দাবাশিল্পী পল মরফি ও রোম্যান্টিক স্কুল

স্টেইনিৎজ, নিমজোউইশৎজদের মগজাস্ত্রেই দাবা শুধুমাত্র ‘এক্সচেঞ্জ’-র খেলা নয়, বরং পজিশনাল ওয়রফেয়ার, দাবা শুধু মারকাটারি ওপেন গেম নয় বরং ধৈর্য আর যুক্তি-প্রতিযুক্তির ক্লোজড-গেম স্ট্র্যাটেজিও। এঁদের দাবাতত্ত্ব না নির্মিত হলে, আধুনিক হাইপারমডার্ন-দাবাতত্ত্ব আসত না। কিন্তু, মরফি রোম্যান্টিক যুগের সেই শিল্পী, যাঁর খেলা দেখে এখনও নতুনরা দাবা শেখে। যাঁর দাবা-তত্ত্ব এখনও ভিত নির্মাণ করে সারা বিশ্বের অসংখ্য দাবাড়ুর। দাবা বেঁচে থাকে যুদ্ধ আর প্রেমের নীতি ও কৌশলে- পল চার্লস মরফি সেই শিল্পের নিষ্ঠ প্রেমিক হয়ে রয়ে যান।

রোম্যান্টিক স্কুল শুধু সাহিত্যে আর শিল্পেই নয়, দাবাতেও ছিল, দারুণভাবে ছিল। দাবার তত্ত্ব তৈরি হচ্ছে তখন। একের পর এক ওপেনিং-তত্ত্ব তৈরি হচ্ছে। ষোলশো আর সতেরোশো শতকে রুই লোপেজ, লুই লুচেনা এবং গ্রেকোদের মতো স্প্যানিশ আর ইতালিয়ানরা দাবাকে তত্ত্বায়িত করেছেন, নতুন আইডিয়া ও আঙ্গিক নির্মাণ করেছেন ওপেনিং, মিডল্‌গেম আর এন্ডগেমে।

এরপরে দীর্ঘদিনের অনুশীলনে দাবার তত্ত্বকে বিবর্তনের পথে নিয়ে গেছেন ফিলিডোর, আঠারশো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। ফিলিডোরের তত্ত্বই ছিল, বোড়েকে দাবার মূল চালিকাশক্তি ক’রে তোলা – ‘… good play of the pawns; they are the soul of chess: It is they alone that determine the attack and defense, and the winning or losing of the game depends entirely on their good or bad arrangement.’

১.

দাবার রোম্যান্টিক জমানার শেষ শিল্পী সম্ভবত পল মরফি। আমেরিকার দাবা-বিশারদ, ঊনিশ শতকের অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু। অ্যান্ডারসন, বার্ড, হারউইৎজ, পলসেনদের জমানা তখন; আর, এঁরা প্রত্যেকেই এক একটু নতুন ওপেনিং-থিওরির উদ্‌গাতা। একদিকে ওপেনিং-তত্ত্ব তৈরি করছেন নিয়ত অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে, অপরদিকে এন্ডগেমে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করছেন। মরফি এঁদের সঙ্গে লড়াই করছেন।

কৈশোরেই আমেরিকার শ্রেষ্ঠ দাবাড়ুর খেতাব, এরপরে যাচ্ছেন ইউরোপে। দাবা দিয়ে ইউরোপকে জিতে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ। হারাচ্ছেন পলসেন, স্টন্টন, অ্যান্ডারসেনের মতো তাত্ত্বিকদের। মরফির বিজয়রথের সামনে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে সব প্রতিরোধ। মরফির দাবাপ্রতিভার প্রথম বলি আমেরিকার তৎকালীন কম্যান্ডিং জেনারেল উইনফিল্ড স্কট; মাত্র ন’বছরের বাচ্চা মরফি অমন এক জাঁদরেল জেনারেলের ইগো মাটিতে মিশিয়ে দিল, একাধিকবার।

দাবায় হেরে যাওয়া কিন্তু সে যুগে বেশ আঁতে ঘা লাগার ব্যাপার, তাও অমন এক বহুযুদ্ধজয়ী জেনারেল! মাত্র ১৪ বছর বয়সে হাঙ্গেরির লোয়েনথল্‌কে হারিয়ে দিগ্বিজয় শুরু মরফির। ইংল্যান্ডে একের পর এক ডিউকদের হারাতে শুরু করলেন। প্যারিসে ১৮৫৮ সালের বিখ্যাত ‘অপেরা গেম’! খেলাশুরুর আগে মরফিকে হারানোর এক পরিকল্পনা হল- মরফি অপেরার ভক্ত ছিলেন, তাই মরফিকে এমনভাবে বসানো হবে যাতে বারবার পেছনদিকে ঘুরে অপেরা দেখতে হয় তাঁকে! এতে মরফির মন:সংযোগ ব্যহত হবে এবং তিনি হারবেন!

মরফির বিরুদ্ধে দু’জন একসাথে; ডিউক অব ব্রুনসবিক আর কাউন্ট আইসোয়ার্ড। মরফির চোখধাঁধানো পিস স্যাক্রিফাইস, মাত্র ১৭ চালে হারিয়ে দিলেন প্রতিপক্ষদের। আজও দাবা-শিক্ষার্থীরা এই খেলা থেকে ‘পিন’-এর কৌশল ও কম্বিনেশন শেখে।

ইংলন্ড জার্মানি আর ফ্রান্সে অপ্রতিরোধ্য মরফি শুরু করলেন ‘ব্লাইন্ড চেস’! দাবার বোর্ড না দেখে মন-মগজাস্ত্রের সংযোগে মুখে মুখে দাবা খেলা। প্রায় এক শতক পরে ফিশার এই আঙ্গিককে জনপ্রিয় করেছিলেন আবার। মরফি ক্লোজড পজিশনে বিশ্বাস করতেন না, বিশ্বাস করতেন স্যাক্রিফাইসে। একটাই উদ্দেশ্য- পিস বা পন যাক, শুধু আক্রমণই করতে হবে।

প্রতিপক্ষের রাজাকে খুঁজে নিতে হবে অমোঘ অস্ত্রে। ইউরোপ-আমেরিকার তাবড় খেলোয়াড়েরা মরফিকে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের স্বীকৃতি দিলেন। মরফি মাঝেমাঝে খেলতেন একটা পিস বাদ দিয়ে! দু-তিনটে সহজ কিন্তু কার্যকরী নীতি- পিসগুলোকে সচল ক’রে দাও আগে, দাবাবোর্ডের সেন্টার দখল ক’রে তীব্র আক্রমণ শানাও। ১৮৫৯ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ডেকে পাঠালেন তাঁকে, সম্মান জানালেন বিশ্বের সেরা দাবাড়ুকে। প্যারিস, লন্ডন, বস্টন সব শহরেই মরফিকে সম্বর্ধনা দেওয়া হল। একসঙ্গে একাধিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে খেলা (simultaneous game) কিংবা মুখে-মুখে চাল বলে দাবা খেলা- মরফি বিশ্বদাবার অপ্রতিরোধ্য নায়ক!

২.

মরফি দাবা ছেড়ে দিলেন ১৮৬২ সালে, স্বেচ্ছায়। আমেরিকায় তখন গৃহযুদ্ধ; মরফির পরিবার বিপর্যস্ত। আইনজীবীর পেশাতে সুবিধে হলনা খুব। মরফি ক্রমশ আরও একা, নি:স্ব। কিন্তু, দাবাপ্রেম? আর কখনও কোনও চ্যালেঞ্জ নিলেন না, কিন্তু ভালবাসা কি ভোলা যায়? ১৮৭৮ নাগাদ মরফি হাত পাতলেন এক বন্ধুর কাছে- ২০০ ডলার ধার চাই।

বন্ধু ২৫০ ডলার দিতে রাজি, কিন্তু শর্ত- খেলতে হবে তার বিরুদ্ধে। মরফি, ঊনিশ শতকের অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু মাত্র কয়েক চালে হেরে গেলেন, বন্ধুকে বললেন, ‘I have done what you require, but the next time I play chess with you, I will give you the queen!’; মরফির দাবা-প্রেম আঁচ করতে পেরে ওই বন্ধু ছুটে এসে বললেন, ‘টাকাটা নিয়ে যাও!’ মরফি বলেছিলেন, ‘আগামীকাল নিতে আসব’।

সেই ‘আগামীকাল’ আর আসেনি; টাকা দিয়ে মরফির দাবা কিনতে পারেনি কেউ। ১৮৮৩ সালে শেষবার দাবা, উইলহেম স্টেইনিৎজের বিরুদ্ধে। মরফি হেরে গেলেন। আর, প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিসেবে জ্বলজ্বলে স্টেইনিৎজের নাম। অথচ, স্টেইনিৎজ বোধহয় জানতেন, মরফির মানসিক অস্থিরতা, নিঃস্ব অবস্থা এবং দাবায় আর মনসংযোগ করতে পারেন না মরফি। কিন্তু কোথাও বোধহয় দাবা এখনও রয়ে গেছে মরফির জন্যেই।

১৮৮৩ সালের এক সাক্ষাৎকারে মরফিকে নিয়ে বললেন, ‘Do not ask Morphy to play; let him sit and watch you play, perhaps one of his own old games. Presently he too will take to the board again, and the effort required will take his mind off his trouble.’

নি:সঙ্গ নি:স্ব মরফির দেহ ভাসছিল বাথটাবে, ১৮৮৪, মাত্র ৪৭ বছর বয়সে।

৩.

এরপরে আরও দাবা-তাত্ত্বিক আসবেন, যেমন স্টেইনিৎজ, টারাশ আর অ্যারন নিমজোউইশৎজ। দাবার বহু তত্ত্ব এঁদের হাতে নতুন রূপ পাবে। যদিও, নাজি জমানায় স্টেইনিৎজ, লাস্কারদের তত্ত্বকে অস্বীকারের চেষ্টা হবে, তাঁরা ‘ইহুদী’ বলে। নাজিদের দাবি ছিল, আর্যরক্তের দাবাড়ুরা যে রোম্যান্টিক তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন, তাকে নাকি জটিল ও ‘কাপুরুষোচিত’ করে তুলেছেন স্টেইনিৎজরা!

অথচ, স্টেইনিৎজ, নিমজোউইশৎজদের মগজাস্ত্রেই দাবা শুধুমাত্র ‘এক্সচেঞ্জ’-র খেলা নয়, বরং পজিশনাল ওয়রফেয়ার, দাবা শুধু মারকাটারি ওপেন গেম নয় বরং ধৈর্য আর যুক্তি-প্রতিযুক্তির ক্লোজড-গেম স্ট্র্যাটেজিও। এঁদের দাবাতত্ত্ব না নির্মিত হলে, আধুনিক হাইপারমডার্ন-দাবাতত্ত্ব আসত না। কিন্তু, মরফি রোম্যান্টিক যুগের সেই শিল্পী, যাঁর খেলা দেখে এখনও নতুনরা দাবা শেখে। যাঁর দাবা-তত্ত্ব এখনও ভিত নির্মাণ করে সারা বিশ্বের অসংখ্য দাবাড়ুর। দাবা বেঁচে থাকে যুদ্ধ আর প্রেমের নীতি ও কৌশলে- পল চার্লস মরফি সেই শিল্পের নিষ্ঠ প্রেমিক হয়ে রয়ে যান।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...