনত। কবিতা তো তারাও লিখতে পারে। খনি শ্রমিকদের কি কবিতা হয় না? হয়, কিন্তু তাতে পালকের প্রেম থাকে না। থাকে না মেঘের উপর দিয়ে ভেসে যাওয়ার আভাস।
ক্রিকেট, রান, জেতা, হারা, লড়াই, প্রতিঘাত, খেটে খাওয়া এসব বড়োই নশ্বর জীবন, হে বন্ধু! ডেভিড গাওয়ার সেসবের জন্য জন্মাননি। তাঁর ব্যাটিং ওয়র্ডসওয়র্থের কবিতা:
“The waves beside them danced, but they
Out-did the sparkling waves in glee:
A poet could not be but gay,
In such a jocund company:
I gazed’and gazed’but little thought
What wealth the show to me had brought”
তা বলে কি ডেভিড গাওয়ারের লড়াই নেই? ছিল না? নাকি তার মধ্যেই প্রতিঘাতস্পৃহা দানা বাঁধেনি? জেমস হুইটেকার বলছেন, এক কাউন্টি ম্যাচে তদানীন্তন দ্রুততম বোলার প্যাট্রিক প্যাটারসন বল করছিলেন, পরপর তিন বলে গাওয়ার বিট হয়েছেন। দুবার তার মধ্যে অফ স্টাম্পের বাইরে কভার ড্রাইভ করতে গিয়ে, আর-একবার ছোবল মারা বাউন্সারে ব্যাট কোনোরকমে সরিয়ে। হুইটেকার গিয়ে গাওয়ারকে স্বভাবসিদ্ধ ব্রিটিশ সিরিয়াসনেসে সতর্ক করলেন, ‘চ্যারিটি ম্যাচ খেলতে আসিনি আমরা। ঠিক করে খেলো।’তারপরের ওভারের প্রথম, তৃতীয়, চতুর্থ আর শেষ বল মাঠের বাইরে, দুটো পুল, একটা হেলায় মারা ফ্লিক আর একটা রাজসিক কভার ড্রাইভ। ডান হাতে ব্যাটটা ঝুলিয়ে হুইটেকারকে এসে জিজ্ঞাসা করলেন গাওয়ার, ‘এবারে ঠিক ছিল কি? নাকি এখনও হয়নি!’
অ্যাডিলেডে টাইগার মথ বিমানে খেলা চলাকালীন আকাশে চক্কর দেওয়াই হোক বা লাঞ্চের আগের শেষ বলে ক্যাজুয়ালি লেগ স্লিপের হাতে জমা পড়াই হোক। গাওয়ারের দিকে সিরিয়াস ইংলিশ ক্রিকেট অভিযোগের আঙুল তুলল যে ডেভিড ক্রিকেটের প্রতি নিবেদিত প্রাণ নন। ১৯৮৭-র বিশ্বকাপ খেলতে অস্বীকার করেন স্রেফ সাত বছর ধরে প্রতি শীতকালে বিদেশে থাকছিলেন বলে।
৮৫-র অ্যাসেজে ডবল সেঞ্চুরি বা ওভালে ১৫৭-র থেকেও ব্রিটিশরা মনে রেখেছে ৮৯-তে প্রেস কনফারেন্স ছেড়ে নাটক দেখতে যাওয়া আছে বলে বেরিয়ে যাওয়া। আসলে একশ নব্বই বছরের গোলামি পেরিয়ে ভালো লাগার মাত্র দুজন ইংলিশ খেলোয়াড় খুঁজে পেয়েছিলাম। ডেভিড গাওয়ার এবং গ্যারি লিনেকার। কতবার যে গাওয়ারের মতো ক্যাজুয়ালি কভার ড্রাইভ মারার চেষ্টা করেছি। শ্যাডো প্র্যাকটিসে, পথ চলতে চলতে অথবা পণ্ডিত রবিশঙ্করের সেতারের মূর্ছনা শুনতে শুনতে। নশ্বর মানুষ, দশের মধ্যে এগারোবারই বল ব্যাটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেত, আর যে দুবার ব্যাটে লাগত সেটা কানায়, মাঝবরাবর নয়।
আসলে কিছু কিছু মানুষ রাস্তার মাঝবরাবর দৃপ্তভাবে হেঁটে যাওয়ার থেকে গাছের গোড়ায় বসে দু-দণ্ড জিরিয়ে চুপ করে মঞ্চ ছেড়ে চলে যাওয়াকেই জীবনের পরম পাওয়া মনে করে। হাজার হোক, ড্যাফোডিল আর অ্যাস্টারের পার্থক্য তো জানা গেল, অথবা সূর্যের আলো পড়লে ফড়িং-এর পাখায় রামধনুর খেলা করা তো জেনেছে সে।
অথচ আলাভোলা নন তিনি, ধারাভাষ্যের বক্সে ক্ষুরধার বুদ্ধি তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং ড্রাই হিউমার বারবার বোকাবাক্স পেরিয়ে ধরা পড়েছে আমাদের কাছে। তবে? তবে এভাবেই হয়তো কবিতা লেখা হয়! এভাবে ভ্যান গখ ছবি আঁকেন। এভাবেই সুবর্ণরেখার বালুর উপর দিয়ে জ্যোৎস্নারাতে শক্তি চট্টোপাধ্যায় বনে পাঠান আর সবাইকে।
ডেভিড গাওয়ার, রংবাজি নয়, বাঁশি হাতে রংধনু সুর তোলা এক চালচুলোহীন রাখাল। আমার বাড়িতে এখনও ছবিটা আছে, বিরাশির ভারত সফরে গ্যাটিং, অ্যালট আর বথাম গাওয়ারের টিশার্টের একটা ফুটোয় আঙুল ঢুকিয়ে টান মেরে ফড়ফড়িয়ে ছিঁড়ে দিয়েছেন। স্রেফ মজা করার জন্য। আর ভ্রূক্ষেপহীন গাওয়ার সেই টিশার্টের কলারটা খালি মালার মতো গলায় জড়িয়ে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে সেই ঈষৎ বাঁকা মিষ্টি হাসিটা। যে হাসিটা দিয়ে তিনি কাদির থেকে কুম্বলে, মার্শাল থেকে ম্যাকডারমট সকলকেই বাঁশির সুরে পাথর বানিয়ে দিতেন।
ব্যাট হেলমেট, প্যাড গ্লাভস, থাইপ্যাড, অ্যাবডোমেন গার্ড, এহ বাহ্য। অদৃশ্য বাঁশিটাই এখনও উইজডেনের ক্রিকেট মিউজিয়মে রাখা আছে কোথাও। হৃদয়তন্ত্রে এখনও মাঝে মাঝে ঝংকার তোলে ওই বাঁশিটাই। ডেভিড আইভন গাওয়ারের বাঁশি, নাকি হ্যামলিনের সেই পথভোলা লোকটার বাঁশি সেটা!
কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক