অনন্য যুদ্ধের অদম্য সেনানী

রীতিমত ‘আন্ডারডগ’ হয়েই ইংল্যান্ডে হাজির হয়েছিল ভারত দল। কেউ হয়ত প্রত্যাশাই করেনি যে দলটি ফাইনাল অবধিও উঠতে পারবে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মত দলকে টপকে ফাইনালে ওঠা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। তবে সেটা করে দেখিয়েছিলেন ভারতের ক্রিকেটারার।

৩৯ বছর আগে, এই উপমহাদেশের একটি দল প্রমাণ করেছিল, ক্রিকেটে পিছিয়ে নেই উপমহাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মত দুই বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে দেওয়ার মত দৃষ্টতা দেখায়। লর্ডসের বারান্দায় শিরোপা উচিয়ে ধরে ভারত। অথচ সেবার তো নিতান্তই অংশগ্রহণই বড় ছিল মূলমন্ত্র। তাচ্ছিল্যের সুরে আচ্ছন্ন। তবুও শিরোপা জয়ের মধ্য দিয়ে সব উপেক্ষার জবাবটা দিয়েছিল কপিল দেবের ‘টিম ইন্ডিয়া’।

রীতিমত ‘আন্ডারডগ’ হয়েই ইংল্যান্ডে হাজির হয়েছিল ভারত দল। কেউ হয়ত প্রত্যাশাই করেনি যে দলটি ফাইনাল অবধিও উঠতে পারবে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মত দলকে টপকে ফাইনালে ওঠা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। তবে সেটা করে দেখিয়েছিলেন ভারতের ক্রিকেটারার। অনন্য সে কাণ্ডের কৃতিত্ব খেলোয়াড়দের। ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ে খেলোয়াড়দের পারফরমেন্স বিশ্লেষণ থাকছে আজকের আয়োজনে।

  • কপিল দেব

অধিনায়কত্ব ঠিক কি করে করতে হয় সেটারই আরও একটি উদাহরণ হয়ে রইলেন কপিল দেব। দলের মনোবল যখন শূন্যের কোটায় তখন তিনি দলকে ভরসা জুগিয়েছেন। দলের সেরা ব্যাটার যখন ফর্মহীনতার চরম পর্যায়ে তখন তিনি হাল ধরেছেন। কপিল দেব নিজের রান করেছেন। উইকেট নিয়েছন। আবার রান আটকে রাখার কাজটাও করে গেছেন।

জিম্বাবুয়ের সাথে ১৭৫ রানের ইনিংসটা সামনে থেকে যারা দেখেছিলেন তারাই বোধহয় রোমাঞ্চের সপ্তম আকাশে অবস্থান করছিলেন। মাত্র ১৭ রানের মাথায় পাঁচ উইকেট হারিয়ে ফেলে তাঁর দল। কপিল নবম উইকেটে সৈয়দ কিরমানির সাথে গড়েন ১২৬ রানের এক অনবদ্য জুটি। সে জুটির অধিকাংশ রানই এসেছিল কপিলের ব্যাট থেকে। ১৯৮৩ সালের সে জুটিই ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নবম উইকেটে গড়া পার্টনারশীপ।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ জয়ে অবদান রাখার পাশাপাশি পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই তিনি ছিলেন অনবদ্য। আট ইনিংসে তিনি রান করেছেন ৩০৩। স্ট্রাইকরেট ছিল ১০৬ এর খানিক বেশি। তাছাড়া অলরাউন্ডার সত্ত্বার প্রমাণ রেখেছিলেন ২.৯১ ইকোনমি রেটে ১২ উইকেট শিকার করে। টুর্নামেন্টের পঞ্চম সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও ছিলেন তিনি।  শিরোপা তো তাঁর হাতেই মানায়।

  • সন্দীপ পাতিল

ভারতের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করা ব্যাটার ছিলেন সন্দীপ পাতিল। তিনি অধিকাংশ সময়ই খেলতে নেমেছিলেন দলের বিপর্যের সময়ে। পালটা আক্রমণ চালিয়ে রান তোলায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই তাই করে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। সফলও হয়েছেন। যদিও সে বিশ্বকাপের রান সংগ্রাহকদের মধ্যে তাঁর অবস্থান ছিল ষোলতম অবস্থানে।

তবে সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর ৩২ বলে খেলা ৫১ রানের ইনিংস নিশ্চয়ই মনে রাখার মতই এক ইনিংস ছিল। তাছাড়া এর আগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও তিনি করেছেন ২৫ বলে ৩০ রান। সে টুর্নামেন্টে তাঁর স্ট্রাইকরেট ছিল ৯০। যা কি-না বিশ্বকাপের গড় স্ট্রাইকরেটের প্রায় দেড়গুণ বেশি। তাছাড়া মূলত চাপ সামলে তিনি ব্যাটিং করেছেন, রান তুলেছেন। ভারতকে শিরোপা জয়ের পথেই রেখেছিলেন।

  • মদন লাল

১৯৮৩ বিশ্বকাপের আট ম্যাচের মধ্যে কেবল একটি ম্যাচে মদন লাল ছিলেন উইকেট শূন্য। তাঁর থেকেও বড় বিষয় তাঁর নেওয়া ১৭ উইকেটের ১১ খানাই ছিল টপ অর্ডার ব্যাটারদের। তিনি প্রায় প্রতিটা ম্যাচেই ভারতের হয়ে প্রতিপক্ষে খুটি নড়বড়ে করার চেষ্টা করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মহা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তিনি নিয়েছিলেন চার উইকেট। বিনিময়ে প্রতিপক্ষকে দিয়েছিলেন কেবল মাত্র ২০ রান।

তবে ফাইনালে তাঁর অবদান চিরদিন মনে রাখতে চাইবে ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাস। তিনিই তো ম্যাচের গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডসের উইকেট তুলে নেওয়া সহ ওয়েস্ট ইন্ডিজের মিডল অর্ডারে ধসিয়ে দিয়েছিলেন মদন লাল। গুরুত্বপূর্ণ দুই ম্যাচে বল হাতে মদন লাল আস্থার প্রতিদান দিয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইলেন।

  • মহিন্দর অমরনাথ

সেমিফাইনাল ও ফাইনালের ম্যাচ সেরার পুরষ্কার উঠেছিল মহিন্দর অমরনাথের হাতে। নিজের অলরাউন্ড পারফরমেন্স দিয়েই তিনি আদায় করে নিয়েছিলেন। সেমিফানালে তিনি একপ্রান্ত আগলে রেখে জয়ের শক্ত ভীত গড়েছিলেন। করেছিলেন ৯০ বলে ৪৬ রান। তাছাড়া তিনি বল হাতে সেবারের টুর্নামেন্টের সবোর্চ রান সংগ্রাহক ডেভিড গাওয়ারের উইকেট নেওয়া ছাড়াও আরও এক উইকেট নিয়েছিলেন। সে সাথে মাত্র ২৭ রান দিয়েছিলেন ১২ ওভার বোলিং করে।

নিজের পারফরমেন্সের ধারাবাহিকতা তিনি বজায় রেখেছিলেন ফাইনালেও। ব্যাট হাতে খুব বেশি রানের দেখা পাননি তিনি। করেছিলেন ধৈর্যশীল ২৬ রান। বল হাতে তিনি ম্যাচের ফলাফল ভারতের দিকে টেনে আনেন তিন উইকেট নিয়ে। সপ্তম উইকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৪৩ রানের জুটি ভাঙেন জেফ ডুজনের উইকেট তুলে নিয়ে। তাঁর অবদানও অনস্বীকার্য।

  • যশপাল শর্মা

ভারতের হয়ে তিন ম্যাচে সর্বোচ্চ রান করা ব্যাটার হলেন যশপাল শর্মা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিনি খেলেছিলেন ৮৯ রানের এক আলো ঝলমলে এক ইনিংস। সে ইনিংসের বদৌলতেই সবাইকে চমকে দিয়ে দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে দেয় ভারত। শুভ সূচনার পর দলের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় বহুগুণে।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাঁচা মরার লড়াইয়েও তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল সর্বাধিক ৪০ রান। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালেও তিনি হাল ধরেছেন, ধৈর্য্য সহকারে ১১৫ বল খেলে করেছেন ৬১ রান। সেটাও ছিল ভারতের পক্ষে সর্বোচ্চ। নিজের আগ্রাসী ব্যাটিং দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন যশপাল শর্মা।

  • রজার বিনি

১৯৮৩ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার ছিলেন রজার বিনি। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই তিনি ছিলেন ধারাবাহিক। বাগিয়ে নিয়েছিলেন ১৮ খানা উইকেট। তবে এর মধ্যে ১৪ খানাই ছিল প্রতিপক্ষে টপ অর্ডার কিংবা মিডল অর্ডার ব্যাটারদের উইকেট। বোলিং গড়টা ছিল ১৮.৮৬। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৯ রানে চার উইকেট শিকার টুর্নামেন্টের সেরা পারফরমেন্স ছিল রজার বিনির।

তাছাড়া নিজের উদ্বোধনী ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই কিংবদন্তি ভিভ রিচার্ডস ও ক্লাইভ লয়েডের উইকেট নিজের পকেটে পুরেছিলেন তিনি। সে ম্যাচে ৪৮ রান খরচায় নিয়েছিলেন তিনি উইকেট। ভারতকে আস্থা জুগিয়ে গেছেন রজার বিনি পুরোটা টুর্নামেন্ট জুড়েই। প্রতিপক্ষে টপ অর্ডারে আঘাত হেনেছেন তিনি নিয়ম করে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...