স্টেইন ওয়াজ পেস, স্টেইন ওয়াজ লাইফ!

জীবনে যখন কোনো ব্রেক থ্রু আসবে না, তখন খুঁজে বের করুন স্টেইনের বোলিংয়ের ভিডিও। যে স্পেলগুলোতে তিনি উইকেট পাননি। ওসবই আপনাকে অনুপ্রেরণা দিবে। জানান দিবে, একটা উইকেট খুব বেশি দূরে নয়। যদি একটা পেয়ে যান, তবে আরো অনেকগুলো পাওয়ার খিদে জেগে যাবে। সেই সময়টা মোটেই সহজ ছিল না। স্টেইন তখন হয়ে যেতেন ফুটন্ত গরম ঝর্ণাধারা। যেটা মাঠে দেখাতে চাইতেন না, কিন্তু নিজেকে ধরেও রাখতে পারতেন না। লাল চেরি হাতে যা কিছু করা সম্ভব, সবই করেছেন।

অনেকগুলো কারণেই টেস্ট ক্রিকেটকে তুলনা করা হয় জীবনের সাথে। জীবনের বেশ সাদৃশ্য আছে টেস্ট ক্রিকেটের সাথে। যখন কোনোকিছুই আপনার পক্ষে থাকবে না, কিন্তু মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হয়। সবচেয়ে বড় সাদৃশ্য এটাই।

ভাবুন, সবুজ উইকেটে কোনো পেসার কিংবা বলের গ্রেট টার্নারের বিপক্ষে যখন আপনি ব্যাটসম্যান। বলের লাইনে গিয়ে খেলবেন, শরীরের কাছাকাছি ব্যাট রেখে। কিন্তু বলের মুভমেন্টের সাথে না। যদি এজ হয়, ব্যাটটা বগলদাবা করে হেঁটে চলে যেতে হবে। কিন্তু তখনই ক্যাশ ইন করবেন, যখন একটা লুজ বল পাবেন।

ধরি, আপনি ফ্ল্যাট ট্র্যাকের বোলার। ডিসিপ্লিনড থাকুন, রানের চাকা টেনে ধরুন, সুযোগের জানালা খোলার অপেক্ষায় থাকুন; ন্যাচারাল ভেরিয়েশন, ছোট্ট রিভার্স সুইং, দ্বিতীয় নতুন বল। এটা কনফার্ম করুন, আপনি ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি।

যখন ঝাঁপিয়ে পড়বেন, পুরোটা উপভোগ করুন। ঠিক জীবনের মতো। ঝড়ঝাপটাগুলো হজম করুন, পরিস্থিতিকে ব্লেম না করে নিজের কাজটা করে যান। কারণ সবকিছু আপনার নিয়ন্ত্রনে নয়। কারণ একদিন ভাগ্যের চাকা ঘুরবেই। যখন সুযোগ আসে এর সদ্ব্যবহার করা উচিত, কারণ কঠিন সময় কখনোই খুব বেশি দূরে থাকে না।

ক্রিকেটের কোন নিয়মটা সবচেয়ে বেশি নির্দয়? এমন তর্ক-বিতর্ক অনেকদিন ধরেই হয়ে আসছে। কিন্তু পরিসংখ্যানের শীতল দিকে তাকালে দেখা যায়, সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে বোলাররাই।

 

টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস বলে, প্রতি ৭০ (১১ ওভার চার বল) বলে একজন পেসার একটা করে উইকেট নিয়েছেন। টেস্টে ২০০ কিংবা এর বেশি উইকেট আছে, এমন বোলারদের দিকে তাকাই। সেখানে একেবারেই আলাদা তিনি। ৯৩ টেস্টে তার নেয়া ৪৩৯ উইকেটের প্রতিটি নিতে তার খরচ করতে হয়েছে সাত ওভার। (যেখানে অন্যান্য বোলারদের করতে হয়েছে প্রায় ১২ ওভার)।

১৪৫ কিলোমিটার গতিতে বল করা, যে কাজটা টানা করার পক্ষে আমাদের শরীর না। তবে ফাস্ট বোলারদের জন্য ব্যাপারটা অতি সাধারণ পাগলামি। ফাস্ট বোলিং মানে সেই শৈল্পিক পাগলামিতে নিজেকে একেবারে উইল করে দেয়া

এজন্যই শোয়েব আখতার বলেছেন, ‘ফাস্ট বোলিং করতে হলে আপনাকে পাগল হতে হবে।’ দুর্ধর্ষ ফাস্ট বোলাররা এই পাগলামিটা অনাদিকাল ধরেই করে আসছেন। সেই পাগলামি, ত্যাগের বিপরীতে সাফল্য যা’ই এসেছে; তা অপ্রতুল।

টেস্ট ক্রিকেট যদি জীবন হয়, সেই জীবনের চরম শিখড়ে বাস করেছেন ডেল স্টেইন। হুইস্পারিং ডেথ মাইকেল হোল্ডিং যদি ফাস্ট বোলিংয়ের রোলস রয়েস হয়ে থাকেন, তবে ডেল স্টেইন ছিলেন মাধুর্যযুক্ত এক সাপ। দুর্দান্ত গতিতে টানা আউট সুইংগার তার মতো কেউ করতে পারেননি।

অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ডের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট সিরিজ জিতেছে তার হাত ধরেই। ভারতের মাটিতে দুই টেস্ট জয়ও এসেছে তার নৈপুণ্যেই। আর নিজের দেশের মাটিতে তিনি ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

স্টেইনের হাইলাইটস; ‘লেগ স্টাম্পে পিচ করে অফ স্টাম্পে ক্লিপ করা দারুণ গতির আউটসুইংগার। ইনসুইংগারগুলোতে হুটহাট এজ, বাউন্সার এবং সেই উন্মাতাল সেলিব্রেশন’, ছিল সবচেয়ে আবেদনময়।

স্টেইন একবার বলেছিলেন, ১৮ বছর বয়সে যখন তিনি ফাস্ট বোলিং শুরু করেন, তখন তিনি রান-আপ নিতে চাইতেন ব্রেট লি’র মতো। জাম্প করতে চাইতেন অ্যালান ডোনাল্ডের মতো। শোয়েবের গতিতে বল করে, লাইন লেন্থ ঠিক রাখতে চাইতেন শন পোলকের মতো।

কেবল এই চারজনের চারটা গুণ নিয়েই থেমে যাননি স্টেইন। থেমেছেন এদের ছাপিয়ে গিয়ে অনেক দূরে গিয়ে। স্টেইন অবসর নিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার মোস্ট প্রোলিফিক বোলার হিসেবে। দুনিয়ার দ্রুততম উইকেট টেকার হিসেবে। সর্বকালের সেরাদের একজন হয়ে।

তাঁর স্পেলগুলো বাধ্য করতো তাঁকে দেখতে। প্রতিটা ওভারের আগে দেখা যেত একজোড়া উন্মাদ খুনে চোখ। শিরার স্পন্দনে টের পাওয়া যেত ফেঁটে পড়ার হুমকি। তখনই স্টেইন টেনে দিতেন চেইনসো বা স্বয়ংক্রিয় করাতটাকে!

প্রতিকূল আবহাওয়ার অপেক্ষায় থাকতেন স্টেইন। অপেক্ষায় থাকতেন এমন পিচের, যেটা পেসবান্ধব না। কারণ মরা পিচের হিসেব-নিকেশ তার চেয়ে ভালো কেউই বুঝতেন না। উইকেটের জন্য যত বেশি ঘাম ঝরাতেন, তত বেশি উন্মাতাল হতো তাঁর সেলিব্রেশন।

জীবনে যখন কোনো ব্রেক থ্রু আসবে না, তখন খুঁজে বের করুন স্টেইনের বোলিংয়ের ভিডিও। যে স্পেলগুলোতে তিনি উইকেট পাননি। ওসবই আপনাকে অনুপ্রেরণা দিবে। জানান দিবে, একটা উইকেট খুব বেশি দূরে নয়। যদি একটা পেয়ে যান, তবে আরো অনেকগুলো পাওয়ার খিদে জেগে যাবে।

সেই সময়টা মোটেই সহজ ছিল না। স্টেইন তখন হয়ে যেতেন ফুটন্ত গরম ঝর্ণাধারা। যেটা মাঠে দেখাতে চাইতেন না, কিন্তু নিজেকে ধরেও রাখতে পারতেন না। লাল চেরি হাতে যা কিছু করা সম্ভব, সবই করেছেন।

স্কিডি বাউন্সার দিয়ে ব্যাটসম্যানকে হিট করতে চেয়েছেন। ব্যাথা পেলে হিট করা জায়গায় ব্যাটসম্যানকে হাত বুলাতে দেখার অপেক্ষা করেছেন। খুনে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, শব্দযুদ্ধ, সবই করেছেন। যখন ট্র্যাক থেকে ছিটকেছেন, তখনো প্রতিপক্ষকে বুঝতে দেননি। তাদের বিশ্বাস করিয়েছেন, ‘আর দশটা দিনের মতো এটাও আমারই দিন।’

২০১৩-১৪ মৌসুমে ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে ৬৯ ওভার বল করেও কোনো উইকেট পাননি স্টেইন। কিন্তু যখনই বল রিভার্স করা শুরু করলো, তখনই খুনে অবতারে আবির্ভূত হলেন তিনি। ১২ ওভার বল করে পকেটে পুরেছিলেন ছয় উইকেট। প্রতি সাত ওভারে একটা করে উইকেট নিয়েছেন, এই স্পেলটাই তার নিট এন্ড ক্লিন স্ট্রাইক রেটের সাক্ষ্য দেয়।

এই একটা স্পেলই তার পুরো ক্যারিয়ারের গল্প বলে দেয়। যখন লড়াই করছেন, তখন অধ্যাবসায়ী, একাগ্রচিত্ত। যখন ফর্মের তুঙ্গে, তখন দুর্ধর্ষ!

স্টেইন টিকে ছিলেন টেস্ট ক্রিকেটের জন্য, ফাস্ট বোলিংয়ের জন্য। তিনি তখনো টিকে ছিলেন, যখন বাকিরা আশেপাশেও ছিল না। স্টেইনের ভাষ্য, ‘টেস্টের চতুর্থ দিন আপনি ঘুম থেকে উঠে জানতে পারলেন ক্যাপ্টেন আপনার দিকেই তাকিয়ে আছে পার্থক্য গড়ে দেয়ার জন্য। যদিও আপনার শরীর ক্লান্ত, শ্রান্ত। এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতেই পারে না।’

১২৫ টা ওয়ানডে খেলেছেন প্রোটিয়াদের হয়ে। যদিও তার অভিষেকের পর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা খেলেছে ২৮৬টি। ক্যারিয়ারের একটা লম্বা সময় ধরে স্টেইন ছিলেন, রেয়ার একদল ক্রিকেটারদের সাথে। যারা ওয়ানডের চেয়ে টেস্ট খেলেছেন বেশি। টি-টোয়েন্টি লিগের এই যুগে যেটা তার জন্য একটা ডিসঅ্যাডভান্টেজও বটে।

বেলাশেষে স্টেইন নিজেকে খুঁজে পেলেন এক দড়ি টানাটানি খেলার ময়দানে, যেখানে তার প্রতিপক্ষ হচ্ছে; সময়। পাঁচ-ছয় বছর আগে ক্রিকেট মান্থলিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্টেইন বলেছিলেন, ৩৩-৩৪ বছর বয়সে ফাস্ট বোলাররা স্লো হয়ে যায় অথবা অবসর নেয়। সেটা তাঁর কাছে ‘বুলশিট’। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘৩৮ বছর বয়সী ব্রেট লিকেও আমি ১৪৫ কিমি গতিতে বল করতে দেখেছি, যদিও সেটা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটে না।’

স্টেইন ছিলেন স্ট্রং আর ফিট। ব্রেট লি’র মতো তিনিও নিজেকে পুশ করতে চেয়েছেন। স্টেইন জানতেন, দক্ষিণ আফ্রিকাকে তারই বেশি প্রয়োজন। সেই দলটাই দেখিয়েছিল, তাঁকে ছাড়াও তাঁরা টেস্ট জিততে পারে।

জীবনের মারপ্যাঁচ বোঝা দায়। ইনজুরি হাজির হলো বাধা হয়ে। প্রতিটা ইনজুরি সারতে সময় লেগেছে অনেক। এর মধ্যে একটা, তার সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়া ট্যুরে। টিম ডক্টর জানান, এমন ইনজুরিতে আগে কেবল একজন ক্রিকেটারই পড়েছিলেন।

যখন রিহ্যাব করে ফিরলেন, তখন পড়লেন গোড়ালির ইনজুরিতে। জীবনে প্রথমবারের মতো। তার খেলা সর্বশেষ ছয় টেস্টের চারটি থেকেই মাঠ ছাড়তে হয়েছে তাকে। সেটাই ছিল সেই চতুর্থ টেস্ট। এবং সেটা তার কাছে রেজাল্ট এনে দিতে না পারার ব্যর্থতার চেয়ে বেশি কিছু।

স্টেইনের বিদায়বেলায় ক্রিকইনফোতে লিখেছেন সিদ্ধার্থ মঙ্গা -‘যদি জীবনবোধের শিক্ষা পেতে চান, তবে ডেল স্টেইনকে বল করতে দেখুন।’ জীবনবোধে পরিপূর্ণ কাব্যিক এই লেখাটার ইতি টেনেছেন এভাবে, ‘Steyn was pace. He was swing. He was spirit. He was possibility. He was bluff. He was trance. He was life.’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...