সুইসদের বিপক্ষে ম্যাচ শুরুর আগে পর্তুগালের একাদশ দেখে চক্ষুচড়ক হওয়ার জোগাড়। একাদশে তাদের প্রাণভোমরা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোই নেই! পর্তুগিজ কোচ ফার্নান্দো সান্তোস এক রকম সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েই রোনালদোর বদলে শুরুর একাদশে নামিয়ে দিলেন গনসালো রামোসকে। সবে বিশ পেরোনো যুবক।
পর্তুগালের জার্সি খেলার অভিজ্ঞতা বলতে মোটে ৩৩ মিনিট। কিন্তু কোচের ঐ সিদ্ধান্তেই একটা ইতিহাসের দ্বার উন্মোচন হয়ে গেল। একটা নতুন পর্তুগালের নবজোয়ার দেখল বিশ্ব।
৬৭৪৭ টা দিন! এই লম্বা সময় ধরে পর্তুগালে একাদশে একদম চেনা মুখ হয়ে ছিলেন রোনালদো। কিন্তু কোনো ইনজুরির কারণ ছাড়াই বহুদিন বাদে পর্তুগাল একাদশে জায়গা হারালেন পর্তুগিজ এ সুপারস্টার। আর রোনালদোবিহীন এমন একাদশের আগ্রাসনটা যেন এ দিন তটস্থই করতে পারেনি সুইস ফুটবলাররা।
মুহুর্মুহু আক্রমণে বারবারই ভেঙ্গে যায় সুইসদের দ্বার। এমনকি গোলবারের পরীক্ষিত সৈনিক ইয়ান সোমারও যেন এ দিন অসহায় হয়ে দেখলেন পর্তুগিজদের দৌরাত্ম্য। হজম করলেন ৬ খানা গোল। তবে পর্তুগালের স্কোরশিটে গোলের নাম্বার বাড়িয়ে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখানোর নায়ক ছিলেন রোনালদোর বদলে নামা ঐ রামোসই।
গুণে গুণে তিন খানা গোল দিয়েছেন। আর তাতেই তুলে নিয়েছেন ক্যারিয়ারের প্রথম হ্যাটট্রিক। রামোসের প্রথম হ্যাটট্রিকের দিনে কাতার বিশ্বকাপও পায় প্রথম হ্যাটট্রিকের দেখা। তবে গনসালো রামোস এই হ্যাটট্রিক দিয়ে বেশ কিছু কীর্তিতে নিজের নাম লিখিয়েছেন। বিশ্বকাপের নকআউট রাউন্ডে পর্তুগালের হয়ে এতদিন একমাত্র হ্যাটট্রিক করা ফুটবলার ছিলেন ইউসেবিও।
এবার সেই ইউসেবিওর পাশেই নাম লেখালেন রামোস। আর ২১ বছর বয়সে এ ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে তিনি ঠাই পেয়েছেন পেলের পরেই। কারণ পেলের পরে তিনিই ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার যিনি নকআউট স্টেজে এসে হ্যাটট্রিক করার কীর্তি গড়লেন।
কীর্তিগাঁথা এখানেই শেষ নয়। ১৯৬৬ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে ইউসেবিও সেই হ্যাটট্রিকটি করেছিলেন ২৪ বছর ১৭৯ দিন বয়সে। সেটিই এত দিন পর্যন্ত সর্বকিনিষ্ঠ পর্তুগিজ ফুটবলার হিসেবে নক আউটে গোল এবং হ্যাটট্রিকের রেকর্ড ছিল। কিন্তু কাতার বিশ্বকাপে এসে এবার সেই রেকর্ডটি ভেঙে দিলেন গনসালো রামোস। নিজের ২১ বছর ১৬৯ দিন বয়সে নক আউট পর্বে গোল পেলেন, সঙ্গে হ্যাটট্রিকও।
লিগ পর্তুগালে প্রমাণ করেই বিশ্বকাপ দলে জায়গা পেয়েছিলেন রামোস। চলতি মৌসুমে গোলের ছন্দেও ছিলেন তিনি। বেনফিকার হয়ে ১১ ম্যাচে পেয়েছিলেন ৯ গোল। এমনকি এবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও পেয়েছেন ৫ গোল।
সব মিলিয়ে দুর্দান্ত ফর্ম নিয়ে পর্তুগাল স্কোয়াডে আসলেও একাদশে জায়গা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রথম থেকেই ছিল। কারণ তিনি খেলেন রোনালদোর জায়গায়। সেই রোনালদোকে টপকে রামোস নামক উঠতি এক খেলোয়াড় জায়গা করে নিবেন, এমন ভাবনা স্বয়ং পর্তুগাল ভক্তরাই করেনি।
কিন্তু কোচের সাহসী সিদ্ধান্তে সব কিছু মুহুর্তের মধ্যেই যেন বদলে গেল। ৩৭ বছর বয়সী রোনালদোকে হটিয়ে নিজের জায়গা করে নিলেন ২১ বছর বয়সী রামোস। আর কোচের আস্থার প্রতিদানও দিলেন ম্যাচের শুরুতেই। গোল এক্যুরেসিতে রামোসের অসাধারণ নিপুণতায় একবারের জন্যও মনে হয়নি তিনি প্রথমবারের মতো পর্তুগালের হয়ে শুরুর একাদশে খেলছেন। সত্যিকার অর্থেই, গোটা ম্যাচ জুড়েই তিনি ছিলেন এক কথায় অনবদ্য।
এখন রামোস দ্যুতিতে একটা প্রশ্ন বারবারই ঘুরেফিরে আসবে। রোনালদোর কি তবে বিদায়ঘন্টার ক্ষণ গণনা শুরু হয়ে গেল। আপাতত রামোসের এমন পারফরম্যান্সের পর শুরুর একাদশে রোনালদোর জায়গা পাওয়াটা সত্যিই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। নক্ষত্রের তো প্রস্থান কিংবা পতন হয়।
সেই নিয়ম মেনে হয়তো রোনালদোরও প্রস্থানের সময় হয়তো চলে এসেছে। তবে এখনই সেটাকে শেষ বলা যাচ্ছে না। কারণ বিশ্বকাপ যাত্রায় পর্তুগালের জন্য সামনে এখনও অনেক বড় পরীক্ষা অপেক্ষা করছে। কে জানে, সেই বড় পরীক্ষায় ত্রাতা রূপে হাজির হবেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।
এমনভাবে ফিরে আসার গল্প তো বহু আগেই তিনি রচনা করেছেন। বিধাতা হয়তো এবারের গল্পটা ভিন্নভাবে তাঁর জন্য রেখে দিয়েছেন। সে গল্পে হয়তো তিনি নায়ক হবেন না, কিন্তু তাঁকে ঘিরে থাকবে সেই গল্পের রেশ।